একসময় বাংলাদেশের অন্যতম লাভজনক ব্যাংক হিসেবে গণ্য হতো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল)। এস আলম গ্রুপের হাতে যাওয়ার পর এই ব্যাংকটির অস্তিত্ব পড়ে যায় হুমকির মুখে। অভিযোগ ওঠে, ব্যাংকটিকে ধ্বংস করতে নেওয়া হয় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎকালীন সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।
চার বছর আগে পরিকল্পনা, জড়িত তিন গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংকে তৎকালীন শীর্ষ পদে থাকা এক কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, ইসলামী ব্যাংক এস আলমের হাতে যাওয়ার অন্তত চার বছর আগে এটি দখলের পরিকল্পনা নেওয়া হয় আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা জানান, এই কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন গভর্নর। ইসলামী ব্যাংক যাতে সহজেই এস আলম গ্রুপ দখলে নিতে পারে সে জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে করেন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পদে থাকা এস কে সুর চৌধুরী, শুভঙ্কর সাহাসহ হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তা ইসলামী ব্যাংকে জামায়াতমুক্ত করার কাজ করতেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ড. আতিউর রহমান চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে এস আলমের প্রতিনিধির সংখ্যা বেড়ে যায়।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ইসলামী ব্যাংক দখলের নেপথ্যে সরাসরি ভূমিকা রাখার পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংক দখলের মহোৎসবে এস আলম গ্রুপকে উৎসাহ দেন সাবেক গভর্নর ফজলে কবির। তার আমলেই চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ অর্থ লুটে নেওয়া শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই লুটপাটকে বছরের পর বছর সমর্থন করে গেছে। এমনকি এস আলমের পছন্দের লোকদেরই ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ডেপুটি গভর্নরদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাদের দুয়েকজনকে উপদেষ্টা করে রেখে দেওয়া হয় এস আলমের পরামর্শেই। অর্থাৎ এস আলম-বন্দনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি ফ্লোরে চলতে থাকে বছরের পর বছর।
তিনি আরও জানান, ফজলে কবিরের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পদে থাকা হাতে গোনা দুই-একজন ছাড়া বেশিরভাগ কর্মকর্তাই এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। অবসরের পর এস আলমের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবেন— এই আশায়ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যম সারির অনেক কর্মকর্তা এস আলম গ্রুপের সঙ্গে হাত মেলান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র জানায়, সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে ইসলামী ব্যাংক ছাড়া অন্যান্য ব্যাংক থেকেও টাকা বের করে নেয় এস আলম গ্রুপ। এই সময়ে পুরো বাংলাদেশ ব্যাংক এস আলম গ্রুপ-নির্ভর হয়ে পড়ে। এই দুই গভর্নরের (ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ) সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কার্যালয় ও গুলশানে গভর্নরের বাসভবন ‘গভর্নর হাউস’ হয়ে ওঠে এস আলম গ্রুপের মালিক ও কর্মকর্তাদের বিচরণক্ষেত্র।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার সুবাদে টাকা ছাপিয়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে অর্থপাচারে সহায়তা করেন আব্দুর রউফ তালুকদার। এস আলম গ্রুপকে সহায়তা দিতে আব্দুর রউফ তার বাছাই করা কিছু কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এস আলমের বিষেয়ে কোনও পরিদর্শন বা তদন্ত যাতে না হয় সেজন্য এই সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়। এই সিন্ডিকেটের নির্দেশেই বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি এই সিন্ডিকেট এস আলমের হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন, এনবিআর ও আদালতকেও নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।
দখলের সূত্রপাত
শুরুতে অর্থাৎ ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে জামায়াতের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা এই ব্যাংকটিকে বর্জনের ডাক দেওয়া হয়। প্রচার চালানো হয়— ইসলামী ব্যাংক টেরোরিস্ট ফাইন্যান্সিংয়ে জড়িত। সে সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এক বৈঠকে দাবি করেন— ‘ইসলামী ব্যাংকের ৮ শতাংশ অর্থায়নই সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্ট।’ তার এই বক্তব্যের পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকটির ওপর থেকে আস্থা হারাতে থাকে। তখন ব্যাংকটি সরকারের পক্ষ থেকে নিজেদের কব্জায় নেওয়ার পরিকল্পনার কথা তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে জানানো হয়। তখন জামায়াতমুক্ত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে এই ব্যাংকটিকে জাতীয়করণের প্রস্তাব ছিল বিভিন্ন মহলের। বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন, তরিকতপন্থি রাজনৈতিক দলেরও দাবি ছিল— ইসলামী ব্যাংকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, ওই সময় গভর্নর ড. আতিউর রহমান ব্যাংকটিকে জামায়াতমুক্ত করার প্রক্রিয়া কী হতে পারে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন একটি কমিটিকে দায়িত্ব দেন এবং একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলেন। পরে ১০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে ব্যাংকের এমডি আব্দুল মান্নানকে রেখেই সংস্কারের কথা বলা হয়। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এমডি ও ডিএমডি নিয়োগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ করার কথা বলা হয়। অবশ্য কৌশল হিসেবে— তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি তার মেয়াদ বৃদ্ধিরও প্রস্তাব করা হয়।
ওই সময় এস আলম গ্রুপের হাতে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এসকে সুর। তার বিরুদ্ধে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারকে চারটি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা পাচারে সহযোগিতা করার অভিযোগও আছে। এই রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সম্পূর্ণ মালিকানা পরে এস আলম গ্রুপের হাতে চলে আসে।
টোপ দেওয়া হয় আব্দুল মান্নানকে
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, ইসলামী ব্যাংককে জামায়াতমুক্ত করতে এমডি আবদুল মান্নানকে রাজি করানো হয় তার বেতন ও মেয়াদ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। আবদুল মান্নান তাতে সায় দেন। এছাড়া সাধারণ কর্মকর্তাদের বিদ্রোহ ঠেকাতে সবার ২০ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়।
সূত্র জানায়, ড. আতিউর রহমান ও আব্দুল মান্নানের জন্মস্থান একই এলাকায় হওয়ায় উভয়ের মধ্যে একটি আঞ্চলিক ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং আব্দুল মান্নান নিজের চাকরি বাঁচাতে সক্ষম হন। ড. আতিউর রহমান ২০১৪ সাল থেকে পর্যাক্রমে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে জামায়াতমুক্ত করার উদ্যোগ নেন। এরপর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ওপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। ব্যাংকের দ্বিতীয় পর্যায়ের শীর্ষ নির্বাহী উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নিয়োগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়। ২০১৫ সালে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ব্যাংকের একজন ডিএমডিকেও সরিয়ে দেয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার জন্য কোনও নীতিমালা ছিল না। আমি ২০১১ সালে নীতিমালা করে দিয়েছি। এর ফলে আমার সময়ে ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে ভালো ব্যাংক ছিল। আমার সময়ে এসএমই ও কৃষিতে ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে ভালো করেছে। তখন যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের ভালোর জন্যই করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি যা করেছি, তৎকালীন এমডি আব্দুল মান্নানের সঙ্গে পরামর্শ করেই করেছি। আমার সময়ে এস আলম ঢুকতে পারেননি।’
আরেকটি সূত্র জানায়, সরকার যখন ব্যাংকটিকে জামায়াতমুক্ত করে দখলের পরিকল্পনা নেয়, তখন আব্দুল মান্নান তুলনামূলক কম ক্ষতির কথা বিবেচনা করে এবং জামায়াত ঘরানার মনে করে বড় গ্রাহক এস আলম গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক দখলে নেওয়ার সুযোগ করে দেন। শুধু তাই নয়, তখন এস আলমের ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচিত মাহবুব আলম, জাফর আলম, মনিরুল মাওলাসহ বেশকিছু কর্মকর্তাকে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আতিউর রহমান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছেড়ে চলে যাওয়ার পর গভর্নর হিসেবে যোগ দেন ফজলে কবির। তিনি এসেই শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তথা ইসলামী ব্যাংককে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার কাজে বেশি মনোযোগ দেন। সূত্র জানায়, ফজলে কবিরকে গভর্নর পদে বসানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি এস আলমকে ইসলামী ব্যাংক দখলের পথ দেখিয়ে দেন। অবশ্য শুরুতে নিজেও দখলের অংশীদার হন। ২০১৬ সালে বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং শাইনপুকুর সিরামিকস লিমিটেডের সিইও মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নতুন যোগ দেন। ব্যাংকটিতে এস আলম গ্রুপের ঋণ থাকায় আলোচনায় আসে বেক্সিমকো গ্রুপের নাম। পরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে এস আলম গ্রুপই ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ব্যাংকপাড়ায় তখন গুঞ্জন ওঠে সালমান এফ রহমান ও এস আলমের তদবিরেই ফজলে কবির গভর্নর হয়েছিলেন।
ইসলামী ব্যাংক-বিদ্বেষী ব্যক্তি আসেন পর্ষদে
ফজলে কবির গভর্নর হওয়ার দেড় মাসের মাথায় বিতর্কিত ও ইসলামী ব্যাংক-বিদ্বেষী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালসহ চার জনকে ব্যাংকটির পর্ষদে বসানো হয়। এই সামীম আফজাল ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে একটি বই লেখেন।
জামায়াতমুক্ত করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় নতুন স্বতন্ত্র চার পরিচালককে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর চার মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে ব্যাংকটিতে কর্মরত জামায়াতের নেতাকর্মীদের বেতন ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়। এছাড়া মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে দেয় নতুন পর্ষদ। এতে এমডি আব্দুল মান্নানের পাশাপাশি সাধারণ কর্মকর্তারাও ওই সময় খুশি হন ও পরিবর্তনকে স্বাগত জানান।
অবশ্য ভেতরে ভেতরে জামায়াতন্থিদের গোল্ডেন হ্যান্ড শেকের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। রদবদল করা হয় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ছাড়া বাকি শীর্ষ পদগুলোতেও।
এরপর থেকে পরিচালনা পর্ষদ একদিকে ফাঁকা হতে থাকে, অপরদিকে সরাসরি তৎকালীন সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পাঠানো তালিকা অনুযায়ী নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়।
অবশ্য নতুন নিয়োগ পাওয়া পরিচালকদের একজন— ব্যাংকের অডিট বা নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলো নিয়ে শত শত আপত্তি তুলতে থাকেন। অভিযোগ করা হচ্ছে, এসবই ছিল ব্যাংক দখলের ভিত্তি তৈরির প্রস্তুতি।
এছাড়া ২০১৬ সালজুড়ে অস্তিত্বহীন বা শুধু কাগজে-কলমে আছে এমন নতুন নিবন্ধিত কিছু কোম্পানি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কেনা শুরু করে। এসব কোম্পানির রেজিস্ট্রেশনই ২০১৬ সালে নেওয়া হয়েছিল। কোম্পানিগুলোর প্রকৃত মালিক আসলে এস আলম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে— এক্সেল ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেড, আরমাডা স্পিনিং মিল লিমিটেড, এবিসি ভেঞ্চার্স লিমিটেড, গ্রান্ড বিজনেস লিমিটেড, প্ল্যাটিনাম এন্ডেভারস, প্যারাডাইজ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং ব্লু ইন্টারন্যাশনাল।
পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে নেওয়ার পর ইসলামী ব্যাংকের ২০ শতাংশ শেয়ার চলে আসে এস আলমের হাতে। এছাড়া ফলে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে ‘অপ্রতিরোধ্য ক্রীড়নক’। পরে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ক্ষমতা ও রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এভাবেই টানা ৩৪ বছর জামায়াতের করায়ত্তে থাকার পর ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি পুরোপুরি বদলে যায় ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ও পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আনোয়ারকে সরিয়ে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয় সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে। এমডি পদে বসানো হয় ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আব্দুল হামিদ মিঞাকে। অভিযোগ আছে, ওই দিন পরীবাগের বাসা থেকে আবদুল মান্নানকে তুলে নিয়ে যায় সরকারের একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা। একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে আনা হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকেও। এরপর তাদের জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়।
এই বিষয়টি তুলে ধরে সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ওই দিন (৫ জানুয়ারি, ২০১৭) অনেক রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা অফিস করেছেন। তারা ওই দিনই ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করতে কাজ করেছেন।
২০১৭ সালে মালিকানা পরিবর্তনের কিছুদিন পর জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ব্যাংকের ১৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা করে তাদের বিদায় করে দেওয়া হয়। তখন থেকেই নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি থেকে টাকা বের করা শুরু করে, আর এই টাকার একটি অংশ পাচার করে দেওয়া হয় বিদেশে। এক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা নেওয়া হয়।
সূত্রের দাবি, ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা বের করার প্রবণতা অব্যাহত রাখতে ফজলে কবিরের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর বিল সংসদে পাস করানো হয়। ওই সময় এই ঘটনাকে অনেকেই ‘বিরল ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফজলে কবিরের মেয়াদে ইসলামী ব্যাংকের টাকা অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায় এস আলম। শুধু তাই নয়, টাকা সরানোর সুযোগ করে দিতে ফজলে কবির এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম বদলে ‘গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক’ ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের নাম পরিবর্তন করে ‘আভিভা ফাইন্যান্স’ রাখা হয়। এর মধ্যে আভিভা ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান ছিলেন স্বয়ং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন বিশেষ বিবেচনায় ব্যাংক দুটিকে ‘ইসলামী’ বানিয়ে দেয়। দুই নথিতেই সই করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির। এরপর ইসলামী ব্যাংক থেকে এই দুটি প্রতিষ্ঠানে টাকা নেওয়ার দরজা খুলে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৮ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা আটকা আছে।
২০২২ সালের জুলাই ফজলে কবিরের মেয়াদ শেষ হলে এস আলমের ‘পছন্দের তালিকায় থাকা’ আব্দুর রউফ তালুকদারকে ৪ জুলাই বসানো হয় গভর্নর হিসেবে। সূত্রের দাবি, আবদুর রউফ তালুকদারের তত্ত্বাবধানে চলতে থাকে এস আলমের সুদ মওকুফ ও ঋণ জালিয়াতির ঘটনা। এছাড়াও ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা বের করার ঘটনায় পলাতক আব্দুর রউফ তালুকদারের বিরুদ্ধে ডলার কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। এই গভর্নর পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে এস আলমকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লুটতে সহায়তা করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৪৫০ মিলিয়ন ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে না দিয়েই ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে এস আলমের হাতে ৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযোগ উঠেছে— এর ফলে শেষ পর্যন্ত লাভবান হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন নিয়ন্ত্রক বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার অভিযোগ— সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ইসলামী ব্যাংককে সুযোগ করে দিতে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এই ঘটনাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এই টাকা সমন্বয় করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথি অনুসারে, আবদুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে চলতি বছরের ৩ জুলাই ৫৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ইসলামী ব্যাংকে ৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাস্তবে জমা না হলেও কাগজে-কলমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভে যোগ দেখানো হয় ৫৫০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন প্রতি ডলার কিনেছে ১১৮ টাকা দরে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই শেষে রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১১ আগস্ট বাকি ৪৫০ মিলিয়ন ডলার সমন্বয়ের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ। এতে ইসলামী ব্যাংকের চলতি হিসাব থেকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ৫ হাজার ৩১০ কোটি টাকা কেটে নেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক গভর্নর রউফ তালুকদারের নির্দেশনা মেনে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিগুলো করা হয়েছিল। পাওনা পরিশোধ না করায় এরইমধ্যে ইসলামী ব্যাংককে তিন মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছে।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপ দখলে নেওয়ার পর থেকে ঘুরে-ফিরে ওই গ্রুপের পকেটেই সব ঋণ গেছে। গ্রুপটি বেআইনিভাবে নামে-বেনামে বেশিরভাগ ঋণ নিয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসের শেষে ইসলামী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ একাই নিয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। তবে ইসলামী ব্যাংকের সদ্য নিযুক্ত চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ জানিয়েছেন, ব্যাংকটি ঋণ হিসেবে যত অর্থ বিতরণ করেছে— তার অর্ধেকের বেশি টাকা একাই নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। তিনি বলেন, ‘এসব ঋণের পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনও বের করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিয়ম না মেনেই ব্যাংকটির অর্থ লুটপাট করেছে চট্টগ্রামের গ্রুপটি। এস আলমের ঋণের বিপরীতে যেসব সম্পদ বন্ধক রাখা আছে তারও পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। কারণ এসব সম্পদের দাম বেশি দেখিয়ে ঋণ বের করা হয়েছে। এর ফলে ২০২২ সাল থেকে ব্যাংকে তারল্য সংকট শুরু হয়।’
সব নিয়োগ জামায়াত আদর্শের বাইরে
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের পর নতুন যে কয় জন পরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের সবাই জামায়াত আদর্শের বাইরের লোক। ২০১৫ সালের জুন মাসে পরিবর্তন আনা হয় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদে। জামায়াত নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ জাহেরকে ব্যাংকটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বতস্ত্র পরিচালক ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এনআরএম বোরহান উদ্দিনকে ব্যাংক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এরপর পরিচালনা পর্ষদ থেকে বিদায় নেন অধ্যাপক ড. একে এম সদরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, মো.আবদুস সালাম, হুমায়ুন বখতিয়ার, ইঞ্জিনিয়ার ইস্কান্দার আলী, ড. আবদুল হামিদ ফুয়াদ আল খতিব, মো. আবুল হোসাইন, নাসের আহমদ আল খোন্দকার এবং এএইচজি মহিউদ্দিন। এই পরিচালকদের সরিয়ে বসানো হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম, পূবালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হেলাল আহমদ চৌধুরী ও এম আযিযুল হককে। যদিও শেষ পর্যন্ত এম আযিযুল হককেও সরিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেন বিডিবিএলের সাবেক এমডি জিল্লুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি আবদুল মাবুদ, অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. কাজী শহিদুল আলম ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের সদস্য বোরহান উদ্দিন আহমেদ। একইভাবে নিয়োগ পান মেজর জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মতিন, মো. সাইফুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল করিম, আইনজীবী মিজানুর রহমান, রূপালী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি জয়নাল আবেদীন। এস আলমের পক্ষে ব্যাংকটির পর্ষদে বসানো হয়— বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকেও। চট্টগ্রামের জেএমসি বিল্ডার্সের পক্ষে ২০১৭ সালের জুনে তিনি ব্যাংকটির পরিচালক নিযুক্ত হন এবং রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। আর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম।
‘ব্যাংক চুরির একটা মডেল’
ইসলামী ব্যাংক দখলের মধ্যে দিয়ে এস আলমকে ধারাবাহিকভাবে অপরাধ করতে দেওয়ার এই ঘটনা পৃথিবীতে ‘ব্যাংক চুরির একটা মডেল’ বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এস আলম ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি, যিনি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ব্যাংক ডাকাতি করেছেন। এত সুপরিকল্পিতভাবে ও বিস্তৃত আকারে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে পদ্ধতিগতভাবে (সিস্টেমেটিক ওয়েতে) ব্যাংক লুটের ঘটনা এটাই প্রথম। ব্যাংক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে জনগণের টাকা বের করে নেওয়ার এমন ঘটনা পৃথিবীর কোথাও নেই।
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের দুজনের কারোরই বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ঠিকানা/এসআর