অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দুই উপদেষ্টা রাজনৈতিক দল গঠনের কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে বলেও জানা যায়। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে তারা উল্লেখ করেন। ড. ইউনূস গতানুগতিক রাজনীতির বিপরীতে নতুন ধারার রাজনীতি গড়ে তুলতে গভীরভাবে আগ্রহী। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তবে সুবিধা করতে পারেননি। এখন নিজে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে নীতি-আদর্শভিত্তিক দল গঠনে উদ্যোগী হতে পারেন বলে অনেকে মনে করেন। কোটা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া তারই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।
নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শভিত্তিক নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় উদ্যোক্তারা সারা দেশ থেকেই ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়ার আশা করছেন। বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই দলই দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেছে। তাদের দলগত ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের স্বল্প সংখ্যক নৈতিক ও আদর্শবাদী থাকলেও শীর্ষস্থানীয় ও নেতৃস্থানীয় অনেকের মধ্যে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বার্থবাদিতা, অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ-সম্পদ গড়া, বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, বিদেশে সম্পদ ও বাড়িঘরের মালিক হওয়ার মানসিকতা ছিল। তাদের মধ্যে দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের আন্তরিক প্রয়াস ছিল না। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের স্বার্থ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কার্যক্রম লক্ষণীয় ছিল না। বড় দুই দল নিয়ে দেশবাসীর বৃহত্তর অংশেরই অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। যদিও ক্ষমতাপ্রত্যাশী ও সদ্য ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এ অবস্থাটা স্বীকার করছেন না। তাদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, ব্যর্থতা স্বীকার করে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে পথচলার কথা বলছেন না, সে রকম ভাবছেনও না। এতে কর্মীদের ছাড়া ভুক্তভোগী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অবশ্য এ ব্যাপারে তাদের খুব একটা ভ্রুক্ষেপ আছে বলেও মনে হয় না। দেশের মানুষ সামনের নির্বাচনে তাদেরই বেছে নেবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা যে তা নয়, সময়ের বিবর্তনে, অভিজ্ঞতার আলোকে রাজনীতি সচেতনরাসহ দেশের মানুষ গতানুগতিক জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা-বিবর্জিত দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিতে আর ফিরে যেতে আগ্রহী নয়, তা তারা বিবেচনায় নিতে চান না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত। দলের সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি, দলের কেন্দ্রীয় থেকে নিয়ে জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদেরও অনেকেই আত্মগোপনে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। বিএনপির নেতারা নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থায় মনে করলেও প্রকৃত অবস্থা যে তা নয়, দলটির নেতারা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। দলটির একশ্রেণির নেতাকর্মীর দখলবাজি, চাঁদাবাজি, অনৈতিক কার্যকলাপ সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করছে।
এ অবস্থার বিপরীতে নতুন ধারার রাজনীতির ব্যাপারে দেশের মানুষের আগ্রহ বেড়েছে, যা সম্বল করে পথ চলতে সচেষ্ট তরুণেরা। দেশব্যাপী তাদের ছড়িয়ে রয়েছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা, তাদের পক্ষে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও রয়েছে।
বিএনপি গভীরভাবে আস্থাশীল, প্রায় ২০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে নির্যাতিত হওয়া দলটিকে দেশের মানুষ আবার সেবা করার সুযোগ দেবে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে মনে করেন, বিভিন্ন ভুলভ্রান্তি হলেও দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠনকে বিস্মৃত হবে না। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, দুই বড় দলের বড় বড় রাজনীতিবিদদের আগামী দিনের রাজনীতিতে কোনো অবস্থান না-ও থাকতে পারে। ক্ষমতার পটপরিবর্তন তাদেরকে পথহারা করে দিয়েছে। দুই দলেই একক, স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্বের সামনে ত্যাগী রাজনীতিবিদেরা ছিলেন অসহায়। এদের বিপরীতে তরুণদের প্রাধান্য ও নেতৃত্বে নতুন যে দল গড়ে উঠতে যাচ্ছে, তাদের সামনে পুরোনোদের অবস্থান কী দাঁড়ায়, তা পর্যবেক্ষণ-সাপেক্ষ। বিএনপি-আওয়ামী লীগ উভয়কেই সামনে অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।