সিরাজুল ইসলাম সরকার
(গত সপ্তাহের পর): ১৯৫২ সাল, কারামুক্ত হয়ে নিজ বাড়িতে বঙ্গবন্ধু শুয়ে বিশ্রাম করছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু একা ছিলেন। তারই মাঝে রেনু (বেগম ফজিলাতুন নেছা) এসে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, কেনো তুমি অনশন করতে গেলে? ওদের কি দয়া মায়া আছে? আমাদের কারো কথা কি তোমার মনে ছিলো না? তোমার কিছু একটা হয়ে গেলে কি উপায় হতো আমাদের। আমি দুটিা দুধের বাচ্চা নিয়ে কি করে বাঁচতাম? হাসিনা-কামালের অবস্থা কি হতো? তুমি বলবে, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হতো না। মানুষ কি শুধু পাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতে?
বঙ্গবন্ধু রেনুকে কিছুই বললেন না, সেদিন শুধু বলতেই দিলেন। কারণ বঙ্গবন্ধু জানতেন, রেনুর মনে অনেক কষ্ট। মনের কথাটা প্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছুটা হলেও কমে যায়। রেনু খুব চাপা, আজ যেনো তার কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। বঙ্গবন্ধু মনে মনে ভাবছেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বললেন, ‘উপায় ছিলো না’। তখন বাচ্চা দুটি ঘুমিয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুও শুয়ে পড়লেন। ২৭/২৮ মাস পরে বঙ্গবন্ধু সেই পুরানো জায়গায়, পুরানো কামরায়, পুরানো বিছানায় শুয়ে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের দিনগুলোর কথা মনে পড়লো। ঢাকার খবর সবই পেয়েছিলেন। মহিউদ্দিন মুক্তি পেয়েছে শুনে বঙ্গবন্ধু খুশি। বঙ্গবন্ধু ভাবতে শুরু করলেন, আমি জেল থেকে বাইরে এলাম, আর আমার সহকর্মীরা আবার জেলে গেলো!
পরের দিন সকালে বঙ্গবন্ধুর বাবা ডাক্তার ডেকে আনলেন। সিভিল সার্জনের প্রেসক্রিপশনও ছিল। ডাক্তার সবাইকে বললেন, বঙ্গবন্ধুকে যেনো বিছানা থেকে উঠতে দেয়া না হয়। ১০দিন পর হাঁটতে হুকুম দিলেন সার্জন। তাও শুধুমাত্র বিকাল বেলা।
বঙ্গবন্ধুকে দেখতে প্রতিদিন অনেক লোক আসতো। খুলনা, যশোর, বরিশাল থেকে অনেক লোক আসতো। একদিন সকালে বঙ্গবন্ধু ও রেনু (বেগম ফজিলাতুন নেছা) বিছানায় বসে গল্প করছিলেন। হাসিনা ও কামাল নিচে খেলছিলো। হাসিনা মাঝে মাঝে খেলা রেখে আব্বা, আব্বা বলে বঙ্গবন্ধুর কাছে আসে, আব্বা বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাসিনাকে বললো, হাসু আপা, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি! কথাটা বঙ্গবন্ধু ও রেনু দু’জনই শুনলেন। বঙ্গবন্ধু আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে কামালকে কোলে নিয়ে বললেন, আমিতো তোমারও বাবা। কামাল বঙ্গবন্ধুর কাছে আসতে চাইতো না। কিন্তু আজ গলা ধরে পড়ে রইলো। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে যান, তখন কামালের বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা, আর তার আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কতো বড় জঘণ্য অপরাধ, তা কে বুঝাবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। দুইশ বছর পর আমরা স্বাধীন হয়েছি।
বঙ্গবন্ধু বলেন, এই স্বাধীনতা আন্দোলনে কিছুটা হলেও ভূমিকা ছিলো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বঙ্গবন্ধু বলেন, আজ আমাকে এবং আমার সহকর্মীদেরকে বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরো কতোকাল খাটতে হয়, কেইবা জানে। একেই কি বলে স্বাধীনতা! বঙ্গবন্ধু বলেন, ভয় পাই না। আর মনও শক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তানই গড়তে হবে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন। গোপালগঞ্জে যেই আসেন, সবাই বলে আপনি কেনো বার বার জেলে যান। আপনিইতো আমাদের পাকিস্তানের কথা শুনিয়েছিলেন। আবার বলে, কতো কথা বলেছিলেন, পাকিস্তান হলে অনেক উন্নতি হবে। জনগণ সুখে থাকবে। অত্যাচার-জুলুম থাকবে না। কয়েক বছর হয়ে গেলে দুঃখ আরো বাড়ছে। কমার লক্ষণও তো দেখছি না। চাউলের দাম কতো বেড়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, এ প্রশ্নের কি উত্তর দেবেন? এরা সাধারণ মানুষ, কি করে এদের বোঝাবেন। গ্রামে অনেক মাতব্বর শ্রেণির লোক আছেন, যারা বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। কথা খুব সুন্দরভাবে বলতে পারেন। এক কথায় তো বোঝানো যায় না। বঙ্গবন্ধু বললেন, পাকিস্তান খারাপ না, পাকিস্তানতো আমাদেরই দেশ। যাদের হাতে ইংরেজরা ক্ষমতা দিয়ে গেছে, তারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থটাই বেশি দেখছে।
পাকিস্তানকে কি করে গড়তে হবে, জনগণের কি করে উন্নতি করা যাবেÑ সেদিকে ক্ষমতাশীনদের কোনো খেয়াল নেই। ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি হওয়ার পরে গ্রামে গ্রামে জনসাধারণ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, যারা শাসন করছে, তারা জনগণের আপন লোক নয়? খবর নিয়ে জানতে পারলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার খবর বাতাসের সাথে সাথে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে এবং ছোট ছোট হাটবাজারে পর্যন্ত হরতাল হয়েছে। মানুষ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, বিশেষ একটা গোষ্ঠী (দল) বাঙলিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়।
ভরসা হলো, তাদের আর দমাতে পারবে না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা না করে উপায় নেই। এই আন্দোলনে দেশের লোক সাড়া দিয়েছে ও এগিয়ে এসেছে। কোনো কোনো মাওলানা সাহেব ফতোয়া দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। তারাও ভয় পেয়ে গেছেন। এখন আর প্রকাশ্যে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। জনমত সৃষ্টি হয়েছে। জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়। শাসকরা যখন শোষক হয়, অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে, তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়।
অসুস্থ বঙ্গবন্ধুকে মার্চ মাস পুরোটাই বাড়িতে থাকতে হলো। শরীরটা একটু ভালোর দিকে, কিন্তু হার্টের দুর্বলতা রয়েই গেছে। বঙ্গবন্ধুর বাবা তাকে মোটেও ছাড়তে চান না। ডাক্তারও নিষেধ করেছেন কোথাও যেতে। রেনুর ভয় ঢাকা গেলে বঙ্গবন্ধু চুপ করে থাকতে পারবে না। আবার গ্রেফতার করতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মন পড়ে রয়েছে ঢাকায়। নেতাকর্মীরা সবাই জেলে। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা গোপনে সভা করতে গিয়ে সবাই এক সাথে গ্রেফতার হয়েছেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগের অনেক নেতাই জেলে বন্দী। আওয়ামী লীগের কাজ একেবারে বন্ধ। কেউ সাহস করে কথাও বলছে না। মুসলিম লীগ সরকার অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, যা কিছুই হোক না কেনো, বসে থাকা যাবে না!
ঠিক তখন ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়ার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু একটি চিঠি পেলেন। চিঠিতে বঙ্গবন্ধুকে দ্রুত ঢাকায় যাওয়ায় কথা লিখেছেন। চিকিৎসা ঢাকায়ই করা যাবে এবং ঢাকায় বসে থাকলেও কাজ হবে। চিঠিটি বঙ্গবন্ধু তার বাবাকে দেখালেন। তার বাবা চুপ করে থাকলেন কিছু সময়, তারপর বললেন, যেতে চাও যেতে পারো? রেনুও কোন আপত্তি করলো না। বঙ্গবন্ধু খবর পেলেন আগের বিছানাপত্র কিছুই নেই। আবার নতুন করে সবকিছু কিনতে হবে। বঙ্গবন্ধুর টাকার দরকার। ঢাকা গেলে কয়েক মাসের খরচও তো লাগবে। ঢাকা থেকে আবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্লা জালাল উদ্দিন খবর দিলেন, তাঁতীবাজারে বঙ্গবন্ধুর জন্য একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে। বাসাটা আসলে ওরাই নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, তাহলে আমি ওখানেই উঠতে পারবো। ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে বঙ্গবন্ধু আর উঠতে চান না। কারণ সেখানে অনেক লোকের আসা-যাওয়া।
শওকত মিয়ার কথা বঙ্গবন্ধু স্মরণ করলেন। শওকত মিয়া বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন ও সাহায্য করেন। বঙ্গবন্ধুর শরীর ভালো না। চিকিৎসা করাতে হবে। গোপনে রেনু কিছু টাকা বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন। বাবার কাছ থেকে আরো কিছু টাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকা রওনা করলেন। এটা এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ। হাসিনা ও কামাল বঙ্গবন্ধুকে ছাড়তে চায় না। ওদের উপর বঙ্গবন্ধুর দুর্বলতা বেড়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর যাত্রাকালে দুই ভাই-বোন খুব কাঁদলো।
বঙ্গবন্ধু বরিশাল হয়ে ঢাকা পৌঁছলেন। জালাল বঙ্গবন্ধুকে নারায়ণগঞ্জ থেকে নিয়ে যেতে আসলে ওদের বাসায় বঙ্গবন্ধুর জন্য একটা কামরাও ঠিক করে রেখেছেন থাকার জন্য।
শামসুল হক সাহেব আওয়ামী লীগের আফিস নবাবপুর নিয়ে এসেছেন। এই বাড়িতে মানিক সাহেব (ইত্তেফাকের মালিক) এই বাড়িতে ছেলে-মেয়ে নিয়ে কিছুদিন ছিলেন। মানিক সাহেব, আতউর রহমান সাহেব ও আরো অনেকের সাথে বঙ্গবন্ধুর দেখা হলো। ডাক্তার নন্দীর কাছে গিয়ে নিজেকে দেখালেন। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিলেন। আওয়ামী লীগের আফিসে গিয়ে দেখেন একটি টেবিল, তিনটি চেয়ার ও একটা লম্বা টুল। প্রফেসর কামরুজ্জামান আফিসে বসেন। একটা ছেলে রাখা হয়েছে অফিসের কাজ করার জন্য। তখন শামসুল হক জেলে। বঙ্গবন্ধু যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। ওয়ারকিং কমিটির সভা ডাকলেন।
সভায় ১২/১৩ জন লোক উপস্থিত হয়েছিলেন। তারা সবাই বঙ্গবন্ধুকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিলেন। আতাউর রহমান সহ-সভাপতি ছিলেন, তাই তাকে সভাপতি করা হয়েছিলো। ঢাকায় তখন একটা ত্রাসের রাজত্ব চলছিলো। ভয়ে মানুষ কোন কথা বলে না। কথা বললেই গ্রেফতার করা হতো। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলিতেও একই অবস্থা। আওয়ামী লীগ অফিসে কেউ আসে না ভয়ে। বঙ্গবন্ধু আর কামরুজ্জামান সাহেব বিকালে অফিসে বসে থাকেন। বঙ্গবন্ধু দেখলেন, অনেক চেনা লোক আওয়ামী লীগের অফিস দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেন। এদের মধ্যে দলীয় লোকজনও ছিল। কেউ কথা বলতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলতেন, কথা বলতে হলে অফিসে দেখা করবেন। শহীদ সাহেব যখন এসেছিলেন, তখন একটা টাইপ রাইটিং মেশিন আফিসে দিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকায় একজন ছাত্র, নাম তার সিরাজ। সে এক হাত দিয়ে আস্তে আস্তে টাইপ করতে পারতো। বঙ্গবন্ধু তাকে আফিসে কাজ করতে বললেন। সে রাজি হলো। কাজ করতে করতে সে পরে ভালো টাইপ শিখে গেলো। একজন পিয়ন রাখলেন। প্রফেসর কামরুজ্জামান নিজ বাসায় থাকতেন। হঠাৎ একদিন একজন এডভোকেট অফিসে আসলেন সদস্য হতে। তিনি বললেন, আজ বেশি সময় দিতে পারবো না। তবে অফিস ছুটির পর অফিসের সব কাজ আমি করতে পারবো। বঙ্গবন্ধু খুশি হলেন। ভদ্রলোক আস্তে আস্তে কথা বলেন। বয়স বঙ্গবন্ধুর সমান হবে। বঙ্গবন্ধুর খুব পছন্দ হলো।
বঙ্গবন্ধু তাকে আফিসের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করলেন। এডভোকেট বললেন, আমি দায়িত্ব নিতে পারবো না, তবে অফিস ছুটির পর প্রতিদিন আমি আসবো। এরপর থেকে তিনি রোজই আসতেন। পুরানো অফিস সেক্রেটারি বেচারা কেটে পড়লেন। পরে বঙ্গবন্ধু এডভোকেট সাহেবকে অফিস সেক্রেটারি বানালেন। বেচারা ১৬ বছর একটানা কাজ করেছেন। অত্যন্ত সততার সাথে সব দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনদিন কারো সাথে কোন কটূ কথা হয়নি। কোনদিন সভায় বক্তব্যও দেননি। সবাইকে সমান করে কথা বলতেন। হিসাব-নিকাশ ছিলো একদম পরিস্কার। তার নাম ছিলো মিস্টার মোহাম্মদউল্লাহ। শহীদ সাহেব, ভাসানী সাহেব সবাই তাকে ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাসও করতেন। অফিসের কাজ কখনো পড়ে থাকতো না।