মেয়েটি মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। রাত জেগে Study করে। মাঝে মধ্যে বেলকুনিতে দাঁড়ায়। কিছুটা সময় বিশ্রাম নেয়। রাস্তার অপর পার্শ্বে একটি লোক দাঁড়িয়ে থাকে। বয়স ৩০-৩৫ বছর। চব্বিশ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। সময় ও সুযোগ পেলেই মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে থাকে। মেয়েটিও গভীরভাবে লক্ষ্য করে- সে কি দেখছে। বুঝতে পারে তাকেই দেখছে। বিব্রত হয়। বাবাকে জানায়। লোকটির বড় ভাই শাসিয়ে যায়। এভাবে নি-চারবার এমন ঘটনাই ঘটছে।
একসময় মেয়েটি মেডিকেলের পাঠ সমাপ্ত করে এবং ডাক্তার হয়। বাবা-মা বিয়ে দেন। স্বামীর সঙ্গে কানাডা চলে যায়।
বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। একদিন সকালে অফিসে যাচ্ছেন- লোকটিকে দেখতে পান।
জানতে চান- আপনার কী সমস্যা বলেন তো? আমার গাড়িতে উঠুন। আপনার কথা শুনব। দু’জনে একটি রেস্টুরেন্টে বসেন। আপনি এখনো কেন এখানে দাঁড়িয়ে? আপনার কোনো কষ্ট হয় না।
আমি আপনার মেয়েকে খুব পছন্দ করি। কিন্তু সে কি আপনাকে পছন্দ করে? তার বিয়ে হয়ে গেছে। সে কানাডা চলে গেছে।
আমি জানি! আমার শক্তি ও সাহস নেই; কিন্তু একদিন সে আসবে। তখন তারও কষ্ট হবে। আর দু’জনের কষ্ট যখন এক রকম হয়- তখন ভাবনাও এক হবে। ভদ্রলোক আশ্চর্য হয়ে বলেন- আপনি তো আমার মেয়েটির সর্বনাশ করবেন? শুনুন আমার মেয়ে কোনো দিনও কানাডা থেকে আসবে না।
এমনটি স্যার বলবেন না।
আমি তার ভালো চাই। কিন্তু একদিন সে আসবেই। শুনুন। আপনি কষ্টই পেতে থাকুন। বুঝলেন।
জ্বী স্যার। দোয়া করবেন। ইনশাআল্লাহ খোদা হাফেজ স্যার।
পাঁচ বছর পর এক উইকন্ডে ডা. পিংকী (মেয়েটির নাম) স্বামী-সন্তানসহ লং ড্রাইভিংয়ে বের হন। পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে। পিংকীর স্বামী প্রাণ হারান।
বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে। দেশে ফিরেন। জানতে পারেন সেই লোকটি মানসিক হসপিটালে আছেন। ঠিকানা- নাম সব সংগ্রহ করে। বন্ধু-বান্ধবী, কলিগ সঙ্গে মেডিকেল টিম গঠন হয়। সবার সঙ্গে একদিন পিংকীও উপস্থিত। লোকটিকে নিয়ে আসা হয়। পিংকী শুরু করে- আপনার জন্য আমি কানাডা থেকে এসেছি।
লোকটি উত্তর করে- আমি জানি। পিংকী নিজের পেশা থেকে শুরু করে- আচ্ছা বেশ আপনি দিনের পর দিন- বছরের পর বছর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকেন?
লোকটি চারদিকে তাকান। কোনো দ্বিধা রাখেন না। বলা শুরু করেন-সত্যি ঘটনাটি বলতে আজ আমার আনন্দ লাগছে। প্রতিবেশী চাচার মেয়ে কাননের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়। চাচা আমার দারিদ্র্যতা মেনে নেয়নি। কাননকে জোর করে অন্য কোথাও বিয়ে দেন। শ্বশুরবাড়িতে কানন একটি দিনও সুখ পায়নি। পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়।
খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। আমরা সবাই দুঃখিতÑ মেডিকেল টিমের ভাষ্য।
একজন ডাক্তার বলেনÑ কিন্তু আপনি চাইলেই তো সরে যেতে পারেন। বছরের পর বছর এখানে দাঁড়িয়ে কেন? একটা কাজে নেমে পড়ুন। ভবিষ্যৎ দেখতে পাবেন।
লোকটি বলেনÑ না পারি না। কানন দেখতে অবিকল পিংকীর মতন! আমার কাজে মন বসে না।
পিংকী ভাবেনÑ ডাক্তার হিসেবে মানুষের অনেক কষ্ট বুঝতে হয়। দু’দিন বাদে চলে যাচ্ছি তখনও কি আপনার কষ্ট হবে?
তোমাকে দেখার পর মনে হলো সব কষ্ট শেষ।
আর এখন?
কথা বলার পর মনে হলো তোমার বাবার কথাই ঠিক।
পিংকী বলে- সে কী রকম?
লোকটি জানায়- আমি শুধু কষ্টই পেতে থাকব। নতুন করে কষ্ট শুরু হয়েছে।
কারণ?
কারণ এখন তুমি একজন উইডো। উপস্থিত ডাক্তাররা বিব্রত হন। লোকটিকে তখনই সেখানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলে। লোকটি ইশারা করে- আমি শেষ কথাটি বলে যেতে চাই-
পিংকী শব্দ করে কেঁদে উঠে। লোকটি কি করে মানুষের মুখের ভাষা বুঝতে পারে? লোকটি কি আমার দুঃসময়ের কথা জেনে গেছে?
লোকটিকে আবার বসানো হয়।
কোনো বাবনা না রেখেই বলে যায়-
পিংকী। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না। মন খারাপ করো না। একদিন সবঠিক হয়ে যাবে। তোমার মেয়ে একদিন অনেক বড় ডাক্তার হবে।
মেডিকেল টিম কোনো শব্দ উচ্চারণ করছে না। লোকটির কথা শুনছে। বিশ্বাস কর পিংকী আমার চিন্তাচেতনায় আমি একজন বিশুদ্ধ মানুষ।
তৎক্ষণিক মেডিকেল বোর্ড ডিসিশন নেয়- লোকটি সম্পূর্ণ সুস্থ এখনই তার পরিবারকে ডাকা হবে। ডা. পিংকী লোকটিকে দৃষ্টির সীমানায় রাখে- কিছুক্ষণ পরেই পিংকীর চলে যেতে হবে। কিন্তু লোকটি চোখের জলে কথা বলছে। কোথায় যেন তার জন্য মায়া পড়ে গেছে।
ডা. পিংকী নিজেকেই প্রশ্ন করে- কোন মেঘের সে মায়া??
শামীম আরা ডোরা
ঢাবি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের
প্রাক্তন শিক্ষার্থী নিউইয়র্ক প্রবাসী
ফরমার অ্যাসিট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশ।