১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠিত হওয়ার পর থেকে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সংস্থার নিউইয়র্কস্থ সদর দপ্তরে বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় এ বছর ২২ সেপ্টেম্বর অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করছে। অত্যন্ত আশার কথা এই যে, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সর্বজনগ্রহণযোগ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যোগদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিগত দিনে দেশ পরিচালনায় ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সব ধরনের সরকারের মধ্যে বর্তমান বিপ্লবী বা অন্তর্বর্তী সরকার সর্বোচ্চ জনসমর্থনপ্রাপ্ত এবং বহির্বিশ্বেও এ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন আশাতীত। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাঁর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা কোনো অংশে কম নয়, তার সঙ্গে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রাপ্ত মর্যাদা যুক্ত হওয়ায় তা অনন্য উচ্চতা লাভ করেছে। বিগত দিনের অন্যায় সুবিধাভোগী ব্যতীত প্রায় সব জনগণই বর্তমান সরকারের সমর্থক। দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও দৃঢ় মনোবল দেশবাসীর নিকট ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বিগত দিনে প্রতিবেশী দেশ ও সে দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তে নির্দিষ্ট দল ও ব্যক্তির সঙ্গে ভুল নীতির বশবর্তী হয়ে সম্পর্ক রক্ষার ফলে তাদের মাধ্যমে একতরফা সুবিধা লাভের যে সুযোগ পেয়ে আসছিল, ক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে সে সুযোগের অবসান হয়েছে। এ কারণে বর্তমান সরকারের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণের যে নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে, অচিরেই তার অবসানকল্পে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং পারস্পরিক সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সকল পক্ষ ন্যায্য সুবিধা লাভে ব্রতী হবে বলে ধারণা করা যায়। জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইডলাইনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ইতিমধ্যে কিছু দেশের নিকট থেকে আগ্রহের কথা জানা গেছে এবং কিছু দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের জন্য বাংলাদেশের তরফ থেকে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রস্তাবিত বৈঠকের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
বিপ্লব-পরবর্তী দেশের সার্বিক অবস্থা জানার ব্যাপারে দেশ ও প্রবাসের সকল বাংলাদেশি এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের আগ্রহ রয়েছে। তাই স্বল্প পরিসরে দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে পুলিশ বাহিনীর বিতর্কিত আচরণের কারণে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই গ্রেপ্তার ও বিচার এড়াতে কাজে যোগদান না করে আত্মগোপনে আছেন, এমনকি অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গুর অবস্থার সুযোগে কিছু অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে ফৌজদারি অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নির্দিষ্ট কিছু ধারায় বিচারিক ক্ষমতা প্রদানসহ দুই মাসের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা পোষণ করা হচ্ছে। আর্থিক খাতের নৈরাজ্য দূর করার জন্য ইতিমধ্যে গৃহীত ব্যবস্থার কারণে পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। রেমিট্যান্সের গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের সফরে আর্থিক খাতের উন্নয়নে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আর্থিক খাতের ভঙ্গুর অবস্থা অনেকটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকার কর্তৃক পুনর্গঠনের জন্য ঘোষিত কমিশনসমূহের রিপোর্টের ভিত্তিতে পুনর্গঠন সম্পন্ন হলে সকল সেক্টরের ভঙ্গুর অবস্থার ত্বরিত উন্নতির আশা করা যায়। সে জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় প্রদান ও সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। দেশবাসী এবং রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হচ্ছে, যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা যাযাবর জীবনযাপনের সময়কাল থেকেই মানুষ উপলব্ধি করতে শিখেছে। বলা বাহুল্য, বন্য প্রাণীরাও নিরাপত্তার খাতিরে দলবদ্ধভাবে বসবাস ও চলাফেরা করে থাকে। তবে মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত বিধায় মানুষের দলবদ্ধ থাকার প্রক্রিয়া পশুপাখিদের থেকে উন্নত ও আইনি কাঠামোভুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ধ্বংসলীলা সংঘটিত হওয়ার পর মানবজাতির মধ্যে উপলব্ধি হলো এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন আবশ্যক, যার প্রতিনিধি থাকবে বিশ্ব সম্প্রদায়, যাতে যুদ্ধবিগ্রহ পরিহার করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তরাষ্ট্রীয় বিবাদ-বিসংবাদ সালিস-ব্যবস্থার মাধ্যমে নিষ্পন্ন করা সম্ভব হয়। সেই বিবেচনা থেকেই ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের সৃষ্টি। সাংগঠনিকভাবে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘের প্রধান অঙ্গ সংস্থাগুলো হলো সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত। এ ছাড়া রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনেসকো, ইউনিসেফ ইত্যাদি।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ন্ত্রণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হলেও বিশ্বযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করা ব্যতীত আঞ্চলিক পর্যায়ের এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের ছোট ছোট আকারের যুদ্ধ বা একই দেশের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করা পুরোপুরি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তদুপরি জাতিসংঘের অন্য সেবামূলক শাখা সংগঠনসমূহ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ নিরাময়, আর্তমানবতার সেবা কার্যক্রম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একই নীতি-আদর্শে অনুপ্রাণিত না হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে আর্তমানবতার প্রশ্নে সবার প্রতি সমান আচরণের নীতি প্রতিফলিত হচ্ছে। কখনো এর ব্যতিক্রম যাতে না ঘটতে পারে অর্থাৎ কারও প্রতি অবহেলা বা পক্ষপাতমূলক আচরণ পারস্পরিক কল্যাণের স্বার্থে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তা না হলে সবলের অত্যাচারে দুর্বলের যেমন ত্রাহি অবস্থা হতো, তেমনি সারা পৃথিবীও হতো মহা বিপর্যয়কর। তা সত্ত্বেও আইনি মারপ্যাঁচে সদস্যদেশসমূহের পরস্পরের প্রতি নিরপেক্ষতায় হেরফেরের সম্ভাবনা আছে কি না, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। সে ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের আইনগতভাবে কোনো প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ কতটুকু, তাও ভেবে দেখা দরকার। যদিও প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র কর্তৃক চৌকসদেরই প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। যদি কোনো ব্যত্যয় হয়েও থাকে, তবে তা নিরপেক্ষ বিবেকবান মানুষের গোচরীভূত হলে অন্যায় ও অন্যায্য হিসেবে পরিগণিত হয় এবং তাদের তরফ থেকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। ফলে শক্তিশালী পক্ষ একতরফাভাবে দুর্বল প্রতিপক্ষের ওপর যাচ্ছেতাই আচরণ করতে পারে না। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার সঠিক ও মানবিক ব্যবহারের স্বার্থে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন আবশ্যক, তেমনি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহেরও সময়ের চাহিদা মোতাবেক আধুনিক ও যুগোপযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজন মোতাবেক যথোপযুক্ত সংস্কার সাধনের মাধ্যমে প্রশ্নাতীত অধিকতর নিরপেক্ষ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সাপেক্ষে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় যথোপযুক্ত অনন্য ভূমিকা পালনই হোক সভ্যতা বিকাশের রক্ষাকবচ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।