আমি যখন ছোট ছিলাম অর্থাৎ আজকের এই আমি হয়ে ওঠার আগে যে পরিবেশে ছিলাম, তখন শুধু দুই বাংলার নয়, বিশে^র বিভিন্ন দেশের অনেক বিশিষ্ট প্রাজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ মানুষঘেরা ছিলাম। কুলাউড়ার বিভিন্ন মিটিং কিংবা ঢাকা থেকে প্রকাশিত মানব ঠিকানা আয়োজিত অনুষ্ঠানের বেশ কিছু চমৎকার স্মৃতি আমার মানসপটে আজো ভাস্বর হয়ে আছে। ওই সময়ে আমার বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা ও জ্ঞান ধারণক্ষমতা ছিল সীমিত। আমি সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তগুলোর গভীরতা, প্রয়োজনীয়তা বা তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। সেসব অনুষ্ঠানে শিক্ষনীয় বিষয় ও সামাজিক রীতি-নীতির যে আদান-প্রদান ঘটতো তা ছিল অতুলনীয়। আমার ছোট্ট অতীত থেকে কিছু স্মৃতি উল্লেখ করার কারণ, আমাদের নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঠিকানার প্রাসঙ্গিকতা এবং গুরুত্ব তুলে ধরা। দ্রুত-পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য আরও অগ্রগতি বৃদ্ধি, বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ- সংস্কৃতি এবং সামগ্রিকভাবে কম্যুনিটিকে উপকৃত করার জন্য ঠিকানা সর্বদা নিরলস কঠোর গতিতে কাজ করছে বলে আমার ধারণা।
কুলাউড়া ছাড়াও এই নিউ ইয়র্কে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়ে বড় হওয়ায় খুব অল্প বয়স থেকেই আমি একজন সাংবাদিকের দৃষ্টিতে বিশ্ব এবং তাবৎ দুনিয়ার মানুষকে দেখতে শিখেছি। প্রতি সাপ্তাহে পত্রিকা প্রকাশের পর পরই যাত্রা শুরু হয় পরবর্তী সংখ্যাটির প্রস্তুতি। বিশ্রাম না নিয়ে পরিবারের সাথে সময় না কাটিয়ে। আমি দেখেছি আমাদের ত্যাগী সাংবাদিক বা কর্মীদলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা কী ভাবে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, জ্ঞানগর্ভ পর্যালোচনা সমালোচনার উপর কড়া নজর দেন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত মানব ঠিকানার সাথে আমার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে মানব ঠিকানার জন্ম; আর আমিও মানব ঠিকানার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর এক মাস আগে এই পৃথিবীতে এসেছি। বড় হওয়ার সাথে সাথে দেশে এবং বিদেশে স্বনামধন্য বিশিষ্ট সমাজসেবী সাংবাদিকদের সহায়তায় বিভিন্ন সময় নানা আলোচনার মাধ্যমে নতুন কৌশল গ্রহণ করে কাগজ গুলোকে কী ভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়,তার ওপর জোর দেওয়া হয়। ঠিকানা এবং মানব ঠিকানা সম্প্রতি আরও বেশি কার্যকর করে দ্রুত উপায়ে কমিউনিটিকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে এটিকে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পরিণত করা হয়েছে। একটি সংবাদপত্র পরিবারের সদস্য হওয়ার একটি খারাপ দিক সব সময় ছিল। সবকিছুতেই এবং প্রতিটি পদক্ষেপে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয়। আমার মনে আছে, এক বন্ধু ঠাট্টা করে আমাকে বলতো, ‘রাফিদ, তুমি যদি কিছু ভুল কর, আর ধরা পড়ো, তা ঠিকানায় ছাপিয়ে দেয়া হবে।’ আমি তখন হয়তো এর গভীর অর্থ বুঝতে পারতাম না, কিন্তু বড় হওয়া ও কিছুটা জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে আমি বুঝতে পেরেছি যে ঠিকানা এমন একটি কাগজ যা আমাদের সমাজের আয়না হিসেবে কাজ করে; ন্যায্যতা, নৈতিকতা ও সমদৃষ্টিকোণ থেকে সংবাদ বাছাই করে।
কোভিড-১৯-এর ভয়াল থাবার সময় অন্যান্য অনেক সংবাদপত্র বা কোম্পানির মতোই ঠিকানাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কারণ পুরোনো দুইজন সদস্য যারা ঠিকানা ও এর অভ্যন্তরীণ কার্যাবলীর সাথে ওৎপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন- এমন এক সময়ে পত্রিকা ছেড়ে চলে যান যখন আমার বাবা-মা উভয়েই কোভিড আক্রান্ত ছিলেন। কন্টকাকীর্ণ পথে ঠিকানার মরমর অবস্থা ছিল। কোভিডের ভয়াবহতায় তখনও স্বাভাবিক রুটিনের জন্য বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ভয় ছিল ব্যাপক। এরই মধ্যে মানুষ তাদের নিজ নিজ পেশা ও কর্মক্ষেত্রে ফিরে এসে আবারও স্বাভাবিকতার অনুভূতির স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করছিল। যেহেতু তারা চলে গেছেন তাই এ পরিস্থিতিতে তাদের ব্যক্তিগত লাভের আশায় ঠিকানাকে বিপন্ন করার সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেন।
আমার বোন মুশরাত শাহীন ও দুলাভাই রুহিন হোসেন- এই দুজনের চৌকস হস্তক্ষেপ ও সহায়তায় শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের পরাজয় এবং সত্য ও ন্যায়ের জয় হয়। এম এম শাহীনের অধীনে তারা সৃজনশীল বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এবং দাপ্তরিক কাজে অফিসে যাতায়াত করতে স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি নেন। আব্বু কোভিড আক্রান্ত হলেও বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনের জোরে কাজ চালিয়ে যান। এছাড়াও বহু বছর সফলভাবে নেতৃত্ব দানকারী সম্মানিত ফজলু চাচা, শামসুল চাচা, শহীদুল চাচা, নাশরাত আন্টি, সেলিম কাক্কু, মাসুদ চাচ্চু, সেজ কাক্কু, ঢাকা অফিসে আশরাফ চাচা, নুরুল চাচা,মোস্তফা চাচা, বিনয় দা, সালাম চাচা, মামুন কাক্কু, মিতুলসহ সাংবাদিক ও কম্পিউটার বিভাগে কর্মরত সবার সাহায্য ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা ছিল কল্পনাতীত। এই অন্ধকার সময়ে পত্রিকাটিকে ধরে রাখার জন্য এবং এটির প্রতি তাদের বহু বছরের সেবার জন্য ঠিকানা টিমকে বিশেষ ধন্যবাদ।
ঠিকানা প্রাচীনতম এবং সর্বাধিক প্রচারিত জাতিগত সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে একটি যা সমগ্র উত্তর আমেরিকায় বাঙালি কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করে। অনেক সৃজনশীল এবং গুণী বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায় ঠিকানা গত তেত্রিশ বছর ধরে আমাদের কমিউনিটির সেবা করার জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে এখন চৌত্রিশ বছরে পদার্পণ করছে। সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি এম এম শাহীন ও তাঁর টিমের নেতৃত্বে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চমৎকার তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে প্রকাশনা ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্প ও উচ্চাকাক্সক্ষার সাথে বহু বছর ধরে সফল ভূমিকা পালন করছেন। বাংলাদেশ ও আমেরিকা উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে অনেক অজানা বিষয় তুলে ধরে দুই সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধ, সম্প্রীতি ও বৈচিত্র্য গড়ে তোলার মাধ্যমে আমাদের স্থানীয় কমিউনিটির মানুষের সেবা করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে। ঠিকানা বাংলাভাষী কমিউনিটির মধ্যে তেত্রিশ বছর আগে যে সেতুটি তৈরি করেছে তা উত্তর আমেরিকা জুড়ে অসংখ্য ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়ার অনেক দরজা খুলে দিয়েছে।
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন মানুষ তথ্যের জন্য তাদের ডিভাইসের উপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। এ কারণে কাগজে ছাপা সংবাদপত্র বিশেষ করে স্থানীয় সংবাদপত্রের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ‘নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মেডিল স্কুল অফ জার্নালিজমের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালের শেষ থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত দেশে ৩৬০ টির বেশি সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি সংবাদপত্র হারিয়েছে এবং সম্ভবত ২০২৫ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হারাবে।’ এছাড়াও ‘সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি শক্তিশালী মুদ্রণ বা ডিজিটাল সংবাদ সংস্থা ছাড়া কমিউনিটি
গুলোতে ভোটারদের অংশগ্রহণ হ্রাস পায়। অন্যদিকে দুর্নীতি বেড়ে যায়। আবেরনাথি বলেন, ‘ভুল তথ্যের বিস্তার, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং মিডিয়ার উপর আস্থা হ্রাস করে।’
আমার প্রজন্ম এবং পরবর্তী প্রজন্ম ঠিকানা পড়ার মাধ্যমে কেবল এর সমৃদ্ধ ও দীর্ঘ ইতিহাসেই অংশ নেবেন না; বরং তারা বিভিন্ন বিষয় জেনে নিজ মাতৃভূমি এবং এর সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হবেন। আমি আন্তরকিভাবে অনুরোধ করছি, আপনি বাংলা পড়তে বা লিখতে না পারলেও একবার হলেও, একটি পত্রিকা হাতে নিন, তাতে চোখ রাখুন এবং চারপাশে তাকান। কারণ একবার চারপাশে তাকালে আপনি এমন কিছু দেখতে পাবেন যা আপনাকে আকৃষ্ট করবে, জানার জন্য আরও আগ্রহের সৃষ্টি করবে। তাই অনুগ্রহ করে পড়ুন!
আমি যে কারণে স্থানীয় সংবাদপত্রের গুরুত্বের উপর জোর দিচ্ছি তা হলো: ঠিকানা এমন একটি জায়গা যেখানে মূলধারার যথাযথ ও সতর্ক সাংবাদিকতার চর্চা হয়। যারা এটি প্রকাশের জন্য কঠোর শ্রম দেন তারা তাদের পরিশ্রমের জন্য আমাদের কাছ থেকে স্থায়ী প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
সবশেষে, আমি মহান লেখক রিচার্ড ক্লুগারের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আমার ছোট লেখাটি শেষ করতে চাই, ‘খারাপ হলেও একটি সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেলে দেশ স্বৈরাচারবাদের একটু কাছাকাছি চলে যায়।’
সংবাদপত্র একটি সম্মিলিত প্রয়োজন এবং এই শিল্পের ভাগ্য বাঁচাতে হলে আমাদের সকলকে মতপার্থক্য ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
লেখক : নতুন প্রজন্ম।