চারটি শিশু। বয়স ৮-৯ বছর। প্রতিদিন একসঙ্গে স্কুলে যায়। ইজিপশিয়ান-জ্যামাইকান আমেরিকান বাঙালি। ভীষণ বন্ধুত্ব।
পবিত্র ঈদ। বাঙালি মা। নিজ হাতে চারজনকেই আদর করছেন। খাবার তুলে দিচ্ছেন।
মেরি ক্রিস্টমাস। একই রকম ড্রেস। আমেরিকান ভদ্রমহিলা গিফট করেন। চার শিশুই খুব খুশি। ইজিপশিয়ান মা অসুস্থ। জ্যামাইকান ভদ্রমহিলা তার শিশুকে দেখাশোনা করেন। কিছুদিন স্কুলে Pick UP এবং Drop off এই দুটি কাজ চালিয়ে যান। চার শিশুরই ভিন্ন কালচার। কিন্তু মায়েদের এই শিক্ষা আমাকে উৎসাহিত করে। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অপূর্ব বন্ধন।
আজকাল আমরা দুজনে অনেক ভুল করি। মেয়ে সংশোধন করিয়ে দেয়। বুঝতে পারিÑবয়সটাই সব। ঘর এলোমেলো করে রাখি। মেয়ে দুজনকেই জানায়-এলোমেলো জিনিস বিষণ্নতা বাড়ায়। গুছিয়ে রাখবে। জি হুজুর জি হুজুর করে চলি-কারণ কথাটা সঠিক বলছে। দুজনকেই আবার শাসন-
শোনো, সকালের কাজ অসমাপ্ত রাখবে না। সকালেই করবে। আর বিকেলের কাজ যথাসময়ে করবে।
দুজনেই জানতে চাই-
সঠিক সময়ে না করলে কী হয়?
আবারও তিরস্কার-
Timely আর Properly কাজ না করলে Success আসবে না।
বুঝতে পারি কথাটার গভীর অর্থ। Timely আর Properly কাজ করা প্রয়োজন, Others অসম্ভব।
মাঝেমধ্যে দুজনেই ভাবি, বেশি বলছে না তো? আবার ফিরে আসি। একেবারেই না। কারণÑএকুশ শতক-স্যাটেলাইটের যুগ-কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ- মাল্টিলিংপুয়াল আরও কত কী? এরা ঘড়ির কাঁটার আগে চলে। নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন। নতুন প্রজন্মের ভাবনা সবকিছুই দেশ ও দেশের মানুষকেন্দ্রিক। মানুষ স্বপ্ন দেখে। আমিও অনেক কিছুই স্বপ্ন দেখি। কেউ নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, পরিবারকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। সবাই ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। অনেকে ক্যারিয়ারের স্বপ্ন দেখে, দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কেউ না ঘুমিয়েই স্বপ্ন দেখে। জাগ্রত থেকেও কেউ স্বপ্ন দেখে। আমার স্বপ্ন আর আমার প্রজন্মের স্বপ্নে পার্থক্য থাকতেই পারে। আমি ঝিমিয়ে পড়া একজন। অন্তত বয়স তা-ই বলে। আর আমার সন্তান-আমার প্রজন্ম আমি দেখতে পাই-সবুজের জয়গান নবীনের পথচলা-আরও অনেক কিছুই। স্যাটেলাইট যুগের প্রজন্ম। ওরা প্রগতিশীল। আমরা অনেক কিছুই বুঝি না-জানি না-চিনিও না। আমাদের স্বপ্ন এখন ওদেরকে ঘিরেই। ওদের হাত ধরেই এখন আমাদের পথ চলতে হবে। ওরা নতুন কিছু করতে চাইছে। নতুন কিছু ভাবতে বসেছে। খুবই স্বাভাবিক। প্রবীণের অভিজ্ঞতা আর নবীনের সাহসিকতা, মেধা-এই দুয়ের মিলন-স্বতন্ত্র চিরন্তন।
আঠারো কোটি মানুষ সোনার বাংলাকে ভালোবাসে, রূপসী বাংলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, যেখানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবেÑদেখতে পাবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। প্রজন্ম আমাদের অহংকার। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ায় সম্পৃক্ত হয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে-এই আমাদের সবার প্রত্যাশা।
ফিরে আসি সেই ছোট্ট চার শিশুর গল্পবলা নিয়েÑকোনো দ্বন্দ্ব নেই, সংঘাত নেই, হতাশা নেই-চারজন পাশাপাশি বেড়ে উঠছে। নিজেকে গড়ার এখনই সময়। আঠারো কোটি মানুষের প্রয়াস হোক-সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব।
যারা শহীদ হয়েছেন, তারা চিরজীবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনবোধ কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে গেল : ‘আপন গলার বকুল মাল্য গাছা- আয়রে অমর আয়রে আমার কাঁচা।’
আমাদের সবার অনেক দায়িত্ব বেড়ে গেছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হিংসা-অহমিকা, ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করার ‘এখনই সময়’। দল-বর্ণ-ধর্ম-গোষ্ঠী নবীন-প্রবীণ ছোট-বড় নির্বিশেষে দেশকে ভালোবাসব, দেশের জন্য কাজ করে যাব-এই হোক আমাদের প্রতিশ্রুতি। তা না হলে দেশ অনেক অনেক পিছিয়ে যাবে।
চারটি শিশু যা পারছে, আমাদেরও তা-ই করতে হবে।
‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
লেখক : ফরমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ। ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী। নিউইয়র্ক প্রবাসী।