তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের স্টুডেন্ট। এক বান্ধবী আর আমি ডিসিশন নিলাম বিসিএস পরীক্ষা দেব। আমি ঠেলতে ঠেলতে একবারও ভাইবা পর্যন্ত যেতে পারিনি। আমার বান্ধবী তিন-তিনবার পৌঁছাল। সে আমাকে জানায়, যদি অ্যাডমিন হয় খুব খুশি হব। আর যদি পুলিশ ক্যাডারে পাই আরও খুশি হব।
আমি হাসি। ও হ্যাটট্রিক। আর কয়টা হ্যাটট্রিক দিবি?
বান্ধবী মন খারাপ করে। বলে, আমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলিস কেন? আমি কী? মাথায় কিছু আছে? হ্যানড্রেড পারসেন্ট ঠিক মনে নেই। পরে দুজনেই স্বীকার করি, বন্ধু-বান্ধবী যারা উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের মেধা আমাদের চেয়ে শতগুণের বেশি। আর পরিশ্রমের তো তুলনাই নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের দুজনের মেধা, মনোযোগ, পরিশ্রম, অধ্যবসায়-এসব উপস্থিত ছিল না।
প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময়ের পূর্বের কথা। ভদ্রমহিলা ছেলের বউ দেখতে যাবেন। তখনকার সময়ে বংশমর্যাদা, পারিবারিক অবস্থান, মানদণ্ড-এসব বিবেচনায় রাখা হতো সবার আগে। পরে সৌন্দর্যের ব্যাপারটি তো থাকছেই।
কিন্তু এই ভদ্র মহিলা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। জানিয়ে, না জানিয়ে যে ছেলের বউ দেখতে যান। একটি চেয়ার টেনে মেয়েটির পাশে বসেন।
মেয়ে দেখতে গিয়ে মেয়েটির কাছে জানতে চান, তুমি কোন সাবজেক্টে পড়ছ মা? মেয়েটির সাবলীল উত্তর-English..
বিসিএস দিচ্ছ?
জি।
তোমার First preference কী?
মেয়েটির আরও সুন্দর উত্তর।
আচ্ছা, Last Preference কী?
মেয়েটি গুছিয়ে বলছে।
ভদ্রমহিলা আরও গুছিয়ে শেয়ার করেন-First Preference এটা কেন? Last preference-ইবা ওমন কেন?
বাকি সবাই আরও অবাক!
মহিলা কি PSC Board-এর member? এত কিছু কী করে জানে ও বোঝে।
সর্বশেষ সাজেশন-শোনো,teaching দেবে। এবার যদি না হয় Next time দেবে। কারণ Teaching ক্যাডার Service হওয়া চাই।
Prestigious job.
মেয়েটি বিনয়ের সঙ্গে সায় দেয়। ভদ্রমহিলার ছেলে বিসিএস ক্যাডার এবং অ্যাডমিন। নিজ হাতে ছেলেকে বুঝিয়ে দেন-Final preference কী হবে আর Last preference-ইবা কী হবে।
কোনো রকম Institutional যোগ্যতা তার ছিল না। ছেলেকে একপর্যায়ে নিয়ে যান।
এ রকম অনেক মায়ের কথা আমি জানি। ছেলেমেয়েদের জানিয়ে দেন। অন্তত বিশ ঘণ্টার পড়া চাই। টেবিলে বই দিয়ে বসিয়ে রাখেন।
অশান্ত বৈরী বাতাসে জানা-অজানা অনেক কচি প্রাণ হারিয়ে গেছে। সন্তানের জন্য এসব মায়ের বিচিত্র সাধ্য/ আজ সাধ্যের বাইরে।
তাদের সন্তান তাদের হৃদয়ের ধন। আজ চোখের জলে কথা বলছেÑসর্বকালের মা!
একজন মেধাবী সন্তান পরিবারের সম্পদÑসমাজের সম্পদÑদেশের সম্পদÑবিশ্বের সম্পদ।
অভিভাবকের মেধাবী সন্তান। হয়তো হতে পারত সফল, সার্থক ও প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব।
আমি অবশেষে নিজের মুখ দেখি। আমিও একজন মা, ব্যথিত চিত্ত। কত মায়ের সাধ কালের অতলে হারিয়ে গেছে। ক্লান্ত অবসন্ন তাদের মন।
চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে আছে শান্ত কচি প্রাণ। কেন জানি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘বিদায়’ কবিতার শেষের চারটি লাইন মনে পড়ে গেল।
‘পুজোর কাপড় হাতে কবে মাসি যদি শুধায় জোরে
খোকা তোমার কোথায় ডোল চলে,
বলিস খোকা, সেকি হারায় আছে আমার চোখের তারায়
মিলিয়ে আছে আমার বুকে কোলে।’
লেখক : ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, নিউইয়র্ক প্রবাসী।
ফরমার অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল অব বাংলাদেশ।