চারদিকে শুধু পানি। তলিয়ে গেছে বাড়িঘর। বানের পানিতে ভেসে যাচ্ছে গৃহপালিত পশু, আসবাবপত্র। নারী-শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের চেষ্টা আর আর্তনাদ বানভাসিদের। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় এই পরিস্থিতি চলছে মৌলভীবাজার থেকে শুরু করে হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়িসহ দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ভারত সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর বিস্তীর্ণ এলাকায়।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়া ফেনীর জেলা সদরও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ফেনী শহরের সবচেয়ে উঁচু এলাকা ট্রাংক রোডে বুকসমান পানি উঠেছে। বৃহস্পতিবার নতুন করে প্লাবিত হয়েছে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ির অনেক এলাকা। সব মিলিয়ে অন্তত ১০ জেলায় বন্যায় ৩৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বন্যা নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়েছে। এতে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সব উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ায় উপদ্রুত এলাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কের কিছু অংশেও পানি উঠেছে। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক মিলছে না বন্যাকবলিত এলাকায়। প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না বহু মানুষ। বন্যায় বন্ধ হয়ে গেছে আখাউড়া স্থলবন্দর। প্রয়োজনের তুলনায় উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন দুর্গত এলাকার মানুষ।
এর মধ্যেই আবহাওয়া অধিদপ্তর আরও দুঃসংবাদ দিয়েছে। বৃহস্পতিবার ভারী বর্ষণের সতর্কবার্তাতে অধিদপ্তর বলেছে, পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। এতে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধসের ঘটনা ঘটতে পারে।
সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলে প্রবল বন্যা দেখা দেয়। বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে সেখানে। সেখানকার গোমতী নদীর পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৩১ বছর পর মধ্য ত্রিপুরার ধলাই জেলার বিশাল জলাধার ডুম্বুরের (৪১ বর্গকিলোমিটার) ‘স্ল্যাপ গেটের’ তিনটি গেটের একটি খুলে দেওয়া হয়। এর জেরে গোমতীর বাংলাদেশ অংশ ও আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়।
বিশেষ করে কুমিল্লা ও ফেনীর মানুষ বলছেন, গত ৩৬ বছরে এমন বন্যা তারা দেখেননি। কুমিল্লায় পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে বাঁধ ভেঙে পড়ার শঙ্কায় মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই মধ্যরাতে গোমতীপাড়ে পাহারায় ছিলেন স্থানীয়রা। টর্চ ও মশাল হাতে, মোবাইল ফোনের আলো জেলে আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন তারা। সবার মনে শঙ্কা, এই বুঝি পানির তোড়ে গোমতী বাঁধ ভেঙে পড়ল। মূলত কুমিল্লা সদর থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার গোমতী বাঁধের দুর্বল অংশ নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে বেশি। বাঁধের দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত অংশে স্থানীয়রা নিজ উদ্যোগেই বালুর বস্তা ফেলছেন।
এদিকে ফেনী কবলিত হয়েছে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায়। বিশেষ করে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরামের অবস্থা বেশি খারাপ। এসব উপজেলার পৌর শহরগুলোও প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী কয়েক লাখ মানুষ। এমনকি ফেনী শহরেও কোনো কোনো বাড়ির নিচতলা প্রায় পুরোটা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেতে সোনাগাজী উপজেলার বড় ফেনী নদীর মুহুরী রেগুলেটরের ৪০টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, পানির তোড়ে ভেঙে গেছে অনেক রাস্তা, বাঁধ ও সেতু।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, মুহুরী ও ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এর মধ্যে মুহুরীর পানি গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে।
নোয়াখালীতেও একই অবস্থা। সদর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, চাটখিল ও সুবর্ণচর উপজেলায় বৃহস্পতিবার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, এই আট উপজেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী।
টানা বর্ষণ ও মেঘনার জোয়ারে লক্ষ্মীপুরে প্রায় ৬ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। এই জেলার চারটি পৌরসভা ও পাঁচটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে রামগতির প্রায় ৪০টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। বাসাবাড়িতে পানি ওঠায় জ্বলছে না চুলা।
এদিকে কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পানি ঢুকে পড়াসহ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে এসব জেলার অনেক এলাকাই এখন বিদ্যুৎহীন। এমনকি মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও বিঘ্নিত হচ্ছে কোথাও কোথাও। বিশেষ করে ফেনী ও নোয়াখালীর বেশ কিছু এলাকায় কার্যত টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ এই অঞ্চলের মানুষ এবার নিয়ে তিন মাসে তিনবার বন্যাকবলিত হয়েছে। গত জুনের শেষ দিকে প্রথম দফায়, জুলাইয়ে দ্বিতীয় দফায় এই অঞ্চল প্লাবিত হয়। দ্বিতীয় দফার পানি এখনো পুরোপুরি নামেনি। তার মধ্যেই তৃতীয় দফা বন্যা হানা দিয়েছে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে প্রায় ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বেড়েই চলেছে কুশিয়ারার পানি। হবিগঞ্জে খোয়াই নদের পানি বিপৎসীমার প্রায় ২০০ সেমি ওপর দিয়ে বইছে। বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে কালনী নদীর পানিও।
মৌলভীবাজারে পানিবন্দী ৩ লাখ মানুষ। বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, রাজনগর, সদর উপজেলায় অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের হাওরে খোয়াই নদীর পানি হু হু করে ঢুকছে। এতে অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন উপজেলায় বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, চকবাজার, বাকলিয়া, ডিসি রোড, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় গতকাল হাঁটুপানি ছিল; কোথাও কোথাও কোমরসমান পানি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই ও ফটিকছড়িতে প্রায় এক লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে।
ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির পাঁচটি ইউনয়ন এবং কক্সবাজারের রামুর চার ইউনিয়নের এক লাখের বেশি মানুষ এখন পানিবন্দী। রামুতে পানির তোড়ে ভেসে দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিখোঁজ রয়েছেন দুজন।
খাগড়াছড়িতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চেঙ্গী ও মাইনী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। জেলার অন্তত ৫০টি গ্রামের বাসিন্দা পানিবন্দী। এ নিয়ে গত দুই মাসে চারবার বন্যার কবলে পড়ল পার্বত্য জেলাটি। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, খাগড়াছড়ি সদরের ১৮টি এবং জেলায় মোট ৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
রাঙামাটিতেও কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। টানা বৃষ্টিতে জেলার তিনটি সড়কের ২১টি স্থানে ছোট-বড় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড়ধসের শঙ্কায় স্থানীয়দের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করছে প্রশাসন।
বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোয় প্রশাসনের পাশাপাশি উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবি। স্বেচ্ছাসেবকেরাও আছেন মাঠে। খাগড়াছড়িতে বন্যায় আটকে পড়া শতাধিক মানুষকে নৌকায় করে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। এ ছাড়া উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে ত্রাণ তৎপরতাও চালানো হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
ঠিকানা/এনআই
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 ঠিকানা অনলাইন
 ঠিকানা অনলাইন  
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
