বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মানি এক্সচেঞ্জগুলো সময়মতো অর্থ পাঠাতে পারছে না। ইন্টারনেট-নির্ভর সার্ভার ব্যবহার করে দেশে অর্থ পাঠানোর কারণে ওই সময়ে ইন্টারনেটসহ বিদেশের সঙ্গে প্রায় সকল যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলো রেমিট্যান্স পাঠাতে না পারায় নিরুপায় হয়ে পড়ে। এতে তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তারা রেমিট্যান্স না পাঠাতে পারায় দেশে কাঙ্খিত রেমিট্যান্স যায়নি। পাশাপাশি মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলো প্রতিদিনের, প্রতি সপ্তাহের, প্রতি মাসের যে টার্গেট থাকে, তা জুলাইয়ে পূরণ করতে পারেনি। এতে মানি এক্সচেঞ্জগুলোর লোকসান হয়েছে। দেশেরও লোকসান হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স জুলাইয়ে যাওয়ার কথা, তা যায়নি। ব্যাংকগুলোরও ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো সম্ভব হলে যে পরিমাণ আর্থিক লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। আর যেসব পরিবারের কাছে অর্থ প্রেরণ করার কথা, তা-ও যায়নি। সানম্যান গ্লোবাল এক্সপ্রেসের সিইও এবং এবিএএসটিএর প্রেসিডেন্ট মাসুদ রানা তপন বলেন, ১৭ থেকে ২৬ জুলাই ১০ দিনে যে ব্যবসা হওয়ার কথা, এর মধ্যে আমরা ৯ দিনের ব্যবসা হারিিেছ। এক দিনের ব্যবসা করেছি। প্রতিদিন আমরা কমপক্ষে এক মিলিয়ন ডলার দেশে পাঠাই। ১৭ থেকে ২৩ জুলাই কোনো অর্থ পাঠাতেই পারিনি। ২৭ ও ২৮ জুলাই থেকে চালু হলেও ২৮ তারিখ মাত্র দুই লাখ ডলার পাঠিয়েছি। আমার হিসাবে আন্দোলনের সময় দেশে ৭০০-৮০০ মিলিয়ন ডলার যায়নি। তিনি বলেন, যতটা ক্ষতি হয়েছে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে অনেক প্রবাসী ইন্টারনেটে বার্তা দিয়ে দেশে বৈধ পথে না পাঠিয়ে অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করায়। যারা ফেসবুক ও অন্যান্য মিডিয়ায় এ ধরনের প্রচারণা চালিয়েছে, তাদেরকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কারণ কোনো দেশে বসে অবৈধ পথে মুদ্রা প্রেরণে উৎসাহিত করা অপরাধ। তাই চাইলে আমেরিকার সরকারও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যারা আন্দোলন করেছেন, তাদের অনেকেই প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন প্রবাসীদের দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স না পাঠানোর। কেউ কেউ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করার বিষয়টি উৎসাহিত করেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছেন। ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
সূত্র বলছে, দেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান হয়েছে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ক্ষতি হয়েছে। সেই সঙ্গে বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেনি। ফলে সময়মতো তারা অর্ডার দিতে পারেনি। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকারকেরা পণ্য সময়মতো সরবরাহ করতে পারেননি। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক।
সানম্যান গ্লোবাল এক্সপ্রেসের ফাইন্যান্সিয়াল ডিরেক্টর আমিনুল ইসলাম বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন চলছিল, তখন আমরা দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ করতে পারি। কারণ আমরা অনলাইনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেই অর্থ দেশে পাঠাই। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ করার পর টাকা পাঠানো আর সম্ভব হয়নি। অনেকেই চেষ্টা করেছেন, তাও পারেননি। ওই সাত দিনে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আমরা হারিয়েছি। এখনো পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছে।
হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, আন্দোলনের সময় আমরা যেমন অর্থ পাঠাতে পারিনি, অন্যান্য এক্সচেঞ্জও পাঠাতে পারেনি। এ কারণে অনেকেই লোকসানের মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, তারাও লোকসানের মুখে পড়েছেন। কেবল পরিবার-পরিজনদের জন্য এখান থেকে মানুষ রেমিট্যান্স পাঠায়, বিষয়টি এমন নয়। অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থাপনা তৈরিসহ বিভিন্ন কাজেই রেমিট্যান্স পাঠান। আসলে সার্বিকভাবে অনেকেই ক্ষতির সম্মুখীন। তবে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না। জুলাই মাসের কয়েক দিনের আন্দোলনে আমরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে না পেরে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর অনেকেই কিছু কিছু পাঠাচ্ছেন, তবে তা কম। এখনো অনেকেই অপেক্ষা করছেন পরিস্থিতি দেখার জন্য। বিশেষ করে, অনেকেই ভয়ে আছেন বিদেশ থেকে দেশে অর্থ পাঠানো ব্যক্তিদের তালিকা করা হয় কি না, তারা কোথায় কার কাছে অর্থ পাঠাচ্ছেন এগুলো মনিটর করা হবে কি না। পরিস্থিতি সম্পূর্র্ণ স্বাভাবিক হলে তখন রেমিট্যান্স পাঠানোও স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে।
সোনালী এক্সচেঞ্জের একজন কর্মকর্তা বলেন, যে কদিন দেশে অনেক আন্দোলন ছিল, ইন্টারনেট যোগাযোগ ছিল না, সার্ভার কাজ করেনি, তখন আমরা অর্থ পাঠাতে পারিনি। অফিস আমরা খোলা রেখেছি। কিন্তু পাঠানোর উপায় না থাকার কারণে কিছু করার ছিল না। এখন পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আবারও মানুষ রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করেছে।
সোনালী এক্সচেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত সিইও নবাব হোসেন বলেন, দেশে আন্দোলন চলাকালে আমরা রেমিট্যান্স পাঠানোর লক্ষ্য পূরণ করতে পারিনি। আমরা অফিস খোলা রেখেছি। কিছু কিছু রেমিট্যান্স পাঠিয়েছি। আমাদের ইন্টারনেট বন্ধ ছিল না। আমরা সব সময় যে মাধ্যমে পাঠাই, তাতে না পাঠাতে পারায় বিকল্প উপায়ে পাঠিয়েছি। তাই বলব, অন্য এজেন্সিগুলো রেমিট্যান্স পাঠাতে না পারলেও আমরা কিছু কিছু পেরেছি। আর ওই সময়ে মানুষও বেশি আসেনি। যারা পাঠাতে চান, তারা দেশে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় অর্থ পাঠাতে আসেননি। এখন মানুষ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, তবে আগের মতো নয়।