তীব্র সমালোচনা হচ্ছে জনস্রোতে ভেঙে পড়া স্থাপনা নিয়ে, ভেঙে পড়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে। ৫ আগস্টের প্রবল জনঝড়ে তুলোর মতো উড়ে গেল দম্ভের সিংহাসন, সেই ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেল গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এখানেই শেষ নয়, গণভবনে লুটপাট হলো, শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন, যেটি পরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর হিসেবে একটি নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সেটিও পুড়ে ছাই। এরপর শ্রদ্ধা জানাতে আসা কাদের সিদ্দিকীকে ফিরিয়ে দিয়ে তার গাড়ি ভাঙচুর করা হলো, অভিনয়শিল্পী রোকেয়া প্রাচীকে লাঞ্ছিত করা হলো, ৩২ নম্বরের সামনে ১৫ আগস্টের রাতে হিন্দি গান ‘লুঙ্গি ড্যান্স’ বাজিয়ে নৃত্য করে শোকের আবহকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হলো। সবার প্রশ্ন, এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম? যমুনা টিভিতে এসব বিষয় নিয়ে টক শো হলো, যার শিরোনাম ‘লাউ আর কদুর পার্থক্য’। অর্থাৎ আমরা কি এক দৈত্যকে তাড়িয়ে ভুল করে অন্য আরেক দৈত্যকে নিয়ে এলাম? উত্তর হচ্ছে, না। এ দেশের ছাত্র-জনতা কোনো ভুল করেনি। যে অনভিপ্রেত ঘটনাগুলো ঘটেছে, এগুলো নিশ্চয় অনাকাক্সিক্ষত কিন্তু তা ছিল খুবই স্বাভাবিক, যা ঘটার কথা ছিল সেই তুলনায় খুব কমই ঘটেছে।
একটি ডিম সেদ্ধ করতে সময় লাগে পাঁচ মিনিট, আলু সেদ্ধ করতে লাগে ১৫ মিনিট, মাংস সেদ্ধ করতে সময় লাগে এক ঘণ্টা, অর্থাৎ বস্তু যত শক্ত, সেটা গলাতে তত বেশি উত্তাপ লাগে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি লৌহখণ্ডকে গলিয়ে ফেলেছে। এই কাজের জন্য চুল্লিতে কী পরিমাণ উত্তাপ তৈরি হয়েছে, তা আমাদের অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। যারা রুশ বিপ্লব বা পারস্য বিপ্লবের ইতিহাস পড়েছেন বা এসব বিপ্লবের ওপর নির্মিত সিনেমাগুলো দেখেছেন, তারা নিশ্চয় বিপ্লবোত্তর সময়কালটা মনে করতে পারছেন। বিপ্লবীদের বিপক্ষে কেউ অবস্থান নিয়েছে এ রকম সন্দেহ হলেই তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হতো, অনেককে তারা পিটিয়ে, পুড়িয়েও মেরে ফেলেছে। ধনী লোকদের ধন-সম্পদ দেদার লুট করেছে বিপ্লবীরা। খাবারের দোকান লুট করেছে। মার্কেট লুট করেছে। বেশ কিছুকাল একটা পুরোপুরি অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল এই দেশগুলোতে বিপ্লবোত্তর সময়কালে। কিন্তু তাদের বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যায়নি। একটি বড় দানব বধ করে বিপ্লবীরা গণমানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছিল, বিপ্লবের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিহারিদের বাড়িঘর দখল, তাদের হত্যা করা হয়েছে। কাদের সিদ্দিকী স্টেডিয়ামে নিজ হাতে মানুষ খুন করেছেন, যেটিকে শেখ মুজিব সমর্থন করে শাবাশ দিয়েছেন। বিখ্যাত সাংবাদিক অরিয়ালা ফালাচির ‘ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরি’ গ্রন্থে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকার অংশে এসব লেখা আছে। সরকারপ্রধান বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেছেন, এটি ছিল ভয়াবহ।
আমাদের এখানেও, ৫ আগস্টের পরে, তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় কিছু লুটপাট হয়েছে, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, কিছু ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। যদিও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ বা ডাকাতির মতো কাজগুলো বিপ্লবী ছাত্র-জনতা করেনি বলেই বহু প্রমাণ মিলেছে, বরং স্বৈরাচারের দোসর যারা তারাই বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এসব ঘটনাসহ কিছু নাশকতামূলক ঘটনাও ঘটিয়েছে। এসবের মূল ইন্ধনদাতা ছিলেন শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। ভারতীয় মিডিয়াগুলোর সঙ্গে তার সাক্ষাৎকার যারা দেখেছেন বা শুনেছেন, তারা এ বিষয়ে নিশ্চয় দ্বিমত করবেন না। যতদূর জানি, বিপ্লবী জনতা শুধু গণভবনেই তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় লুটপাট করেছে এবং স্বৈরাচারের প্রতীকগুলো ভাঙচুর করেছে। আশার কথা হচ্ছে, ছাত্র-জনতার সততা, তারা গণভবন থেকে যা যা নিয়েছিল, সেসব হাতে নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করেছে, সেলফি তুলেছে, ভিডিও করেছে। এটি ছিল বিজয়ের আনন্দ। যখন দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হয়, আমি তখন সুদানে, যদিও জুবায় ছিলাম না কিন্তু একই ভূখণ্ডে থেকে উপলব্ধি করেছি বিজয়ের আনন্দ যে কতটা উন্মাদনায় পর্যবসিত হতে পারে। গণভবন থেকে তুলে নেওয়া সম্পদ পরে তারা দলে দলে এসে ফেরত দিয়ে গেছে, এমনকি নগদ টাকা পর্যন্ত ফেরত দিয়ে সততার, উপলব্ধির, বিবেকের তাড়নার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আমার মনে হয় না নগদ টাকা ফেরত দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীতে খুব বেশি আছে।
বিপ্লবের সময় গ্রাফিতি আঁকা রাস্তা, দেয়াল এবং বহুকাল ধরে রাস্তায় জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা ছাত্র-জনতা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সাফ করে ফেলেছে। তিন দিন পুলিশ কর্মবিরতিতে ছিল, সেই সময়ে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক রেখেছে, রাস্তায় নেমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে, এই রকম ইতিবাচক ঘটনা কিন্তু অন্য দেশের বিপ্লবীরা খুব বেশি দেখাতে পারেনি। আমি বলব, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষ অধিক সংবেদনশীল, অধিক সৎ, দেশপ্রেমিক ও আবেগপ্রবণ। এই আবেগটাই বাঙালির বড় শক্তি। এই শক্তিকে দেশ গড়ার জন্য ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা বাংলাদেশের কোনো সরকারই সফলতার সঙ্গে করতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবের সবচেয়ে বড় সাফল্য হবে, এই কাজটি করতে পারা এবং আমি স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এ দেশের ছাত্র-জনতা এবার সফল হবেই।
সারা দেশ এখন একটি অতি উত্তপ্ত চুল্লি হয়ে আছে। সেই চুল্লিতে পড়ে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হবেই, তবে আশার কথা হচ্ছে চুলোটি প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত গতিতে ঠান্ডা হচ্ছে এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরে আসছে। রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন এ দেশের তরুণ ছাত্র-জনতা আমাদের দেখিয়েছে, তার প্রথম ধাপ হচ্ছে সবার কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে কথা বলে, অন্যায় কথা বলে, আমি তার প্রতিবাদ করব, অন্যায় কথা মেনে নেব না কিন্তু সে যেন তার কথাটা বলতে পারে সেই পরিবেশ আমি নিশ্চিত করব, এটিই হলো স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিবেশ। তবে একটা কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই বিপ্লব আমাদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছে, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, সেই লক্ষ্য থেকে আমরা যেন কিছুতেই বিচ্যুত না হই। গত ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার চাটুকারেরা যেসব অন্যায় করেছে, জোর-জুলুম করেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, এগুলোর যথাযথ বিচার হতে হবে। বিচারের এই দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে বা দায়সারা একটা কিছু করে বিপ্লবের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা যাবে না।