দাম্ভিকতার ঔদ্ধত্যের অনিবার্য পরিণতিতে দেশ ছেড়ে বেঁচেছেন শেখ হাসিনা। তবে ফ্যাসিস্ট রাজনীতির চিরতরে অবসান হওয়ার বার্তা নেই। সদ্য সাবেক ক্ষমতাসীন দল ও নেতাদের অনিরাপদ রেখে জনরোষের মুখে পরিবারের কিছু সদস্যকে আগেভাগে সরিয়ে দিয়ে কেবল ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ঘটনা মানতে পারছেন না আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীরা। তাদের প্রশ্ন, তিনি যদি দেশ ছেড়ে যাবেনই, তাহলে কেবল শেখ পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে শেষ মুহূর্তে দলের নেতা-কর্মীদের কেন আন্দোলনকারীদের তোপে ফেলে গেলেন?
দল ও সরকারের আরও কয়েকটি সূত্র বলছে, পদত্যাগে সই করার আগ পর্যন্ত ক্ষমতা না ছাড়ার ব্যাপারে অটল ছিলেন শেখ হাসিনা। ঘনিষ্ঠ ও হিতাকাক্সক্ষী দু-তিনজন সচিবসহ কয়েকজন তাকে বলেছিলেন, আর আক্রমণাত্মক না হয়ে শেখ হাসিনাকে নমনীয় হতে। কিন্তু তিনি তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। বলেছেন, তার সঙ্গে না থাকলে তারা নিজেরাও বাঁচবেন না। সেই কনফিডেন্সে শেষ সময়েও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আরও রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার কিছু আয়োজন করতে থাকেন তিনি। পদত্যাগের ঘণ্টা দুয়েক আগেও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ধমকান। চাপ দিতে থাকেন গোটা দেশ রক্তাক্ত করে দিতে। আর দলীয় কয়েক নেতাকে হুকুম দেন, আন্দোলনকারীদের যেখানে পাবে সেখানেই যা ইচ্ছা তা করতে। তারা এটা-সেটা ঘটিয়ে ফেলবেন বলে হম্বিতম্বি করলেও বাস্তবে মাঠেই নামেনি। ততক্ষণে আন্দোলনকারীরা রাজপথে সেনাবাহিনীর সাথে মোলাকাত করতে থাকে। তাদের সাঁজোয়া যানে উঠে লাল রং ছিটাতে থাকে। মাঠের চিত্র শেখ হাসিনাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে তারা শেখ রেহানার সঙ্গে কথা বলেন। একপর্যায়ে ফোনে কথা বলেন বিদেশে থাকা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গেও।
একপর্যায়ে তিনি পদত্যাগে রাজি হন। তাও কালক্ষেপণ করতে থাকেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কে ফুফাতো বোনজামাই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে তার প্রতি একচ্ছত্র সমর্থন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে কথা বলেন ওইপক্ষের কয়েকজন আত্মীয়ের সাথে। সমান্তরালে কথা বলেন বিদেশে কয়েকটি বন্ধুদেশের প্রভাবশালীদের সঙ্গেও। তারা সায় দেননি। তবে একটি দেশের বুদ্ধিতে তখন তিনি জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ভাষণ রেকর্ড করার ব্যবস্থা করার নির্দেশও দেন। সেটায়ও কুলাতে পারেননি। ততক্ষণে গোয়েন্দা তথ্য আসে দ্যাটস ঠু লেট। পদত্যাগে যত দেরি হবে, তত বিপদ আরও বাড়বে। আন্দোলনকারীরা এগোচ্ছে গণভবনের দিকে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই তারা পৌঁছে যেতে পারে গণভবনে। এ সময় কেবল ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে হেলিপ্যাডে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সেখানে তাদের কয়েকটি লাগেজ ওঠানো হয়। তারপর ছোটেন বঙ্গভবনে। সেখানে কাগজপত্র তৈরি করাই ছিল। এতে একটি সই করেই ফেরত আসেন হেলিপ্যাডে। দ্রুত একটি সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতের উদ্দেশে চম্পট। অন্য একটি সূত্র বলছে, সময়স্বল্পতার কারণে বঙ্গভবনে নয়, গণভবনেই তিনি পদত্যাগপত্রে সই করেন।
শেখ হাসিনা না পালিয়ে কারাগারে গেলে এমন দুর্গতিতে পড়তেন না বলে নিশ্চিত তার দলের নেতারা। তাদের যুক্তি হচ্ছে, গণ-অভ্যুত্থানে প্রয়াত স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতন হলেও দেশ ছেড়ে পালাননি; জেলে গেছেন। এতে তিনি পরে বারবার সংসদ নির্বাচনে জিতেছেন। তার দলও টিকে আছে। শেখ হাসিনা দলকে এবং দলের নেতাকর্মীদের জন্য সেই অবশিষ্টও রেখে যাননি। টানা ক্ষমতাকালেও তিনি স্বজনদেরই যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ ও যুক্তি তাদের। বিদায়ের সময়ও তা-ই করলেন। বাদবাকিদের রেখে গেছেন অনিরাপদ করে।
পদত্যাগের পর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন সোমবারও শেখ হাসিনা তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেননি কাউকে। চেয়েছিলেন তারা মাঠে অ্যাকটিভ থেকে মরুক বা বাঁচুক। শেখ হাসিনা নিজের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও অন্যদের বাঘের মুখে ফেলে রাখার ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন। এ অবস্থায় এখনো দেশে অবস্থান করা নেতাকর্মীরা অনেকটা হতবিহ্বল। হাতে গোনা কিছু সংখ্যক রয়েছেন বিএনপির কয়েক নেতার আশ্রয়ে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে কয়েকজনকে রোববার রাতে ও সোমবার সকালে দেশ ছেড়ে যেতে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির অন্তঃরাজনীতিতে এ নিয়ে নানা কথা ঘুরছে। সমমনা দল ও নেতাদের মধ্যেও এ নিয়ে কুকথার শেষ নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণও আছে কারও কারও কাছে। নিজেদের মধ্যে এসব কথা বেশ চালাচালি হচ্ছে।
বেশি সমালোচিত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, হাছান মাহমুদ, আসাদুজ্জামান খান, মহিবুল হাসান চৌধুরী, মোহাম্মদ এ আরাফাত, আবদুর রহমানসহ বেশির ভাগ মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতা রোববার পর্যন্ত দেশেই ছিলেন। সোমবার দিনের মধ্যভাগ পর্যন্ত কয়েকজনের মোবাইল খোলা ছিল। বেলা একটা-দেড়টা থেকে বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময়ের মধ্যে কেউ কেউ হয় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন, নইলে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদ এলাকাতেই ছিলেন দুপুর পর্যন্ত। দুপুরের পর উধাও। তবে ফোন খোলা ছিল বিকাল চারটার আগ পর্যন্ত।
আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, শেখ রেহানাও সব জানতেন না। তিনি দেশে ফেরেন আগের দিন রোববার। জানতেন না পরদিনই তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আগে থেকেই আছেন ভারতে। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় আগে থেকেই দেশের বাইরে। শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি কয়েক দিন আগে একবার এসেই আবার চলে গেছেন। বিএনপির সঙ্গে ভালো যোগাযোগ থাকা কয়েক নেতা পরিস্থিতি বেগতিক ধারণা পেয়ে স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়েছেন আরও আগেই। তা জানাজানি হওয়ায় বিএনপির ক্ষুব্ধ নেতাদের মধ্যে এখন রীতিমতো আক্রোশ কাজ করছে। এ নালিশ ও তথ্য গুলশানে বেগম খালেদা জিয়া ও লন্ডনে তারেক রহমানের কাছেও পৌঁছানো হয়েছে। আপাতত ধৈর্য ধারণ করতে বলা হয়েছে তাদের। এদিকে পদত্যাগের পর গণভবন থেকে পালিয়ে ভারতে যান শেখ হাসিনা। প্রথমে তিনি কলকাতায় যেতে চাইলে মমতা ব্যানার্জি আগ্রহ না দেখায় তিনি ত্রিপুরার আগরতলায় যান। সেখান থেকে সন্ধ্যা ৫টা ৩৫ মিনিটে ভারতের রাজধানী দিল্লির উপকণ্ঠে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান। তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাননি, তবে লন্ডনে থাকার জন্য যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। যুক্তরাজ্য সরকার শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে শত শত মানুষ গুম ও গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে না। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার ভিসা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নিরুপায় হয়ে তিনি আরেক স্বৈরশাসক লুকাশেঙ্কার দেশ বেলারুশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন বলে জানা গেছে।