ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বীর চট্টলার সন্তান মাস্টার দা সূর্যসেনের বীরত্বপূর্ণ আত্মদান। ক্ষুদিরাম, তিতুমীরসহ অসংখ্য শহীদের বীরগাথা ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশ ব্রিটিশের দুইশ বছরের গোলামি থেকে মুক্তি পায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্তির স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্যও দিতে হয়েছে একসাগর রক্ত। বাঙালি জাতির স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ও শোষণের মুক্তির লড়াইয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বীরদের আত্মত্যাগ আমাদের চেতনার মশাল হিসেবে কাজ করে। রক্তে লেখা ইতিহাস যেন বাঙালি জাতির ললাটের লিখন। সে আর থামছে না। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ববরেণ্য নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবারের জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে (এবং বাংলাদেশের সদস্য লাভের ৫০ বছর, ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর) আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্ব ওয়াকিবহাল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্ব নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। সবাই উৎসুক নয়নে দেখবেন আমাদের দেশ, জাতি এবং বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য। স্বল্প সময়ের সরকারের প্রধান হিসেবে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশের অবস্থান তুলে ধরবেন তিনি। মানুষের ভরসার শেষ আস্থা এবং প্রত্যাশার নয়নমণির নিউইয়র্কে শুভ আগমনে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে তাকে স্বাগত ও শুভেচ্ছা।
বিশ্ব পরিমণ্ডলে যে গুটিকয়েক ব্যক্তি বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের অন্যতম। ১৯৪০ সালের ২৮ জুন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে মা-বাবার কোল আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন ইউনূস। এই শিশুই বড় হয়ে সুবিধাবঞ্চিত গরিব মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করে তোলেন। স্কুল ও কলেজ-জীবন চট্টগ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তিনি প্রবাসে জনমত এবং অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বিদেশের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে নিজ দেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। একই সময়ে তার নিজ এলাকায় দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য হাটহাজারী উপজেলার জোবরায় নিজস্ব অর্থায়নে গরিব মানুষের মধ্যে বিনা জামানতে, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালু করেন। নিজে হাতেকলমে শিক্ষা দিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার সুফল পান। দারিদ্র্য বিমোচনের মন্ত্রে গড়ে ওঠে গ্রামীণ ব্যাংক। আস্তে আস্তে এই মন্ত্রের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আমেরিকা, তুরস্কসহ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়।
দারিদ্র্য বিমোচনের জাদুর স্পর্শে বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুধু তা-ই নয়, United States Presidential Medal of Freedom 2009 & Congressional Gold Medal in 2010, Gandhi Peace Prize, World food Prize, Olympic Laurel 2020 এবং সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ ফ্রান্স অলিম্পিকের মূল থিম করা হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। বিশ্ব পরিমণ্ডলে ব্যবসা, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন দিকে রয়েছে তার বিচরণ এবং বিশ্বের সবচেয়ে নামীদামি ৭০টির বেশি পুরস্কার তার ঝুলিতে রয়েছে। তা ছাড়া বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বড় সম্মানী দিয়ে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায় তাকে। কী ভীষণ নিরহংকার, নিপাট, সাদাসিধে গুণী মানুষ। তার কথায় মুগ্ধতা ছড়ায়। কী সম্মোহনী চোখ, নিদারুণ চাহনি, বাচনভঙ্গি, শ্রুতিমধুর শাণিত কথামালার গাঁথুনি। কত সুন্দর, সহজ, সাবলীলÑএই বয়সেও কী দুর্দান্ত, প্রাণবন্ত। বিদেশি ছাত্র-শিক্ষক সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার বক্তব্য শোনেন, যা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য এক অনন্য সম্মান ও গৌরবের।
কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা পরশ্রীকাতর। হিংসা, পরনিন্দা, পরচর্চা আমাদের অস্থিমজ্জায়। আমরা একে অন্যের উত্থান, প্রশংসা, ভালো কিছু সহ্য করতে পারি না। গুণীজনের সম্মান না দিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিই। গত ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ আসন থেকে এই সম্মানিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যা করা হয়েছে, তা দেখে দেশের বিবেকবান মানুষসহ বিশ্ববাসী স্তম্ভিত।
ড. ইউনূসকে কর ফাঁকির মামলা, শ্রম আদালতের মামলার নামে ঘন ঘন সাক্ষ্য ও রায়ের মহড়া দিয়ে হেনস্তা করা হয়। বিচারিক আদালতের মাধ্যমে বিশ্ববরেণ্য ৮৪ বছর বয়সী একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মানহানি, হয়রানি, অপদস্থ করা হয়। নামে-বেনামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ১৬৮টি মামলা হয়। তিনি আইনের আশ্রয়ে বেআইনের শিকার হন। এই বেআইনি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ১০৫ জন নোবেল বিজয়ী প্রথমেই তার পক্ষে দাঁড়ান। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, আল গোর, হিলারি ক্লিনটন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, আমেরিকা বিখ্যাত কেনেডি পরিবারসহ বিশ্ববরেণ্য ১৬৮ জন ড. ইউনূসের ওপর অন্যায় আচরণ বন্ধের বিবৃতি দিলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। চিঠির প্রতিটা শব্দ তার কাছে বিষের মতো মনে হলো। তিনি সবাইকে একহাত নিলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে দলকানা কুরুচিসম্পন্ন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা আদাজল খেয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে লেগে যান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেন, সুদখোর, রক্তচোষা, প্রফেসর ইউনূস ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে পদ্মা সেতুর টাকা আটকে দিয়েছে (যদিও কোনো প্রমাণ নেই), পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান, তাকে সেতু থেকে টুস করে পানিতে ফেলে দুবার চুবানি দেবেন, যাতে মরে না যায়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দলকানা সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও লীগের মাস্তানদের এ ধরনের পাহাড়সমান মানহানিকর সমালোচনার মুখেও ড. ইউনূস বোবার মতো শুধু চেয়ে থাকলেন। কোনো কথার উত্তর দিলেন না। কিন্তু এই না বলার চাহনি এবং মুখের ঝিলিকের মধ্যে অনেক রহস্য লুকিয়ে ছিল। লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, স্বৈরাচার ও কর্তৃত্ববাদী সরকারের অহংকার, দাম্ভিকতার জবাব এ দেশের জনগণ ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেয়। তিনি দেশ, জাতি এবং তার দলের নেতাকর্মীদের অরক্ষিত রেখে বোনকে নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান। আর সৃষ্টিকর্তার কী মহিমা, যাকে ১৫ বছর অপমানিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত করা হলো, সেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সমগ্র জাতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে ফুলের মালায় বরণ করে নিল।
এটাই হলো জনতার বিচার।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক