Thikana News
১৮ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪


 

লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ সংস্কৃতি

লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ সংস্কৃতি


কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বলতে মানবসমাজের বৈশিষ্ট্যসূচক শিল্প-সাহিত্য, বিশ্বাস ও সামাজিক রীতিনীতি সবই এর আওতাভুক্ত। কোনো সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, রীতি, অনুষ্ঠান, প্রথা এবং সুকুমারবৃত্তির চর্চার প্রতিফলন হলো সংস্কৃতি। অর্থাৎ সংস্কৃতি এককথায় মানবজাতির আত্মপরিচয়ের আয়নাস্বরূপ। যাহোক, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরম্পরা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ না করেই আমরা বৃহত্তর আঙ্গিকে গ্রামীণ কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে কিছু আলাপচারিতা ব্যক্ত করতে চাইছি। কিশোর বয়স থেকে সেই ষাটের দশক ও তার কিছুকাল পূর্বের গ্রামীণ চিত্র বর্ণনা করব।
পদ্মা-মধুমতীর ভাটি অঞ্চলের জনপদ। নলডাঙ্গার বিলে তখন প্রাচুর্যের মহোৎসব। গভীর পানির আমন, অল্প পানির আউশ ও বোরো ধান। উঁচু উঁচু জমিগুলোতে পাট, তিসি, তিল, ছোলা, মশুর প্রভৃতির বাম্পার ফলন। কৃষকদের গোয়ালভরা গরু, উঠোনে হাঁস-মুরগি আর বসতবাড়ির আশপাশে তরিতরকারির ফলন। বর্ষাকালে সন্ধ্যাবেলায় অনেক কৃষক পরিবারের দাওয়ায় চুপি বা হারিকেনের আলো জ্বেলে কিতারা-দোতারা বাজিয়ে ভাটিয়ালি, পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, লালনগীতি কিংবা মুর্শিদী গানের আসর বসে। গানের আসরে মাঝেমধ্যেই আমি একজন শ্রোতা হিসেবে পাশের বাড়ির চ্যালার মা বু’র দাওয়ায় উপস্থিত হয়েছি। সবাই আমাকে সাদরে পিঁড়ি কিংবা পাটি (মাদুর) পেতে বসতে দিত। বিয়ের অনুষ্ঠান হলে বিয়েবাড়ির উঠানে কনের গায়েহলুদ অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন মহিলা সুর করে বিয়ের গীত গেয়ে জমায়েতকে করত সরগরম। যারা এসব গীত জানত এবং গাইতে পারত, তাদের ছিল বিশেষ সমাদর। আমাদের পাশের আশ্রিত রূপই শেখের পরিবার, তার স্ত্রী ও কন্যা হেমেলা এ জাতীয় বিয়ের গীত গাইবার জন্য ছিল বিশেষভাবে পরঙ্গম। অন্য পাড়ার বিয়ে-শাদিতেও মা-মেয়ের ডাক পড়ত এ অনুষ্ঠানের জন্য।
ভরা বর্ষাকালে ফসলবিহীন বিস্তারিত মাঠের বিপুল জলরাশির ওপর নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। একেকটা লম্বা ডিঙিনৌকায় বৈঠা হাতে বেশ কয়েকজন জোয়ান ও শক্তিধর মাল্লা নিয়ে নৌকার পাল ও শীর্ষদেশকে সাজিয়ে নানা স্লোগানসহ হেইও হেইও করতে করতে তালে তালে বাইচ খেলা চলেছে। আশপাশের গ্রামের মানুষজন ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দূর থেকে ভিড় জমিয়ে প্রতিযোগিতা উপভোগ করেছে। প্রতীক্ষা করেছে কখন তাদের সমর্থিত নৌকাটি প্রথম হয়ে বীরের মতো আমের কূলে এসে পৌঁছাবে!
শীতকালটাই গ্রামীণ জনপদের সাংস্কৃতিক সমারোহের সময়। হিন্দুদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান দুর্গাপূজার জাঁকজমক, গান-বাজনা, পূজা-অর্চনা এবং সাত রাত সাত দিন যাবৎ কোনো কোনো সচ্ছল হিন্দু পরিবার কর্তৃক যাত্রা-কীর্তন ও নাটক মঞ্চস্থ হতো। প্রতিমাশিল্পের প্রতিযোগিতা, জ্বলন্ত ধূপধুনার খানচি হাতের মুঠোয় কিংবা দাঁতে কামড়ে ধারে দেবীর অর্চনা প্রতিযোগিতা এবং শহর-বন্দর থেকে সার্কাস পার্টি (কমলা সার্কাস প্রা. লি.) ভাড়া করে এসব আনন্দযজ্ঞের ব্যবস্থাপনা। কখনো-বা রাতব্যাপী নাম-কীর্তন, শ্যামাসংগীত, কবিগান, গাজির গীত কিংবা জারি-সারি গানের আসর চলত। এসব অনুষ্ঠানা শুধু আমাদের বর্ধিষ্ণু গ্রাম ইতনার সীমানাতেই সীমিত ছিল না। কখনো হিন্দু-অধ্যুষিত পাড়াগুলো ছাড়াও পার্শ্ববর্তী অনেক গ্রামেই এ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। উদাহরণস্বরূপ দৌলতপুর, চরদৌলতপুর, মল্লিকপুর, মঙ্গলহাটা, লক্ষ্মীপাশা প্রভৃতির নাম করা যেতে পারে।
দূরবর্তী কোনো গ্রামে যাত্রা/সার্কাস হওয়ার খবর পেলেই আমরা কয়েকজন সাথি মিলে রাতের খাওয়াটা একটু তাড়াতাড়ি সেরেই মাকে শুধু জানিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে পড়তাম। কারণ, বাবা জানতে পারলে কোনোভাবেই যাত্রা দেখার অনুমতি মিলবে না। তা একরকম অবধারিত!
শীতের কাপড় তথা সোয়েটার এবং একটা চাদর গায়ে দিয়ে মায়ের কাছে আবদার করে কয়েকটা টাকা পকেটে পুরে বেরোতাম। জানতাম, বাবার দিকটা মা-ই কিছু না কিছু বলে সামাল দেবেন! আমার সাথিরা ছিল চুনচালে, বাবুল সরদার আর মহর আলী। সারা রাত ধরে যাত্রানুষ্ঠান চললে কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ করে যাত্রাপালা শেষ হলেই ঘটত বিপত্তি! একদিন লক্ষ্মীপাশা না লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে টিকিট কেটে কমলা সার্কাস দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। শীতকালের অন্ধকার রাত। অবশ্য আমাদের সঙ্গী বাবুল সরদারের হাতে একটা তিন ব্যাটারিওয়ালা টর্চলাইট আছে। ঝোপঝাড় আর গাছপালার নিকষ কালো অন্ধকার, মাঝেমধ্যে শুধু কোনো কোনো বসতবাড়ির টিমটিম আলো জ্বলতে দেখা যায়। ঝিঁঝি পোকার ডাক আর কখনো-বা কানাকুয়া কিংবা প্যাঁচার ডানা ঝাপটানি বা বিশেষ ধ্বনি! ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উঁচু বেড়িবাঁধ-কাম রাস্তা ধরে সোজা মঙ্গলহাটা গ্রাম পার হয়ে মল্লিকপুরের দুয়ার কাছে পৌঁছালাম। কিন্তু এ দীর্ঘ খন্দটা পারাপারের কোনোই ব্যবস্থা নেই। উপায়ন্তর না দেখে আমরা যার যার লুঙ্গিকে কাছা দিয়ে বেঁধে নিয়ে হাঁটুসমান জলকাদা ভেঙে এ পাড়ে উঠলাম। দু-পায়ে এটেল মাটির কাদায় ভরা।
কাদামাখা পায়ে কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই বাবুল বলল, ‘এই তুমরা এটু খাড়াও এহানে। রাস্তার লাগা টিনের বাড়িডা আমাগো আত্মীয়ের। হাত-পাও ধুয়ার ব্যবস্থা করতি লাগবি!’
আমি, চুনচালে ও মহর রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বাবুল দরজায় কড়া নাড়িয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কী যেন আলাপ করে রাস্তায় ফিরে বসে আমাদেরকে বলল, ‘তুমরা সবাই বাড়ির ভিতরে আসো। বারান্দায় বালতি ভরা পানি আর একটা বদনা দেয়া হইছে। একজন কইরা মুখ ধুয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নাও ভালো কইরে।’
কাদামাখা পা ধুয়ে বারান্দায় তারে ঝোলানো গামছা দিয়ে হাত-পা মুছে নিলাম। অবাক হয়ে দেখি, দুটি থালভর্তি মুড়ি আর সঙ্গে পাটালি গুড় এবং চারটা কাচের গ্লাসে পানি দেওয়া হয়েছে। বাবুল বলল, ‘এহন গুড়-মুড়ি খেয়েই চল সবাই সার্কাস দেখতি যাই।’
অপরিচিত চারজন মেহমান এক পরিবারে হঠাৎ কারে আমরা সওয়ার হচ্ছি দেখে আমার একটু লজ্জাই লাগছিল! কিন্তু বাবুল সরদারের এ আত্মীয়দের আতিথেয়তায় সেদিন সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। কারণ, রাত আড়াইটা বা তিনটার সময় সার্কাস দেখা শেষ হওয়ার পর আমরা ওই বাড়িতে পৌঁছে দেখি খাওয়াদাওয়ার বিশাল আয়োজন! পোলাও, সাদা ভাত, করলা ভাজি, বেগুন ভাজি, রুই মাছের দো-পেঁয়াজা, মুরগির মাংসের ঝোল এবং ঘন ছোলার ডাল। খাওয়া শেষে খেজুরের গুড় দিয়ে রান্না করা সুস্বাদু পায়েস! এ যেন এক মেজবানির খানাপিনা। আমরা তৃপ্তিসহকারে খাওয়াদাওয়া সেরে দিলাম ঘুম। এক ঘুমে সকাল নয়টা। আমরা উঠে কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়েই বাড়ির দিকে রওনা হলাম বাড়িওয়ালাকে ধন্যবাদ দিয়ে। জীবনে প্রথম সার্কাস দেখার সৌভাগ্য হলো, যার অভিজ্ঞতা সত্যিকারভাবে মনে রাখার মতো। রায়দের স্থায়ী রঙ্গমঞ্চে নাটক-নাটিকা মঞ্চস্থ হতো পূজা-পার্বণে। পূজার ছুটিতে কলকাতা থেকে অনেকেই গ্রামের বাড়িতে আসত ছুটি কাটাতে।
আমাদের ইতনা উচ্চ বিদ্যালয়ের তুখোড় শিক্ষক অমূল্য কুমার বসু অভিনয় ও কবিতা আবৃত্তিতে বিশেষ পারদর্শী। তবে কলকাতা থেকে আগত অতিথিদের অংশগ্রহণে মঞ্চস্থ এমন কোনো নাটক দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবে আমার কিশোর বয়সে যখন তছলিম উদ্দিন আহমেদ (আমাদের পাশের দালানওয়ালা বাড়ির আত্মীয়) কোনো রকমে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করে নাটক পরিচালনা, মঞ্চস্থ করা এবং সবশেষে একখানা নাটকও রচনা করে ফেলল, তখন ইতনা গ্রামের দক্ষিণপাড়াটাই সাংস্কৃতিক চর্চায় অগ্রণী ভূমিকায়। রায়দের রঙ্গমঞ্চ তখন ‘ইতনা ইউনাইটেড ক্লাব’ নামে অভিহিত। সবচাইতে অবাক কাণ্ড হলো রঙ্গমঞ্চে ব্যবহারের জন্য ৮-১০টা ড্রপসিনসহ বিশাল ব্যাপ্তির দৃশ্যসংবলিত শিল্পীর তুলিতে আঁকা পর্দা। এগুলো আবার কপিকলের সাহায্যে গুটানো ও নামানো সম্ভব। নাটক মঞ্চস্থ করতে এসব দৃশ্যযুক্ত ড্রপসিনগুলোর ব্যবহার ছিল চিত্তাকর্ষক। শুধু একবার আমরা আমাদের দক্ষিণপাড়ার মহিলাদের অনুরোধে আমাদের বাড়ির উত্তর দিকের খোলা মাঠে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলাম অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে। নাটকটিতে আমার ছিল মিরনের চরিত্র। অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারসমূহের বিয়ে-শাদি কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানে বা বিশেষ প্রয়োজনে কিংবা দূরবর্তী কোনো স্থানে যেতে ডুলি-পালকির ব্যবহার গ্রামীণ সংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য বাহন। এসবের বহনকারী সম্প্রদায় বেহারা বলে পরিচিত। এরা কৃষিকাজ করলেও বাপ-দাদার পেশা বা বৃত্তি হিসেবে ডুলি-পালকি বহন করে অতিরিক্ত কিছু অর্থ উপার্জন করে। ‘পালকি চলে, দুলকি চলে’-বেহারাদের হাতে থাকে পালিশ করা লাঠি।
কখনো কখনো এরা সুর করে গানও গায় একসঙ্গে। তা ছাড়া বিত্তবান লোকেরা পালকির পেছনে বা সামনে ব্যান্ড পার্টি বাজিয়েও দেয় আনন্দবার্তা। ডুলিতে সাধারণত একজন অর্থাৎ কনে বউ বসে পিঁড়ির ওপর। পিঁড়ির ওপর কাঁথা বা তোশক পেঁচিয়ে দেওয়া হয়। আর একখণ্ড বাঁশের মাঝখানে কাপড় পেঁচিয়ে কনে বউয়ের আব্রু রক্ষা করা হয়। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

কমেন্ট বক্স