দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সমমনা দল ও জোটকে নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন করেছে বিএনপি। সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নিয়মিতই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল দলটির। এবারও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় দুই দলের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে দুই দলের মধ্যে একধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর একধরনের মানসিক চাপ তৈরি করতে চাইলেও এ নিয়ে জামায়াত বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই দলের মধ্যে যোগাযোগ অনেকটা সীমিত হয়ে আসছে বলেও ধারণা করছেন অনেকে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট দেশের দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপির পক্ষ থেকে এই সরকারকে স্বাগত জানানো হলেও গত ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকায় পরদিন ২৬ আগস্ট বিএনপির পক্ষ থেকে একধরনের আক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছে। এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তাদের প্রত্যাশা ছিল ড. ইউনূস নির্বাচন নিয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের কথা বলছে, সে প্রসঙ্গে সেদিন তিনি মন্তব্য করেন, ‘অল্প কিছু মানুষের সংস্কারে তিনি বিশ্বাস করেন না।’
‘কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়’-জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, ‘এখনো একটা জিনিস ধোঁয়াশা, যেটা আমার পরিষ্কার হয়নি। যেটা আমি আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা একটা রোডম্যাপ দেবেন, গণতন্ত্রের পথে কীভাবে যাবেন, কিন্তু আমরা পাইনি। সংস্কারের কথা বলেছেন, কিন্তু কোন কোন খাতে সংস্কার আনবেন, সে ব্যাপারে কিছু আভাস দিয়েছেন। আমি জানি, এত অল্প সময়ে সেটা সম্ভব নয়। তার পরও একটা ধারণা দিলে ধারণা করতে পারতাম যে ভালোর দিকে যাচ্ছে।’
জামায়াতের সঙ্গে জোট প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৯ আগস্ট একটি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে এই মুহূর্তে আমরা আর জোটবদ্ধ নাই। আমাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট, সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে। এটা এখন কোনো কাজ করে না।’
মির্জা ফখরুল ছাড়াও দেশকে আবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফেরাতে দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
অন্যদিকে জামায়াত প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। সরকারকে সময় দিতে চায় দলটি। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন অবস্থান প্রসঙ্গে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বিএনপি নির্বাচনের জন্য তোড়জোড় করছে। আমরা এই মুহূর্তে নির্বাচনকে প্রাধান্য দিচ্ছি না। এ সময় জাতির ক্রাইসিস চলছে। বিভিন্ন জেলা বন্যার কবলে পড়েছে। এটাকে আমরা এই মুহূর্তের রাজনীতি হিসেবে নিয়েছি। আমরা মনে করি, এ বিষয়গুলো সমাধান না করে নির্বাচনের কথা তোলা যৌক্তিক নয়। তাই আমরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি না। মানুষের এ বিষয়গুলো সমাধান করার জন্য আল্লাহ আমাদের যতটুকু সামর্থ্য দিয়েছেন, সেটুকু চেষ্টা করে যাব।
জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থানের সমালোচনা করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু গত ৩০ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক সমাবেশে বলেন, কেউ কেউ বলছেন বন্যায় ভাসছি, আবার এখন নির্বাচনের দরকার কী? যারা যেমন, তারা তেমনই কথা বলবেন। কিছু মানুষ আছে, কিছু দল আছে, আমাদের সঙ্গে থাকলেও ১৯টা সিট পায়, আমাদের থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে ৩টা সিট পায়, তারা তো ভোটকে ভয় পাবেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
একই দিন নরসিংদী শিশু একাডেমি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বাস্তবে কোনো দলীয় জোট নেই। তিনি আরও বলেন, গত আন্দোলনে বিএনপি থেকে জোট না থাকার ঘোষণা দিয়েছেন তাদের দলীয় নেতারা। তাই তাদের সঙ্গে এখন আমাদের কোনো দলীয় জোট নেই। তবে পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় আছে, থাকবে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এটা দল রক্ষা করে চলবে। তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বসা হয় এবং দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক দীর্ঘ সময়ের। একসঙ্গে জোট বেঁধে আন্দোলন ও নির্বাচন সবই তারা করেছে। বিএনপি ও জামায়াত জোট একবার সরকারও গঠন করেছে। সেই সরকারে জামায়াতের নেতারা মন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তারা এখন দুই ভুবনের বাসিন্দা হতে চলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে দুই দলের মধ্যে মতের মিল থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থান করছে বিএনপি-জামায়াত।