১৯৭১ সালের নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে লন্ডনপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে নিয়ে জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরীর ভূমিকা ছিল স্মরণীয় আরেক অধ্যায়। তাঁর সফল নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থার সম্মানজনক মীমাংসার উদাহরণ ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রায় ৩০০ জন এমপির লিখিত সমর্থন আদায় করে নেওয়ার মতো বিরল ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিলেতপ্রবাসী সিলেটিদের সম্পর্কে বলেন, ‘সিলেটিরা হচ্ছেন আমাদের দুর্দিনের বন্ধু। আমি সিলেটিদের ঋণ শোধ করতে পারব না কোনো দিন।’ আর এই প্রবাসী সিলেটিদের সম্পর্কে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর মন্তব্য ছিল : ‘এরা আমাদের রিজার্ভ ফোর্স।’ মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪) সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে অনেক বাংলাদেশি যারা জাতীয়তার সূত্র ধরে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন, তারা জাহাজি নাবিক হিসেবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন-পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ বাণিজ্যবহরের চাকরিতে পূর্বাঞ্চলীয় ওইসব জাহাজির সংখ্যা ছিল নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যমতে, প্রায় দেড় লাখ। এসব সমুদ্রগামী নাবিকের মধ্যে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর মানুষ থাকলেও বৃহত্তর সিলেটের মানুষ ছিলেন প্রায় ৭৫ শতাংশ। এই জাহাজি নাবিকেরা একসময় জাহাজ ছেড়ে বা জাহাজি চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে সোজা কথায় অধিকাংশ নাবিক পালিয়ে গিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় বসতি গড়েন। এই ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন :
‘সে দিন নিশীথ বেলা
দুস্তর পারাপারে সে যাত্রী একাকী ভাসালো ভেলা,
প্রভাতে সে আর ফিরিল না কূলে, সেই দুরন্ত লাগি
আঁখি মুছে আর রচি গান আমি আজিও নিশীথে জাগি।’
প্রবাসীরাই দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। এই মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রবাসীদের সমস্যা ও দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। প্রবাসীরা ঘাটে ঘাটে শোষণ আর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
তাই ১৯৭৩ সালের শেষে জেনারেল এমএজি ওসমানী তার এক জনসভায় বলেছিলেন, এটা অনস্বীকার্য সত্য, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করেছিল। তাঁদের পরেই বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা ছিল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রবাসীদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এমএজি ওসমানী প্রমুখ। তথাকথিত আগরতলা মামলায় প্রবাসীরা প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে ঢাকা পাঠিয়ে মামলার ইতি টেনে গণ-আন্দোলনের এক অনন্য অবদান রেখেছেন, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর বাংলাদেশের কোষাগারে মাত্র ১১ পাউন্ডের বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর প্রবাসী নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কর্তৃক পৌনে চার লাখ পাউন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। এটা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম চালান। অর্থগুলো সিলেটি প্রবাসীদের চাঁদা, স্বাধীনতার প্রথম বছরে ইংল্যান্ড প্রবাসীরা ১০ কোটি টাকা প্রেরণ করেন। ফলে কোষাগারে কিছুটা প্রাণ সঞ্চার হয়। গ্রেট ব্রিটেন হচ্ছে সিলেটিদের দ্বিতীয় আবাসভূমি। সিলেট অঞ্চলের লোকজন কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য গ্রেট ব্রিটেনে যাত্রা করেছিল। অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিয়েছেন বা নিয়েছিলেন।
সিলেটিরা যেন আরবি উপন্যাসের দুঃসাহসী নাবিক সিন্দাবাদের মতো। মেজাজ ও মননের পাটাতনে বাসা বেঁধেছে হজরত শাহজালালের (রহ.) শৃঙ্খলমুক্ত আজাদ জালালি কৈতরের তাছির :
‘উঁচু ডালে বাঁধে নীড়
সাহারায় ওরা ধুঁকে মরে
তবু শিকল পড়ে না পদ্ধতির।’
কবি ফররুখ আহমদের ভাষায় :
‘কেটেছে রঙিন মখমল দিন নতুন সফর আজ
শুনেছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক।...
ছিঁড়ে ফেলো আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ
নতুন পানিতে পাল তুলে দাও হে মাঝি সিন্দাবাদ।’
প্রবাসীরা আমাদের আত্মার আত্মীয় ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের অবদান দেশ ও জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখবে।
ইদানীং যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করায় প্রবাসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন প্রবাসীরা। যারা আওয়ামী-বিএনপি বা অন্য দলের রাজনীতি করেন বা সমর্থক, তারা একে অন্যকে দুষছেন। কিন্তু সাধারণ প্রবাসীরা বলছেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞার অন্য দায়ী রাজনীতিবিদেরা। তাদের কারণেই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
নিউইয়র্কের প্রবাসীরা তাদের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কিংবা অন্য বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়Ñসেটাই রীতি। কিন্তু আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা মুখোমুখি হতে চান না। তারা সবকিছুই রাজপথে ফয়সালা করতে আগ্রহী। দেশের রাজনীতি নিয়ে লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকেরা কথা বললে রাজনীতিবিদেরা সুনজরে দেখেন না। তারা ভাবেন, এ নিয়ে আর কারও কিছু বলার দরকার নেই। নেতারা যা ভাবেন, সেটাই শ্রেষ্ঠ ভাবনা। যা করেন, সেটাই শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্র।
অন্যদিকে নিউজার্সি থেকে যুবলীগ নেতা রাসেল, মুকিত, হাফিজুর ও তাজউদ্দিন বলেন, আমরা দেশে একটি সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চাই। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতা ভবিষ্যতে আরও বড় হতে পারে, যা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। প্রবাসী হিসেবে আমরাও লজ্জিত হব। তাঁরা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধের ঘটনাটি দেশের জন্য লজ্জা ও অপমানজনক।
বাংলাদেশের জন্মের আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশটির অগ্রগতিতে প্রবাসীদের বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। দেশের মন্ত্রী-নেতারাও সুযোগ পেলেই মঞ্চে কথাটি স্বীকার করে সংশ্লিষ্টদের তৃপ্তি দিতে সচেষ্ট থাকেন। দেশটির রিজার্ভের ক্রমশ স্ফীতিতে কর্তারাও খুবই তুষ্ট। তা ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, এটি সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। এটি বন্ধ হয়ে গেলে বা হ্রাস পেলে তা দেশটির অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কারণ, বাংলাদেশের বিদেশি দেনা প্রবাসীর পাঠানো এই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকেই পরিশোধ করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑপ্রবাসী আয় কমছে কেন?
ধীরগতিতে হলেও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের জন্য তা একসময় সংকট তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাংক কর্মকর্তারা জনশক্তি রপ্তানিতে ভাটা, অবৈধ পথে অর্থ প্রেরণ, মুদ্রার দরপতন ও বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যহ্রাস এবং সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতাকে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন।
তবে এ কারণগুলোর পাশাপাশি আমরা মনে করি আরও কিছু কারণে প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণে নিম্নগতি এসেছে। সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে প্রবাসীদের হতাশা ও আস্থাহীনতা। দিন যত যাচ্ছে ততই বাংলাদেশের নৈরাজ্যকর পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রবাসীদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে চরমভাবে নিরুৎসাহিত করছে। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে উঠছে না। এই বিচ্ছিন্নতাই প্রজন্মান্তরে আরও প্রকট হবে। সুতরাং দেশের অন্যান্য নেতিবাচক ইস্যু মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে বড় হওয়া বাঙালির নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে ব্যর্থ হলে প্রবাসী আয়ের অধোগতি ঠেকানো সম্ভব হবে না। এ জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এখনই এগিয়ে আসা উচিত।
তবে আরেকটা বিষয় বাংলাদেশ সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রতিবছর যে অর্থ প্রবাসীরা দেশে পাঠান, সেখান থেকে প্রায় ৫০ জনকে (যারা সবচেয়ে বেশি ডলার, রিয়াল, পাউন্ড পাঠান) নির্বাচিত করে পুরস্কার দেওয়া হোক। এতে অন্য প্রবাসীরা উৎসাহিত হবেন। প্রয়োজনে তাদের ভিআইপি কার্ড দেওয়া হোক। যারা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে, আনন্দ বিসর্জন দিয়ে পরিবারের জন্য, দেশের জন্য এত কিছু করতে পারেন, তাদের তো এগুলো প্রাপ্য। আমরা না হয় এই প্রাপ্য সম্মানীটুকুই তাদের দিই।
আজ যার সঙ্গে কথা নেই, কালই তার অসহায় মুহূর্তে সবার আগে সে হাত বাড়াবে। একজন অসহায়, অপারগ মানুষের জানাজা, দেশে লাশ পাঠানোর জন্য দরদি মানুষের অভাব হয় না। বড় বড় দুঃখকে ছোট করে দেখে কষ্ট লাঘব করতে জানে যেমন প্রবাসের মানুষেরা, তেমনি ছোট ছোট সুখ, ছোট ছোট আনন্দও অনেক বড় করে উপভোগ করতে পারে। পুরোনো প্রবাদÑ‘প্রয়োজনের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু’-সেই চেতনাই প্রত্যেক প্রবাসী তাদের মন ও মননে লালন করেন। তারই প্রকাশ ঘটে প্রবাসী মানুষের বিপদে, সংকটে। ঠিক দেশের ক্ষেত্রেও প্রবাসী মানুষের মনে এই ভাবনাই পোষণ করা হয়। নানা অন্যায়, অবজ্ঞা, প্রবঞ্চনায় যতই ক্ষুব্ধ হোক প্রবাসীরা, প্রয়োজনে কখনোই দেশের প্রতি বিমুখ থাকেন না।
তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে, যে মানুষগুলো রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অক্সিজেন দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর দেওয়া এবং এ রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান প্রদান করা। যাতে করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার এই কারিগররা দেশে ও প্রবাসে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারেন।
তবে আমি আশাবাদী মানুষ, স্বপ্ন দেখি একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। রাতের ভোটের কলঙ্ক থেকে যেন বাংলাদেশ মুক্তি পায়। স্বপ্ন দেখি একটি ঘুষহীন বাংলাদেশ। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে বাংলাদেশÑএই রাজনৈতিক বক্তব্য শুনতে শুনতে আমাদের কান ধরে গেছে। মিথ্যা বুলি আউড়ে ক্ষমতা আঁকড়ে না ধরে বাস্তবিকতায় ফিরে আসা উচিত আমাদের রাজনীতিবিদদের। প্রবাসীদের রক্তের টাকায় আমাদের রিজার্ভ ব্যাংক, সেই ব্যাংকের টাকা পাচার হয়ে যায়, বিচার হয় না। সাগর-রুনীর হত্যার বিচার হয় না, হয় না তনু হত্যার-
আমরা কার কাছে যাব? কোথায় বিচার পাব?
প্রবাসীরা কিছুতেই বুঝতে পারেন না তাদের সঙ্গে কেন হরিহাস করা হয়? কী তাদের অপরাধ, কী তাদের পাপ! দেশকে ভালোবাসা, দেশের জন্য প্রাণের হাহাকার জাগা কি এতই অন্যায়! দেশকে ভালোবাসার বিনিময়ে প্রবাসীরা কি কোনো স্বপ্নই দেখতে পারবেন না?
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি পক্তি ঋণ করে ‘প্রবাস ভাবনা’র উপসংহার টানতে চাই, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবুও আনন্দ জাগে।’ সবার প্রার্থনা-ঝড় আসুক, বিপদ আসুক, প্রয়োজনে সে প্রবাসীদের এই মনটা সজীব-সতেজ থাকে, যেন আমরা ‘সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’-এই চেতনা নিয়ে চলতে পারি।
লেখক : প্রাক্তন ছাত্র ১৯৮১, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, শাহ্ খুররম ডিগ্রি কলেজ ও ভিজিটিং প্রফেসর এমসি কলেজ এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। কলাম লেখক, সাহিত্য-শিক্ষা ও সমাজ গবেষণামূলক বিষয়ে লেখালেখি করেন। পিএইচডি ফেলো।