বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ১৬ বছরের শাসন-শোষণের অবসান ঘটেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার দগদগে ক্ষত বহন করছেন ডজনাধিক জেলার কমপক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আনসার-গার্মেন্টস শ্রমিক এবং তথাকথিত দাবিদাওয়া পার্টির নানাবিধ অযৌক্তিক আন্দোলন মোকাবিলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রীতিমতো গলদঘর্ম। এদিকে দীর্ঘকাল ক্ষমতার সুবিধাবঞ্চিত ও মোহাবিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে দলীয় ত্যাগের অনিবার্য সাফল্যের দাবি; সংস্কার-কুসংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে চটজলদি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর; অন্তর্বর্তী সরকারের রোডম্যাপ ইত্যাদি দাবিদাওয়ায় বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস নতুন করে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ্বমুসলিমের মতো বাংলাদেশের মুসলমানদের সিংহভাগও ব্যক্তিস্বার্থ, গিবত, লোভ-লালসা ও পাপপঙ্কিলতার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। এমনতর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে পাপসাগরে ডুবন্তপ্রায় এবং দিগ্্বিদিকজ্ঞানশূন্য হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের জীবনে আত্মশুদ্ধি ও ক্ষমার মহিমান্বিত বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে আবারও পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের দ্বারে কড়া নাড়ছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ আশপাশের রাষ্ট্রগুলোর মুসলমানরা আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর এবং উত্তর আমেরিকা-কানাডাসহ অন্যান্য স্টেটের মুসলমানরা ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার দিবাগত রাতে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। মহিমান্বিত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) অনুষ্ঠানটির সঙ্গে আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর ধরাধামে আগমনের রয়েছে যোগরূঢ় সম্পর্ক।
ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে সেই আইয়ামে জাহেলিয়াত বা চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে ৫৭০ মতান্তরে ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার পবিত্র মক্কা নগরীর ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ পরিবারের হাসেমি বংশে লোকান্তরিত পিতা আবদুল্লাহ এবং মা আমেনার গৃহে অনাথ-এতিম মোহাম্মদ (সা.) এর জন্ম হয়। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর ধরাধামে আগমনকে স্বয়ং মহানবী (সা.) পরম করুণাময়ের দরবারে বিশ্ব মুসলিমের অন্যতম পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর করজোড়ে মিনতি; হজরত ঈসা (আ.) এর ভবিষ্যদ্বাণী এবং তাঁর জননী বিবি আমিনার স্বপ্ন হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। তাই আখেরি নবী মোহাম্মদ (সা.) এর ধরাধামে আগমনকে চিরস্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখার খাতিরেই বিশ্ব মুসলিম প্রতিবছর ১২ রবিউল আউয়াল ধর্মীয় নানা আয়োজনে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্্যাপন করে থাকে। প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগ থেকে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) প্রবর্তন হলেও অতি সম্প্রতি একশ্রেণির তথাকথিত জ্ঞানগর্ভ আলেম-ওলামা অনুষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের বিতর্কের জন্ম দিচ্ছেন। অতি জ্ঞানের ঐন্দ্রজালিক শক্তির দাবিদার এসব আলেম উম্মি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে রীতিমতো ইন্ধন জোগাচ্ছেন। তাই পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) গুরুত্ব ও যৌক্তিকতার চুলচেরা বিশ্লেষণের দায়িত্ব আমরা আল্লাহর হাতেই সমর্পণ করছি।
ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত অনুসারে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা হজরত ঈসাকে (আ.) সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেওয়ার পর প্রায় ৫০০ বছর জগতের বুকে কোনো নবী-রাসুলের আবির্ভাব ঘটেনি। এই দীর্ঘ সময়ে আরব-অনারব নির্বিশেষে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ আল্লাহর একত্ববাদ পরিহার করে পৌত্তলিকতা, চন্দ্র-সূর্য- অগ্নিপূজা, দেব-দেবীর পূজায় পুরোপুরি মত্ত হয়ে উঠেছিল। পবিত্র কাবাগৃহে স্থান পেয়েছিল ৩৬০টি মূর্তি। সামান্য কারণে বা নানা ছলছুতোয় যুদ্ধলিপ্সু আরব গোত্রগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ত এবং বছরের পর বছর তা চালিয়ে যেত। আবার অভাব-অনটন এবং দায়গ্রস্ততার অজুহাতে সদ্যোজাত কন্যাদের জীবন্ত কবর দিত আরব বেদুইনরা। একই মহিলার নিকট একাধিক পুরুষের গমনের সামাজিক প্রথা প্রচলিত ছিল। জুয়া, মদ্যপান, চুরি-ডাকাতি-লুণ্ঠন, সামাজিক ব্যভিচার ও মাৎস্যন্যায় দশা পুরো আরবকে পূর্ণমাত্রায় গ্রাস করায় সেই যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়া বা চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। আর নবুয়ত লাভের পর হজরত মোহাম্মদ (সা.) নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও অমানুষিক ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে সেই বর্বর-রক্তলিপ্সু-পৌত্তলিক মক্কাবাসীকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দান করলেন। পবিত্র কাবাগৃহ থেকে মূর্তিগুলোকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠালেন এবং পৌত্তলিকতার সমূল উৎপাটন করে বিশ্ববাসীর জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নেতৃত্বে নবদীক্ষিত মুসলমানরা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি সুশৃঙ্খল, পরহিতৈষী, মানবিক ও অতিমানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। মহানবী (সা.) প্রবর্তিত ঐতিহাসিক মদিনা সনদ রাষ্ট্র পরিচালনা, সমর কৌশল, সাম্যবাদ-গণতন্ত্র-ন্যায়বিচার এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দিগ্্দর্শন যন্ত্র বা ম্যাগনাকাটা হিসেবে সমগ্র বিশ্বে অদ্যাবধি স্বীকৃত। ঐতিহাসিক হুদায়বিয়া চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে হজরত মোহাম্মদ (সা.) বিনাযুদ্ধে মক্কা বিজয়ের যে ভিত রচনা করেছিলেন, তা বিশ্ববরেণ্য রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ম্লান করে দেয়। বিনা রক্তপাতে অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর আজন্মের শত্রু মক্কার প্রতিষ্ঠিত পৌত্তলিকদের অকাতরে ক্ষমা করে দিয়ে হজরত মোহাম্মদ (সা.) ক্ষমা ও ঔদার্যের যেই কালোত্তীর্ণ ইতিহাস রচনা করেছিলেন, অদ্যাবধি তার সমকক্ষতা অর্জন বিশ্বের কোনো বিজয়ীর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
দশম হিজরিতে হজরত মোহাম্মদ (সা.) পার্থিব জীবনের অন্তিম হজব্রত পালন করেন। প্রায় ১৪০০ বছর আগে ওই বিদায় হজের ভাষণে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) ১ লাখ ২৫ সহস্রাধিক সমবেত মুসলিম জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন : আমি বিশ্ব মুসলিম তথা তোমাদের পার্থিব সাফল্য এবং পারলৌকিক কল্যাণের জন্য দুটি সুমহান দলিল রেখে যাচ্ছি। এর প্রথমটি হচ্ছে পরম করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ পবিত্র আসমানি কিতাব আল কোরআন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমার জীবনাচরণ-কর্মপদ্ধতি ও বর্ণনা-সংবলিত হাদিসগ্রন্থ। যত দিন পর্যন্ত আমার উম্মতরা এই দুটি মহাগ্রন্থের অবিনশ্বর বাণী ও নির্দেশনা হুবহু অনুকরণ ও অনুসরণ করবে এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবে, তত দিন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো শক্তি তাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। সোয়া লক্ষাধিক হজব্রত পালনকারীর উদ্দেশে হজরত মোহাম্মদ (সা.) আরও বলেছিলেন, তাঁর সেদিনের বাণী অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছে দিতে। বিদায় হজের কালোত্তীর্ণ ও শাশ্বত ভাষণে আখেরি নবী (সা.) আরও বলেছিলেন, বিশ্ব মুসলমানের মধ্যে আরব-অনাব, আশরাফ-আতরাফ, ধনী-নির্ধন, সাদা-কালো ইত্যাদি শ্রেণিবৈষম্য, কোনো ভেদাভেদ নেই। এমনকি একজন কাফ্রি ক্রীতদাসও নেতৃত্বদানের পারঙ্গমতা অর্জন করলে তার নেতৃত্ব বিনা বাক্যব্যয়ে অন্যদের মেনে নিতে হবে। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল (সা.) আরও বলেছিলেন, পুত্রের অপরাধে পিতাকে, পিতার অপরাধে পুত্রকে, ভাইয়ের অপরাধে ভাইকে অপরাধী করা যাবে না এবং একের অপরাধের জন্য অন্যকে বেআইনিভাবে দণ্ডিতও করা যাবে না। সেই বিশেষ দিবসেই পবিত্র আরাফা ময়দানে বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর তরফ থেকে আল কোরআনের সর্বশেষ আয়াত ‘আল ইয়ামো মা আকমালতো লুকুম দ্বিনাকুম, ওয়া আতমামতো আলাইকুম নে’মাতি ওয়া রাজিতু লাকুমাল ইসলামো দ্বীনান’ নাজিল হয়েছিল। তারপর সমবেতদের সমভিব্যাহারে দুই হাত ঊর্ধ্বাকাশে তুলে ধরে আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, হে রাব্বুল আলামিন আমি হয়তো-বা আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। তুমি দয়া করে আমার অক্ষমতাজনিত অপরাধ ও ভুলত্রুটি ক্ষমা করিয়ো। অশ্রুসিক্ত নয়নে ও জলদগম্ভীর কণ্ঠে সোয়া লাখ মুসলিম জনতা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। স্মর্তব্য, পবিত্র কোরআনের সর্বশেষ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর এই ধরাধাম ত্যাগের পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বিষয়টি সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন আখেরি জমানার নবী মোহাম্মদ (সা.) এর সার্বক্ষণিক সঙ্গী, ইসলামের প্রথম খলিফা এবং ইসলামের দাওয়াত সর্বপ্রথম গ্রহণকারী হজরত আবু বকর (রা.)। হজরত আবু বকর (রা.) নিতান্ত শিশুর মতো হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলে উপস্থিত মুসলিম জনতাও গগনবিদারী কান্নায় ভেঙে পড়েন। আরাফার ময়দানে সেদিনকার উপস্থিত মুসলিম জনতার আর্ত-আহাজারিতে সমগ্র মক্কা ও আশপাশের আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল।
যাহোক, একুশ শতকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাহেন্দ্রক্ষণে বর্তমানে বিজ্ঞানমনস্কতা এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে বিশ্বজুড়ে অনবরত পরিবর্তনের ঢেউ খেলে যাচ্ছে। মানুষের জীবনাচরণ, চিন্তা-চেতনা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও সেই পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ফলে শয়তানের প্ররোচনায় কিংবা ব্যক্তিস্বার্থে ভুয়োদর্শী ও প্রাজ্ঞ আলেম-ওলামার ধ্বজাধারীদের মধ্যেও ইসলাম ধর্মের মৌলিক আদর্শ-উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের মতভেদ প্রতিনিয়ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এর বিষময় প্রতিক্রিয়া হিসেবে মহানবীর (সা.) বিদায় হজের ভাষণের মর্মবাণী উপলব্ধি-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও বিশ্ব আলেম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ-বৈষম্য ও মতভেদ তুঙ্গে উঠেছে। অতিমাত্রায় ধর্মবিশারদদের সিংহভাগই স্বার্থের বশে ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন এবং মহানবীর (সা.) হাদিসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। ফলে ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত ও দিগ্্ভ্রান্ত মুসলিম সমাজে বিভেদ-বৈষম্যের নিত্যনতুন জ্বালানি এবং ইন্ধন হু হু করে বাড়ছে। আবার কিছুসংখ্যক অতি উন্নাসিক ওলামা পাণ্ডিত্য জাহিরের খাতিরে অন্যদের কাফের আখ্যায়িত করতেও দ্বিধান্বিত হচ্ছেন না। বর্তমানের ধারা অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে বিশ্ব মুসলিম যে চরম বিভ্রান্তি, বৈষম্য, হানাহানি এবং ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ের নাগ-নাগিনীর সাত প্যাঁচে জড়িয়ে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যাহোক, চরম বিভাজন এবং সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে দেশ ও প্রবাসের মুসলমানদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুসলিম সম্প্রদায় ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার দিবাগত রাত ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে উদ্্যাপন করতে যাচ্ছেন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবারের পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) শান্তির ধর্ম ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ্ব মুসলিমের ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনয়ন করুকÑএই কামনা রইল। সংগত কারণেই উল্লেখ করতে হচ্ছে, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) সহ অন্যান্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানাদি উদ্্যাপন বর্তমানে বিশ্ব মুসলিমের নিকট নিছক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের সজ্ঞান উপেক্ষা কিংবা অজ্ঞতাবশে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে শান্তির ধর্ম ইসলামের শাশ্বত আবেদন এবং ইসলাম ধর্মের মৌলিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য বহুলাংশে নির্বাসনে গেছে। পক্ষান্তরে নবুয়ত লাভের আগেই হজরত মোহাম্মদ (সা.) পাপপঙ্কিল আরব সমাজের যুব সম্প্রদায়কে সংগঠিত করে হিলফুল ফুজুল গঠনপূর্বক সমাজে রক্তপাত বন্ধ করেছিলেন এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছিলেন। ৯২ শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে মাদক সেবনকারী এবং নেশাগ্রস্ত মুসলিম কিশোর গ্যাং সদস্যরা মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা হরণ করছে এবং সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ইসলামের অনুসারী হিসেবে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর ওপর দৈনিক পাঁচবার সময়মতো নামাজ আদায় করা ফরজ হলেও আমরা সজ্ঞানে তা উপেক্ষা করে যাচ্ছি। পরচর্চা বা গিবত মরা ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমতুল্য হলেও পরচর্চা আমাদের শিরা-উপশিরায় দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। হালাল উপায়ে জীবিকার্জন ইবাদতের সমতুল্য হলেও অবৈধ উপায়ে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতায় আমরা মরিয়া হয়ে উঠেছি। ভরণপোষণে মিতব্যয়িতার মাধ্যমে সাশ্রয়কৃত অর্থে গরিবদের সাহায্য-সহযোগিতার প্রবল ধর্মীয় তাগিদ থাকা সত্ত্বেও ভোগবাদী মুসলিম সমাজ ভুরিভোজ ও মুখরোচক খাবার সংগ্রহের পেছনে রাশি রাশি অর্থের শ্রাদ্ধ করছে। ধর্মের বিধান অনুসারে প্রত্যেক মুসলমান পরস্পরের ভাইবোন; অথচ বর্তমানে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের তাজা রক্তের ঢল বইছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ইসলাম ধর্ম গুরুত্বারোপ করলেও বিশ্ব মুসলিম তাতে কর্ণপাত করে না। ছোটকে স্নেহ, বড়কে শ্রদ্ধা, অসহায়কে সাহায্য, পরস্পরের সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের ওপর ইসলাম ধর্ম জোর দেওয়া সত্ত্বেও বর্তমান সমাজব্যবস্থায় তা দুর্বলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম মহিলাদের সম্মান, স্বার্থ ও সম্ভ্রম রক্ষায় দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাব্যুহ হিসেবে আবির্ভূত হলেও বর্তমানে নারী স্বাধীনতার নামে নানা ধরনের অসামাজিকতা মুসলিম সমাজকে গ্রাস করছে। সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি- অন্যায়-ব্যভিচার ইসলাম ধর্মে পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও বর্তমান মুসলিম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যের প্রতি অমূলক বিদ্বেষভাব পোষণ, বাগাড়ম্বরিতা বা অতিকথন, অপরের হক আত্মসাৎ, আমানতের খিয়ানত, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। দুর্ভাগ্যক্রমে আধুনিক মুসলিম সমাজে এসব ব্যভিচারের জোয়ার বইছে।
মোদ্দাকথা, জগৎজুড়ে চলছে মিথ্যা-অন্যায় আর অশান্তির বেসাতি। এদিকে পার্থিব মায়া মরীচিকার হাতছানিতে প্রলুব্ধ হয়ে আমরা অনেকেই দিগ্্বিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো ছুটতে ছুটতে জীবনসায়াহ্নে পৌঁছেছি। আর পুঞ্জীভূত পাপসাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছি। তাই এবারের ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আমরা ধর্মীয় মুমূর্ষু মূল্যবোধকে পুনর্জীবিত করব, আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির পথে এগিয়ে যাব এবং শাশ্বত মৃত্যুর অনুভূতিকে মনের মণিকোঠায় স্থান দেব। নিজের পুঞ্জীভূত অপরাধের জন্য অনুশোচনাগ্রস্তচিত্তে বিশ্বপ্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করব। হে করুণাময় আল্লাহ তায়ালা, এবারের পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে তোমার প্রিয় হাবিব হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অছিলায় আমাদের যাবতীয় অপরাধ মার্জনা করো।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।