Thikana News
১৫ জানুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫

সেডার পাইনস রিসোর্ট

সেডার পাইনস রিসোর্ট
আমেরিকান এয়ারলাইনসের লোকাল বিমানটি কচ্ছপের গতিতে নিচের দিকে নামছে। শামা বিমানচালকের ওপর যারপরনাই বিরক্ত হয়। সব জেনেবুঝেও বাচ্চাদের মতো বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে, ‘ধ্যাত, হুট করে ব্রেক কষে বিমান থামিয়ে দেবে, তা না! সেই কখন থেকে বাজপাখির মতো ধীরলয়ে আকাশের ওপর ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে।’ আসলে ওর আর তর সইছে না। মনটা উতলা হয়ে আছে বন্ধুদের সাক্ষাৎ পেতে। সেই কোনবেলায় অর্পিতা, বর্ষা এসে তার অপেক্ষায় বসে আছে ! বেলি অবশ্য তারও ঘণ্টাখানেক পরে নামবে, তেমন কথাই তো রয়েছে।
কানাডা থেকে উড়ে আসা এয়ার কানাডা উড়োজাহাজের জানালার পাশে বসে বেলি অফুরন্ত ভাবনায় ডুবে আছে। প্রায় এক যুগ পর বন্ধুদের সঙ্গে খুব শিগগিরই তার দেখা হবে! কিন্তু বন্ধুদের মতো সে নির্ভাবনার খুশির ভেলায় ভাসতে পারছে না! তার এখানে ছুটে আসার বিশেষ একটা উদ্দেশ্য রয়েছে, অবশ্যই তা শুধু বন্ধুদের সান্নিধ্যের জন্য নয়। বেলির চোখ দুটো বর্ষাজলে টইটম্বুর দিঘির মতো টলমলিয়ে ওঠে। পাশে বসা সাদা ভদ্রলোকের চোখ এড়াতে মুখটা সে আলগোছে জানালার ওপাশে সরিয়ে নিলেও কোলের ওপর টপটপিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে। বদ্ধ জানালার ধূসর-কাচের ওপাশটায় আসলে দেখার তেমন কিছুই নেই! সীমাহীন শূন্যতাভরা বিস্তীর্ণ আকাশ, ঠিক বেলির বুকটার মতো খাঁ খাঁ করছেÑএকসমুদ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস।
শামা নিজেকে আপাতত শান্ত রাখতে প্লেনের জানালায় চোখ রাখে। আকাশভরা ছেঁড়া ছেঁড়া কিশোরীর অগোছালো চুলের মতো মেঘেরা দ্রুতগতিতে ছোটাছুটি করছে। প্রকৃতিতে বসন্তের আবেশ লেগেছে। সূর্যদেব তার সোনাঝরা রোদ ঝরিয়ে মেঘেদের ওপর পাটল রঙের ছায়া ফেলেছে। মেঘমালারা কোন সুদূরে কার ডাকে এমন করে ছুটে যায়Ñকে জানে! সুউচ্চ পাহাড়ের গা ঘেঁষে যাওয়া মেঘরাজ্য পেরিয়ে ততক্ষণে বিমান অনেকটাই নিচে নেমে আসে। পাহাড়ের গায়ে সারি সারি শত বর্ষীয়ান পাইনের বন। সুগার পাইনের সারি স্বগোত্রকে ছাড়িয়ে মেঘেদের বুকচিরে আকাশের নীল সীমানা ছুঁই-ছুঁই করছে! সবেমাত্র শীতের প্রস্থান হয়েছে। এখনো তার রেশ প্রকৃতিজুড়ে বয়ে গেছে। উঁচু পাহাড়গুলোর ফাঁকফোকরে এখনো শুভ্র-সাদা ছোপ ছোপ তুষার চোখে পড়ছে। বিমানের পাখা চিলের ডানার মতো খানিক বাঁকা হয়ে শহরের উঁচু উঁচু অট্টালিকা ক্যাসিনোর গা ঘেঁষে মাটির খুব কাছাকাছি নেমে আসে। চোখ-ধাঁধানো একটা শহর।
এ শহরের চমৎকার কিন্তু উদ্ভট একটা ডাকনাম আছে, ‘বিগেস্ট লিটল সিটি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’। বছরের এ সময়ে প্রকৃতি তার রংদানি খুলে শহরটাকে নিজ মনে রাঙিয়ে দিয়েছে। এত সব সৌন্দর্য একসঙ্গে এর আগে কোথাও শামার চোখে পড়েনি। শহরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিচিত্র সব পাহাড়ি ফুল। পাহাড়ি ফুলের রং-সৌন্দর্যের বিকল্প খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হরেক রঙের চেরি ফুলের ছায়ে শহরটা যেন প্রশান্তির ঘুমে ডুবে আছে। এতক্ষণে শামার ব্যাকুলতা কেটে গেছেÑসে মুগ্ধ চোখে এসব দৃশ্যে ডুবে আছে। একসময় বিমান আকাশ ছেড়ে মাটিতে স্থির হয়। শামা বোডিং পেরোতেই দৌড়ে ছুটে আসে বন্ধুরা। ওর দু’কাঁধ ধরে ঝুলে বাঁদরঝোলা হয়ে থাকে অর্পিতা আর বর্ষা। কত দিন ছুঁয়ে দেখা হয় নাই বন্ধুকে। কত কথা জমে আছে মনে। তিনজন একনিঃশ্বাসে শুধু বলেই যায়, কেউ কাউকে শুনছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। অকারণ হাসির বন্যায় ভেসে যায় এয়ারপোর্টের করিডোর।
প্রায় আধঘণ্টা পর কাচের দরজার ওপাশে ধীর পায়ে বেলিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। এবার তিন বন্ধু ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে ওকে। ওরা বর্তমানের খেই হারিয়ে ফেলেÑসময় যেন স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়া মাঝবয়সী মেয়েগুলো মুহূর্তে ফিরে যায় সেই কতকাল আগের ফেলে আসা কলেজজীবনের সোনালি সময়ে। সাদা ইউনিফর্ম, ঘন বুনটে বাঁধা দুই বেণি দুলিয়ে যেমন করে দৌড়ঝাঁপ ছোটাছুটি করত, তেমন করে ছুটে গিয়ে বেলিকে জাপটে ধরে শূন্যে তুলে নেয়। এয়ারপোর্টে এদের হই-হুল্লোড় শোরগোল জমে ওঠেÑতাদের কলেজের বটতলা, পুকুরপাড়ের জটলার মতো করে।
বেলিদের বাড়ির সীমানা ওদের কলেজ থেকে হাঁটাপথ। বাকিরা কলেজ হোস্টেলে থাকত। তারা ঢাকার বাইরের, দূর-দূরান্তরের জেলা থেকে এ শহরে পড়তে এসেছে। ঢাকা শহরে এদের নিজস্ব কোনো ঠিকানা নেই। বেলিদের বাড়ি মানে এদের নিজেদের বাড়ি। বেলির বাবা-মা নিজের মেয়ের মতো করে তার বন্ধুদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। প্রায়ই দেখা যেত সবাই মিলে ওদের বাড়িতে গল্প-আড্ডা, খাওয়াদাওয়া শেষে সন্ধ্যা করে হোস্টেলে ফেরা। বেলির বন্ধুবাৎসল্যের কথা তো বলার মতো নয়Ñএমন হৃদিক, যার জুড়ি মেলা ভার।
এমনভাবে দিনগুলো বেশ কাটছিল। কিন্তু সহসা বৈশাখের আকাশের মতো চট করেই বদলে গেল সবকিছু! বেলি শুধু বন্ধুদের নয়, পরিচিত সবাইকেই এড়িয়ে চলতে শুরু করল! কলেজে অনিয়মিত আসত এবং চুপচাপ ক্লাস করে সোজা বাড়ির পথ ধরত। কলেজ মাঠ, ক্যান্টিন কিংবা হলের সব আড্ডাতেও বেলির অনুপস্থিতি নিয়মিত হলো। দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া একসময় হরহামেশাই চলত এবং বেলিই আগবাড়িয়ে সবকিছুর আয়োজন করত। এখন এসবের সবকিছুতেই সে অনুপস্থিত।
সময় গড়িয়ে সামনে এগোয় এবং তাদের কলেজ পাস করে ক্যাম্পাস ছাড়ার সময় হয়ে আসে। কলেজ শেষে যে যার জীবন নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সবার সঙ্গে যোগাযোগটা যতদূর সম্ভব থেকে গেলেও বেলির সঙ্গে সবার সম্পর্ক অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বেলির জন্য বন্ধুদের মন সব সময় ছটফট করত কিন্তু কোনোভাবেই যোগাযোগটা বেলির ইচ্ছাতেই ধরে রাখা যায়নি।
এরপর বেশ কয়েক বছর চলে গেল এবং শোনা যায় বেলি দেশে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করছে। এর পরের খবরÑসে জার্মানিতে আছে। গত দুই বছর ধরে কানাডায় থাকছে।
যোগাযোগের এমন সুদিনে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে নেওয়া বেলি গেল মাসে হঠাৎ করে অর্পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং এরপর সবার সঙ্গে দেরিতে এবং ঢিলেঢালা হলেও যোগাযোগটা শুরু হয়। সবাইকে হুট করে এমন নির্জনে তলব করে। বন্ধুদের মধ্যে ওরা চারজন আমেরিকা- কানাডায় আছে এবং সবার বসন্তের ছুটি একসঙ্গে মিলেও যায়। বহুদিন পর বেলির সঙ্গে দেখা হবে! এ সুযোগে সবাই মিলে সময় কাটাতে এরা খুব সুন্দর একটা পাহাড়ি জায়গা দেখে এখানে চলে আসে।
এয়ারপোর্ট ছেড়ে তাদের গন্তব্য ‘সেডার পাইনস রিসোর্ট’। ঘণ্টা তিনেকের পথ। পাহাড়ি বাঁকবদল করা রাস্তাঘাট পেরিয়ে ভূমি থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট সোজা উপরে পাহাড়ের একদম চূড়ায় ওদের রিসোর্ট। নেট ঘেঁটেঘুঁটে নাড়িনক্ষত্র জেনে যাত্রা করলেও বুকে কেমন যেন একটা ধুঁকধুকানি শুরু হয় সবার। এত আনন্দের মাঝেও কোথায় যেন একটু অস্বস্তি বেসুরো হয়ে বুকে ঢকঢকিয়ে বাজনা তোলে। এয়ারপোর্টের বাইরে সারিবদ্ধ ইয়েলো ক্যাবের কাছে দুরু দুরু মনে এগিয়ে যেতে দেশি একজন ক্যাব ড্রাইভার সাদরে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। অচেনালয়ে দেশি লোকের দেখা পেয়ে মনে হলো যেন গোমটবাঁধা গরমকালে হুট করে একপশলা বৃষ্টি শেষের শীতল বায়ুর অনুভূতি। ওরা দেশি ড্রাইভারের গাড়িতে চেপে বসে।
এবার গাড়ি ছুটে চলে গন্তব্যের দিকে, নির্ভয়ে-নির্ভাবনায়। ছবির মতো চমৎকার চারপাশের পরিবেশ। আঁকাবাঁকা রাস্তার এক পাশে কাচের মতো স্বচ্ছ জলের সরোবর, অন্যপাশটায় পাইনের সারি, ঘন বন, ঝোপঝাড়। গাড়ি সাপের মতো শান্ত সরু বাঁকাত্যাড়া পথ বেয়ে উঁচুতে ধীরে গতিতে উঠতে থাকে। জানালার বাইরে অদ্ভুত দৃশ্য থেকে চোখ সরানো দায়। সরোবরের ওপাশটায় দূরের পাহাড়ের গা জড়িয়ে বসতবাড়িগুলো বাদুরঝোলা হয়ে ঝুলে আছে। ছোট-বড় পাহাড়ে ঠাসা এ অঞ্চল। প্রতিটা পাহাড়ে ভিন্ন ভিন্ন ছবির মতো একেকটা শান্তস্নিগ্ধ শহর গড়ে উঠেছে।
এক শহর পেরিয়ে নির্জন উঁচু-নিচু গিরির বুক চিরে রাস্তা চলে গেছে অন্য শহরের ভেতর দিয়ে আরও দূরে, বহুদূরে, চোখের নাগালের বাইরে কোথাও। পাইনের সারির ফাঁকফোকরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পাহাড়ি গাছগাছড়ায় লাল-নীল-বেগুনি ফুল। ফুলের রাজ্যে প্রজাপতির মেলা বসেছে। চোখ জুড়িয়ে যায়; এমন স্বর্গীয় দৃশ্যে বেশিক্ষণ চোখ রাখা যায় না। রাস্তার অদূরে ঝোপঝাড়, লতাগুল্মে ঘেরা অরণ্যে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় বন-মৃগের দল। চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে তাদের দুরু দুরু বুকে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ছুটে পালানোর দৃশ্যÑমুগ্ধস্তব্ধ করে ওদেরকে। এমন দৃশ্য পশ্চিমা নাটক-সিনেমায় অহরহ দেখা গেলেও বাস্তবে এর আগে ওরা কোথাও দেখেনি।
গাড়ি বিরামহীনভাবে রিসোর্টের দিকে ছুটে চলেছে। পাইনের চিরল পাতায় বৈকালি হাওয়ার দোলনে শিরশির কাঁপন ধরে। পশ্চিমের আকাশে লাল রং ছড়িয়ে দিয়ে সূর্যদেবের বিদায়ী আয়োজনের তোড়জোড় চলছে। পাহাড়দেশে ঘন বন-জঙ্গলে আঁধার নেমে আসে বেলা না পড়তে। প্রকৃতির এমন দুর্লভ আবহে অর্পিতা, বর্ষা গলা ছেড়ে গান ধরে। একসময় ওরা বেশ গাইত। দরাজ গলা ছিল। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের গান না হলে যেন জমতই না। চর্চাটা এখনো ধরে আছে বলেই মনে হলোÑশুনতে বেশ লাগছে। গানের মধ্যখানে শামা তার এই মাত্র লেখা চার লাইন পদ্য, জোর গলায় আবৃত্তি শুরু করলে বাকিরা হেসে গড়াগড়ি যায়। শামাটা আজীবন একই রকম রয়ে গেল। সেই কলেজে পড়ার সময়েও তার কবিতা লেখার বাতিক ছিল, আজও তা মাথাতে চেপে বসে আছে।
এরা এতকাল পরে একসঙ্গে হয়ে মাঝের সময়গুলো একঝটকায় উড়িয়ে দিয়ে হাসি-আনন্দের যেন ঠাঁই পায় না। ক্যাব ড্রাইভার দেশিভাই বলে রক্ষা। সে নিজেও এদের পেয়ে বেজায় উৎফুল্ল হয়ে আছে। বড় বোনদের প্রশ্রয়ে গলা মিলিয়ে সেও তাদের সঙ্গে গান ধরে। এরই মধ্যে তাদের প্ল্যান-প্রোগ্রাম তার জানা হয়ে গেছে এবং আগামী তিন দিন তাদের এই এলাকা ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্বটা তাই সে নিজ গরজেই কাঁধে তুলে নিয়েছে। শুধু বেলি মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে আছে। গাড়িতে চেপে বসার পর থেকে কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলছে না। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ড্রাইভারের সঙ্গে মাঝেমধ্যে নিচু স্বরে গল্প করছে। সেই আগের মতোই আছে, সবার মাঝে থেকেও যেন কারও সঙ্গেই সে নেই!
পাইনের ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে বাবুই পাখির বাসার মতো কাঠের গুঁড়ির বুনটে তৈরি রিসোর্টগুলো। ওদের ‘সেডার পাইনস রিসোর্ট’-এর অবস্থান চমৎকার একটি জায়গায়। এক পাশে সেই লাস্যময়ী স্নিগ্ধ সরোবর, যার নীল জলের শান্ত ঢেউ পাহাড়ের সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর আকাশের নীল দিগন্তে গিয়ে ঠেকেছে। অন্যপাশটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে সমতলের দিকে। ছোট্ট নদীর মতো ধীরস্থির যে রাস্তাটি ধরে ওরা পাহাড়ের মাথায় চলে এসেছে, এটা সেই রাস্তা। রিসোর্ট থেকে সে রাস্তা চোখে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অতিশয় ঢালু, যা গাড়িতে বসে একদমই টের পাওয়া যায়নি। তবে উড়োজাহাজে শূন্যে উঠতে যেমন বোধ হয়, সেরূপ অনুভূতি হয়েছিল। রাস্তাটা প্রায় খালি, মাঝেমধ্যে দু’একখানা গাড়ি কচ্ছপ গতিতে পাহাড়ি পথের গা বেয়ে উপরে উঠে আসছে কিংবা নিচের শহরে ফিরে যাচ্ছে।
রিসোর্টের চারপাশটা প্রাচীন এবং আদিম প্রকৃতির আবেশ পুরোপাঁচটা ধরে রেখে তৈরি করা হয়েছে। জনকোলাহল নেই। শহরের মতো বিজলি বাতির আতিশয্য নেই। বন-জঙ্গলের প্রকৃত সৌন্দর্য পশুপাখি, হাজার রকম পশুপাখি এই অভয়ারণ্যে নির্ভয়ে অবাধে বিচরণ করছে। তাবৎ পৃথিবীর সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষগুলো সারা বছর ছুটে আসে নীল জলের সরোবরঘেরা এই পাইন বনে।
মধ্যরাত নেমেছে পাইনের ঘন বনে। আধক্ষয়ে যাওয়া চাঁদটা প্রকৃতিতে মৃদু জ্যোৎস্নার আঁচল এলিয়ে দিয়েছে গভীর মমতায়। নীহারের আবেশে ভিজে উঠেছে পাইনের বন। রিসোর্টের অদূরে পাহাড়ের ওপর জমে থাকা তুষার গলে জলপ্রপাতের ধারা শান্ত সরোবরের ওপর ঝপঝপ আওয়াজে আছড়ে পড়ছে। জ্যোৎস্নার মৃদু আলোতে জলধারায় রুপালি আলো খেলা করছে। পাহাড়ের চূড়ায় শীতলতার আবেশে জমে যাওয়া রাজহংসের পালকের মতো সাদাশুভ্র তুষারের জমাটবাঁধা দানাগুলোকে হীরক টুকরো বলে ভ্রুম হয়। শুধু পাহাড়-অরণ্যে নয়, জ্যোৎস্নার আঁচল পড়েছে সবখানে, পুরো জগতেÑসেডার পাইনস রিসোর্টের ঝুলবারান্দায় জমে ওঠা মধ্যরাতের আসরে, বেলির চোখের কোণের লুকানো অশ্রুবিন্দুতে, ক্যাব ড্রাইভার শিমুলের গানের সুরে, শামার অব্যক্ত কাব্যগাথায়।
আড্ডার মধ্যখানে শামা তার স্বভাবমতো উঠে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। বন্ধুরা তাকে ভালো করেই জানে। কেউ আগবাড়িয়ে উতলা হয় না। সুগার পাইনের আগায় পাখিরা বাসা বেঁধেছে, রাত দীর্ঘ হয়, প্রহরের জানান দিতে, ক্ষণে ক্ষণে ওদের পাখা ঝটকানি কানে এসে লাগে। শীতকালে এরা শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে দূরদেশে উড়ে চলে যায়। বসন্তকালে ঠিক ঠিক নীড়ে ফিরে আসে। পুরো তল্লাট সুনসান নীরবতায় ঢেকে আছে। বনশৃঙ্গের দল নির্ভয়ে ঝোপঝাড়ের বাইরে বেরিয়ে এসে হেঁটে চলে যায় সরোবরের সন্নিকটে। সরোবরের চারপাশ ডিম্বাকৃতি পাথর দিয়ে ঘন বুনটে ঢাকা দেওয়া আছে। শামা বড় একটা পাথরখণ্ডের ওপর স্থাণু হয়ে বসে থাকে। মানুষের বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা বোধ করি পরিবেশ বুঝে ওঠানামা করে!
বাবার কথা আজ খুব বেশি মনে পড়ছে। আষাঢ়ের বাঁধভাঙা ডলকের মতো ওর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বাবা সত্যি সত্যি চলে গেল! শামা এমন অমোঘ সত্যটা গত তিন বছরেও মানতে পারল না। মানুষ যখন অন্য ভুবনে চলে যায়, সে তো চলেই যায় কিন্তু তার প্রিয়জনদের জ্বলন্ত চিতায় ফেলে রেখে যায়। যত দিন তারা এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে, চিতাসম আগুনে জ্বলেপুড়ে ছাইভস্ম হয়ে তবেই বেঁচে থাকে। শামা প্রকৃতির এই অঢেল সৌন্দর্যের মাঝেও একদণ্ড শান্তি ভোগ করতে পারে না। বুকের ভেতরের জলপ্রপাতটা দেখানোর জো নেই বলেই বোধ হয় এতটা কষ্ট ছড়ায় মনে। পৃথিবীতে একমাত্র বাবা নামক অবলম্বনটাই যে তার ছিল। তাকে ছাড়া সমস্ত পৃথিবীটা কেমন যেন মেকি হয়ে ওঠে!
শামা আধো আলো-আঁধারে হাত-পা গুটিয়ে, গুটিসুটি বেঁধে স্থির হয়ে বসে রয় পাথরখণ্ডের ওপর। কানে বাজে বাবার কণ্ঠস্বর। হাওয়ায় ভেসে আসে বাবার শরীরের সেই চিরচেনা গন্ধটা। শামা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। বাবা তার খুব কাছে এসে তাকে ঘেঁষে বসে থাকেন। বাবার গায়ের গন্ধটা চারপাশে ছড়িয়ে যায়! বাবা গল্প করেন ঠিক আগে যেমন করে হেসে হেসে গল্প করতেন! শামার মন খারাপ হলে বাবা সবার আগে টের পেতেন। বাবাকে ছেড়ে একসময় সে সাত সমুদ্দুর পাড়ের দেশে চলে আসে। মন খারাপের দিনে শামা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদত, বাবাকে উদ্দেশ করে কথা বলত। বাবা কিন্তু ঠিক ঠিক টের পেতেন। সকাল হতেই দেশ থেকে ফোনে বাবার কণ্ঠটা ভেসে আসত। বাবা কথা বলে যেতেন, শামা চুপ করে বাবার গলার শব্দ শুনত।
আজও বাবা তার কাছে চলে এসেছেন। চোখ বন্ধ করে বাবার খুব কাছ ঘেঁষে বসে থাকে সে। হাত বাড়িয়ে বাবাকে খুব ছুঁতে মন চায় তার। বাবার হাতটা কত দিন ধরা হয়নি। বাবার বাঁ হাতের কনুই থেকে কব্জি অবধি পোড়া ছিল। ছোট্টবেলায় তিনি তপ্ত ভাতের মাড়ের ওপর পড়ে যান। হাতটা খুব বেশি জখম হয় এবং দাগটা গাঢ় হয়ে আজীবন রয়ে যায়। সেই পোড়া হাতটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সময়ে-অসময়ে বাবার সেই পোড়া হাতটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে শামা প্রতিদিনকার আটপৌরে কাজগুলোতে মনোযোগী হতে পারে না।
এভাবে রাত শেষে একসময় ভোর হয়ে আসে। শেষ রাতের নক্ষত্রটা তখনো পশ্চিম আকাশকোণে মিটিমিটি জ্বলছে। দূরপাহাড়ের গা রাঙিয়ে ভোরের সূর্যটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। শামার বুজে যাওয়া চোখের ওপর ভোরের নীলচে আলো পড়তে তার ঘোর কেটে যায়। পার্থিব জগতে ফিরতে বুকটা কেমন চৈতালি খরার মতো হুহু করে ওঠে। ভাঙা বুকে ধীর পায়ে রিসোর্টের দিকে ফিরতে শুরু করে সে।
প্রায় দশ বছরের বেশি সময় ধরে শিমুল এ পাহাড়ি অঞ্চলে গাড়ি চালায়। উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে তার গাড়ি তরতরিয়ে চলে যায় শত শত মাইল দূরের পাহাড়ের শহরগুলোতে। দুনিয়ার কত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে তার প্রতিদিন সাক্ষাৎ হয়, তার হিসাব মেলানোও ঢের মুশকিল। শীতকালে পাহাড়ের গায়ে রাতদিন তুষার ঝরে ঝরে শ্বেতশুভ্র তুষারপাহাড় গড়ে ওঠে। ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাটের চিহ্ন তো দূরে থাক, সুউচ্চ পাইনগাছগুলোও তুষারের আবরণে ঢাকা পড়ে যায়। সে সময়ে এ অঞ্চলে স্কি করতে বহু মানুষ দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে ভিড় জমায়। সেই তুষারাবৃত পথেও শিমুলের ক্যাব শ্বেতভল্লুকের মতো তুষায় ঠেলে ঠেলে উঠে আসে পাহাড়ের উঁচু চূড়ায়।
শিমুল সেই কখন থেকে এসব গল্প নিজের মনে বকবক করেই যাচ্ছে, বাকিরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে গাড়ির ভেতর নিঃশব্দে বসে আছে। শিমুল তাদের ভয় কাটাতে আরও কত কী যে বলে যায়। গাড়ি ছুটছে ইউসেমটি ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশে এবং পৃথিবীর সেরা বিপজ্জনক একটি রাস্তা ধরে!
পাহাড়ের সঙ্গে লেপটে থাকা চিকন সরু রাস্তাটাকে মনে হয় যেন পাহাড়ের সঙ্গে ঠেক দিয়ে ঝুলে আছে আর অন্য পাশটায় গভীর খাদ। এতটা গভীর, গাড়ি থেকে ওদিকটায় চোখ ফেরালে ঘন কালো অসীম আঁধারের গর্ত ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ে না। গাড়ি সুতা পরিমাণ এদিক-ওদিক হলে তাদের অস্তিত্ব খাদের গর্তে ধূলিকণার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। একটা সময় পর অবশ্য গাড়ি ঠিক ঠিক ইউসেমটি পার্কে এসে ভেড়ে।
এবার এদের চোখ কপালে লাফিয়ে ওঠার পালা! এরা বিস্ময়ে অভিভূত। এমন জায়গা জগতে আছে কল্পনা করাও দুষ্কর ছিল! বহু প্রাচীন এ অঞ্চলের গাছগুলোও সাক্ষাৎ পাথর হয়ে পাহাড়ের গায়ে লেপটে আছে। সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়া হতে জলপ্রপাতের ধারা আছড়ে পড়ছে নিচু পাহাড়ের গায়ে। পাহাড়ের মাটি পাথর হয়ে জমে আছে! লক্ষ বছরের পুরোনো পৃথিবীর সুস্পষ্ট চিহ্ন পড়ে আছে এ প্রাচীন পার্কে। মনে হয় যেন ভুল করে অন্য কোনো গ্রহে চলে আসা। রাস্তাঘাটের দশা ভয়ংকর হলেও মানুষের ছুটে আসার বিরাম নেই যেন। সবাই হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। অনেকে ধীর পায়ে পাহাড় বেয়ে আরও উপরে চলছে। শামাও দলছুট হয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে যায় অনেকটা দূর অবধি। বর্ষা, অর্পিতা তাদের স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা ভুলে হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে পাথরের দেশ।
অনেকটা রাত করে রিসোর্টে ফিরে আসে ওরা। তার পরও রাতের আসরটা জমাতে কেউ ভুলে না। বেশ জমে ওঠে মধ্যরাতের আসর। বর্ষা আর অর্পিতা নিজেদের মতো করে সারাক্ষণ কলকল ছলছল করেই যায়। কত গল্প জমে আছে ওদের মনে কিন্তু সময়ে চলে গেল, কড়ে গোনা বাকি দিন আছে মাত্র এক দিন। শামা সবার মাঝে থেকেও মাঝেমধ্যে নিজ জগৎ নিয়ে একটু আড়ালে-আবডালে রয়ে যেতে ভালোবাসে। গল্প-আড্ডার মধ্যমণি হয়েও মুহূর্তে তার ভিন্নরূপ দেখা যায়। সবার মাঝে থেকেও বিচরণ করে অন্য কোনো ভুবনে, কী যে ভাবনায় সারাক্ষণ ডুবে থাকে। শিমুল আর বেলি নিচু স্বরে অনবরত ফিসফাস চলছে। দু’দিনের পরিচিত হয়েও দিব্যি সারাক্ষণ দুজনে গল্প করেই যাচ্ছে। কী এত গল্প, কে জানে! অবশ্য বন্ধুরা কেউ কাউকে কোনো বিষয় নিয়ে অযথা ঘাঁটায় না। যদিও বন্ধুরা বুঝতে পারেÑবেলি অজানা কোনো উৎকণ্ঠায় সময় পার করছে।
শেষ রাতে বর্ষা, অর্পিতা ঘুমিয়ে পড়ে। বেলিটা শিমুলের সঙ্গে দরকারি কাজের বাহানায় বেরিয়ে যায়। শামা রাতের শেষটা পর্যন্ত জেগে থাকবে বলে ঘুম কাটাতে মগভর্তি কফি নিয়ে ঝুলবারান্দায় গিয়ে বসে। পাইনের ঝাঁকড়া মাথায় রাতের আঁধার দস্তুরমতো জেঁকে বসেছে। শামা অন্ধকারে চোখ রেখে স্বভাবমতো আপন ভুবনে ডুব দেয়।
রিসোর্টের বাইরে সবে অন্ধকারের প্রলেপ কাটতে শুরু করেছে। শামা ভোরের নীল আলো ফুটতে বেরিয়ে পড়ে রিসোর্ট ছেড়ে। ঝাপসা কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারপাশ। পাইনের সবুজ সুতার মতো চিরল পাতায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমেছে। শিউলি ফুলের মতো টুপটাপ শব্দে শিশিরকণা ঝরে পড়ছে কালো পিচঢালা পথে, যে পথ চলে গেছে দূর পাহাড়ের দেশে।
শামা অচিন সেই পথ ধরে হেঁটে চলে যায় অজানার পথে। ততক্ষণে আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের চোখ ফাঁকি দিয়ে সূর্যের তেজহীন নরম রোদ পৌঁছে গেছে পাইনের ঘন-ঝাড় অরণ্যে। অদূরে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে বনমৃগের দল, উঁচু পাইনের শাখে পাখিদের কিচিরমিচির, কাঠবিড়ালির অকারণ ছোটাছুটি, সকালের মৃদু হাওয়ায় পাইনের চিরল পাতায় তিরতিরে কাঁপন, পথের দু’ধারে পায়ে পিষে যাওয়া বন ঘাসফুল-লতাগুল্মের অপার্থিব সৌন্দর্য যেন অলৌকিক কোনো জগতের পথে এনে দাঁড় করায় ওকে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আঁকাবাঁকা সর্পিল পিচঢালা পথ নেমে গিয়ে মিশে গেছে বহু নিচে সমতলের পিঠের সঙ্গে। প্রকৃতি-মন্ত্রমুগ্ধ শামা, দু’পায়ের জোর বাড়িয়ে আরও দূরে ছুটে চলে যায়।
গত তিন দিন একনাগাড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে এদের নিরন্তর ঘোরাঘুরি। দিন-রাতে কারও কারও ঘুমেরও ফুরসত মেলেনি। চোখের নিচে ঘন কালো মেঘের ছায়ার মতো দাগ পড়ে গেছে! অর্পিতা আগাগোড়া কুড়ে স্বভাবের, সেও রাতে মাত্র ঘণ্টা দুইয়ের বেশি ঘুমায়নি। এমন অরণ্যঘেরা রিসোর্টে বন্ধুদের সঙ্গে আজকের রাতটাই শেষ রাত। আবার কবে-কোথায়-কখন দেখা হয় কিংবা না-হয়, কে জানে! আজও তারা ঘুমকে ছুটি দিয়ে কড়া ক্যাফিনে কফি নিয়ে ঝুলবারান্দার আসরে গেড়ে বসে যায়।
আসরের শুরুতে শামা কোনো ভনিতা না করে আজ ভোরসকালের অভিজ্ঞতায় লেখা চমৎকার গদ্য-কবিতার আবৃত্তি শুরু করে দেয়। সহজাত হাসির ঢল নামে বন্ধুদের মাঝে। শামা অবশ্য তাতে দমে যাওয়ার মেয়ে নয়। কবিতার ভাবনায় ডুবে গিয়ে সে পরপর আরও বেশ কটা কবিতা একমনে আবৃত্তি করে যায়। তবে ওর ‘পাইনের বনে’ কবিতায় ভোরের প্রকৃতির বর্ণনা শুনে সবাই সিদ্ধান্ত নেয় আজ ভোরে সবাই মিলে সেখানে যাবে!
বেলি গত ক’দিনের চেয়ে আজ আরও বেশি চুপচাপ। চোখ দুটো লুকানো কান্নার সাক্ষী দিতে লাল টকটকে রং মেখে ফুলেফেঁপে আছে। অস্পষ্ট আলোতে তা স্পষ্ট ঠাহর করা যায়। শিমুলটাও আজ আড্ডার মুডে নেই, কেমন যেন ছন্নছাড়া মনে ঝুলবারান্দার দোলনায় দু’পা তুলে উদাস হয়ে বাইর দিকে তাকিয়ে আছে। বর্ষাটা সাধারণ গল্প রসেবশে, রংচঙ মেখে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলতে ওস্তাদ, সঙ্গে অর্পিতার কারণ-অকারণ হই-হুল্লোড়। শামা ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। মাঝেমধ্যে আড্ডার মধ্যমণি হয়ে গলা ছেড়ে চেঁচামেচি করে, আবার ভিন্ন ভাবনায় হারিয়েও যায়!
রাত বেশ গড়িয়ে যায়। পাইনের ফাঁক দিয়ে ভাঙা চাঁদের উদাস আলো ঝুলবারান্দায় চাদর বিছিয়ে দেয়। দূরে পরিষ্কার আকাশে শেষ রাতের নক্ষত্রটা বাড়তি আলো নিয়ে জ্বলজ্বল করে। পাখিরা পাইনের শাখের নীড় থেকে রাত্রির প্রহর জানাতে পাখা ঝাপটায়। রিসোর্টের অদূরে লেকের ধারে মৃগের দল নির্ভয়ে হেঁটে বেড়ায়। রিসোর্টের বাঁ পাশের ঘন ঝোপ থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কালো ভাল্লুক বেরিয়ে আসে। প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতির খুব কাছে ঘেঁষলে তার একটা নিজস্ব গন্ধ পাওয়া যায়। প্রকৃতির সেরূপ গন্ধে ভরা মাতাল হাওয়া এদের আচ্ছন্ন করে রাখে। প্রকৃতির এমন ঘোর আবহের সান্নিধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে একটা সময় পর সবাই চুপচাপ হয়ে প্রকৃতির নিজস্বতায় ডুবে যায়। এমন একটা সময়ে বেলি ঢুকরে কেঁদে ওঠে। গলার কাছে শব্দরা এসে জমাট বেঁধে থাকে। বন্ধুরা হঠাৎ এমন অচেনা পরিস্থিতিতে হকচকিয়ে যায়। বেলি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এরপর খানিকটা সময় নেয় এবং বার কয়েক দীর্ঘনিঃশ্বাস শেষে বন্ধুদের উদ্দেশ করে বলে, ‘আজ আমি তোদের একটা গল্প বলব। নীলপদ্ম নামের একটি মেয়ের গল্প।’ শিমুলের চোখেও জল, সে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। বাকিরা প্রগাঢ় মনোযোগে বেলির দিকে তাকিয়ে থাকে। বেলি পাইনের আঁধার-কেটে-ওঠা শাখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে :
বহু বছর আগেকার ঘটনা। সেদিন ঢাকার আকাশে চাঁদ ছিল নাÑকৃষ্ণপক্ষ হবে হয়তো-বা। আকাশ ভেঙেচুরে আষাঢ়ি ঢল নেমেছিল। বিজলি বাতির আলোও দপ করে নিভে যায় সেদিন। এমন এক দুর্দিনে, মিরপুরের এক ক্লিনিকে একটি ‘নীলপদ্মের’ জন্ম হয়। নীলপদ্মের উপস্থিতিতে জগতের কেউ খুশি হতে পারে না, এমনকি তার জন্মদাত্রী মা-ও না! এরপর সেই নীলপদ্ম, ঢাকার এক নিভৃত স্থানে এক কামরার গৃহে অনাদরে এবং একমাত্র মায়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে থাকে। মা-মেয়ের জন্য পৃথিবীর সব আলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়! এর কিছুকাল পরে, প্রায় বছর পেরিয়ে গেলে, হেমন্তের এক আবেগী সকালে নীলপদ্মকে গোপন কুঠুরি থেকে বের করে বিশাল এক অট্টালিকায় নিয়ে আসা হয়। সেই সঙ্গে বৈশাখী দমকা ঝোড়ো হাওয়ার প্রকোপে পড়ে তার মা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অট্টালিকায় অবশ্য সে নতুন মা এবং বাবা দুজনকেই পেয়ে যায়। সঙ্গে হাজারো না- পাওয়াগুলোও। কিন্তু সব পাওয়ার মাঝেও ‘নীলপদ্ম’ গলা উঁচিয়ে দিনরাত তার মায়ের জন্যে কাঁদে। নতুন মা-বাবা তাকে শহরের বড় বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা দেন কিন্তু নীলপদ্মের কান্নারোগ কোনোভাবেই ভালো হয় না। আগের মায়ের চেয়ে নতুন মা-বাবা তাকে কম আদর করেন না, কিন্তু নীলপদ্ম মায়ের হাহাকার ভুলতে পারে না।
বেশ কিছুদিন পর অবশ্য নীলপদ্মের গলা উঁচিয়ে কান্না বন্ধ হয় কিন্তু বুকের পাঁজরে মায়ের আক্ষেপটা শোকের পাহাড় হয়ে শক্ত গিঁট বেঁধে বসে থাকে। দিন-মাস-বছর শেষে দুই যুগ প্রায় পেরিয়ে যায়। নীলপদ্ম ব্যতিব্যস্ত সময়ের ভেতরও তার পাঁজরের ভেতরের অজানা সে কষ্টবোধ ঠিকঠাক টের পায়। সবকিছু থেকেও কী যেন তার জীবনে নেই! একটা শূন্যতাঘেঁষা অস্তিত্ব তাকে দিবারাত্র তাড়া করে ফেরে। সময়ে-অসময়ে পাঁজর-ফাটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। না-ঘুমিয়ে কাটানো রাতগুলো তাকে প্রায় পাগল করে তোলে। বাবা তাকে খুব ভালো বুঝতে পারেন।
একদিন গভীর রাতে নীলপদ্মের প্রতিদিনের স্বভাবমতো ঘুম ভেঙে যায়। ঘুটঘুটে আঁধারে ঢেকে আছে বাইরের পৃথিবী। ঘরে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। নীলপদ্ম ঘরের লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। প্রায় দিন সে অজানা সে ব্যথার তাড়নায় ঘুমাতে পারে না, ঝুলবারান্দায় একা একা বসে থেকে বাকি রাত কাটিয়ে দেয়। বাবা মেয়ের কষ্ট বোঝেন, কেঁদেকেটে তিনিও নির্ঘুম রাত পাড়ি দেন, যদিও নীলপদ্ম সেসবের কিছুই টের পায় না।
সেদিন বাবা নিঃশব্দে মেয়ের পাশে এসে বসেন। বাবাকে কেমন জানি সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয়। নীলপদ্ম অবাক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা তার মাথায় হাত রাখেন। মেয়েকে বুকের ওপর চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। নীলপদ্ম ভীষণ অবাক হয়! এ জন্মে বাবাকে সে কাঁদতে দেখেনি। এ সময় মা-ও সেখানে এসে দাঁড়ায়। দুজনে মিলে সমস্ত ঘটনা তাকে খুলে বলেন। নীলপদ্মের কাছে গোপন ব্যথার রহস্য স্পষ্ট হতে সে চূড়া-ভেঙে-পড়া পাহাড়ের মতো মুচড়ে পড়ে। বাবা-মা তাকে সেই মায়ের ঠিকানা জানায়।
নীলপদ্ম মায়ের ঠিকানা নিয়ে হন্যে হয়ে মাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু মাকে পাওয়া হয় না। তত দিনে মা দেশ ছেড়ে বহুদূরে সাত সমুদ্রপাড়ের দেশে চলে গেছেন। নীলপদ্ম একসময় দেশের বাইরে চলে আসে মায়ের অন্বেষণে। কিন্তু মায়ের বিদেশের ঠিকানা কেউ তাকে দিতে পারে না। ঠিকানাবিহীন মাকে খুঁজে পাওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। অল্প কিছুদিন আগে বহু ঝামেলা পেরিয়ে মায়ের এক বন্ধুর সন্ধান পাওয়া যায় এবং সে জানায়, আমেরিকার এই পাহাড়ের দেশে মা আছেন। কিন্তু বেশ ক’বছর হয়েছে বন্ধুর সঙ্গেও মায়ের যোগাযোগ নেই। মা নাকি ইচ্ছে করে সবার সঙ্গে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করছিলেন।
নীলপদ্ম বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মাকে খুঁজে বের করবে বলে ঠিক করে। বন্ধুদের কাছে অবশ্য সে সবকিছু গোপন রাখে। এখানে এসে সবাইকে একসঙ্গে জানাবে বলে ঠিক করেছিল। মায়ের একখানা ফটোগ্রাফ তার কাছে আছে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে এই একমাত্র চিহ্ন সে তার মায়ের পেয়েছে। তারা হয়তো এই সময়ের মুখোমুখি হতে হবে, আগাম-আন্দাজ করেছিলেন, তাই মায়ের একখানা ফটোগ্রাফ যত্ন করে এত দিন ধরে বয়ে নিয়েছেন। একমাত্র সম্বল সেই ফটোগ্রাফটা বুকে আগলে মাকে ছুঁয়ে দেখবে বলে নীলপদ্ম কানাডা থেকে ছুটে আসে আমেরিকার এই পাহাড়ের রাজ্যে।
কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ওরা যখন ক্যাবে উঠে বসে, ক্যাব ড্রাইভার শিমুলের দিকে চোখ পড়তে নীলপদ্ম চমকে ওঠে। তার হাতে-ধরা ফটোগ্রাফের মুখটা হুবহু শিমুলের মুখে বসানো। এরপর আর হন্যে হয়ে মাকে পাহাড়ে পাহাড়ে খুঁজতে হয় না। শিমুলের কাছ থেকে মায়ের আদ্যোপান্ত জানা হয়ে যায়।
শিমুল তার মায়ের পেটের ভাই। মা নীলপদ্মকে একটিবার নিজ চোখে দেখবেন বলে শিমুলকে নিয়ে দেশে ফিরে যান। হন্যে হয়ে দেশের আনাচ-কানাচে খুঁজে ফেরেন মেয়েকে কিন্তু কোনো হদিস মেলে না। শেষমেশ শিমুল ফিরে আসে এ দেশে। মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঢাকায় থেকে যান মা। বিভিন্ন মাধ্যমে মেয়ের খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু ঠিকানাবিহীন মেয়েকে খুঁজে পাওয়া হয় না। এমন দুর্ভেদ্য ধকল মা বেশি দিন সইতে পারেন না। একটা সময় পর তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

কমেন্ট বক্স