ইংরেজি পঞ্জিকার হিসাবে ৭ জুলাই রোববার সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইসলামি পঞ্জিকার পাতা থেকে হিজরি ১৪৪৫ অব্দের বিদায় এবং ১৪৪৬ অব্দের শুভসূচনা হতে যাচ্ছে। সেই হিসাবে আগামী ১৬ জুলাই মঙ্গলবার ইসলামের ইতিহাসের অসংখ্য তাৎপর্যমণ্ডিত ও অলৌকিক ঘটনাবলিসমৃদ্ধ পবিত্র আশুরা বা ১০ই মহররম পালিত হবে। পবিত্র কোরআনে আশুরাকে অপরিসীম বরকত ও রহমতপূর্ণ দিবস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বিশ্ব মুসলিম পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, ওয়াজ মাহফিল আয়োজনসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পবিত্র আশুরা পালন করে আসছেন সেই স্মরণাতীত কাল থেকে। বর্তমান বিশ্ব মুসলিমের জীবনেও আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম বললে বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলা হবে না। যাহোক, ঘটনাবহুল হিজরি ১৪৪৫ অব্দে প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের সঙ্গে রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনে এবং বিশ্ব পরাশক্তির বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর ও নিষ্ঠুর হামলায় ৪০ সহস্রাধিক বাস্তুহারা-স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি আবালবৃদ্ধবনিতার তাজা রক্তে গাজা উপত্যকা অহর্নিশ রঞ্জিত এবং মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত হচ্ছে। অথচ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এসব কলঙ্কজনক ও পৈশাচিক অধ্যায়ের সংযোজনের পরও দুর্ভাগ্যক্রমে মানবতার ফেরিওয়ালা ও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছেন না। বরং বিশ্ব পরাশক্তিগুলো নানা অজুহাতে আগ্রাসী শক্তিকে সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে ও ইন্ধন জোগাচ্ছে। অন্যদিকে জাগতিক নিয়মে জন্ম-মৃত্যুর লীলাখেলা ছাড়াও জগৎজুড়ে দানবীয় শক্তির আগ্রাসন ও ক্ষমতার মোহে প্রতিপক্ষের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানোর ঘটনাও বিশ্বসভ্যতাকে কলঙ্কিত করেছে হরহামেশা। তাই হিজরি ১৪৪৬ সালের প্রারম্ভিক পর্বে নির্যাতিত-নিগৃহীত ও স্বাধীনতাকামী বিশ্ব জনগোষ্ঠীর সাফল্য এবং ধরাধাম থেকে মানুষের অবয়বধারী দানবীয় ও অসুরীয় শক্তির সমূল উৎপাটন কামনা করছি। এ ছাড়া যুদ্ধবিগ্রহ-প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও স্বাভাবিকভাবে বিগত বছরে লোকান্তরিতদের বিদেহী আত্মার চিরপ্রশান্তি কামনা ও তাদের স্বজনদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে প্রত্যেক মানুষের অন্তর্নিহিত স্বাভাবিক ও সহজাত মনুষ্যত্ব, মানবতা ও সৌভ্রাতৃত্ববোধের বিকাশ এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে বিশ্ববাসীর সামগ্রিক কল্যাণে বিশ্ব প্রতিপালকের বিশেষ রহমত ভিক্ষা করছি। অধিকন্তু আমরা যারা জাগতিক যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে আল্লাহর রহমতে নতুন হিজরি বর্ষে পদার্পণের সুযোগ লাভ করেছি, তারা সকৃতজ্ঞচিত্তে বিশ্ববিধাতার দরবারে শোকরিয়া আদায় করছি-আলহামদুলিল্লাহ, আমিন!
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মহান আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করতে গিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরবের প্রতিষ্ঠিত পৌত্তলিকদের চরম নির্যাতন-নিগ্রহ ও শোষণের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু পৌত্তলিকদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নবদীক্ষিত মুসলমানের সংখ্যা আশাতীত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পৌত্তলিক গোষ্ঠী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) প্রাণে বধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ পর্যায়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর চাচা আবু তালিব এবং প্রাণাধিক প্রিয় সহধর্মিণী বিবি খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করার পর নবী করিম (সা.) খানিটা মুষড়ে পড়েন। ঠিক সেই মুহূর্তে পরম করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেতশাকুল শিরোমণি হজরত জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ত্যাগ এবং মদিনা বা ইয়াসরিব যাত্রার নির্দেশ পান। অতঃপর একমাত্র সঙ্গী হজরত আবু বকরকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) গভীর রাতে মক্কা ত্যাগ এবং মদিনার উদ্দেশে যাত্রা করেন। তারপর আল্লাহর অপরিসীম কুদরতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও আবু বকর (রা.) প্রতিবন্ধকতার বহু দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় মাড়িয়ে পরিশেষে ইয়াসরিব বা মদিনায় পৌঁছান এবং স্থায়ীভাবে বসবাস ও নব উদ্যমে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা ত্যাগ এবং ইয়াসরিবে স্থায়ীভাবে বসবাসের ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যমণ্ডিত অধ্যায়কে চিরস্মরণীয় করার খাতিরেই সাহাবিদের পরামর্শক্রমে হিজরি সালের প্রবর্তন করা হয়েছিল। হিজরি সাল মূলত চান্দ্রবর্ষ এবং মহররম মাস দিয়ে গণনা শুরু হয় এবং জিলহজ দিয়ে বছরের পরিসমাপ্তি টানা হয়। সৌর দিবসের সূচনা হয় রাত ১২টা ১ মিনিটে; পক্ষান্তরে হিজরি দিবস গণনা করা হয় সূর্যাস্ত এবং পশ্চিমাকাশে চন্দ্রোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে।
আশুরা : আরবি ভাষার আশরা বা দশম শব্দ থেকেই আশুরা শব্দটি উদ্ভূত। মুসলমানদের অবিনশ্বর জীবনবিধান পবিত্র কোরআন এবং হাদিসগ্রন্থে মহররম মাসের দশম তারিখ বা আশুরার দিবসে অসংখ্য ঐতিহাসিক ও অলৌকিক ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। চির উদ্ধত এবং বিশ্বমানবের চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনা ও প্রলোভনে আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া (আ.) আল্লাহর নির্দেশনা বেমালুম ভুলে গিয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে অভিশপ্ত হলেন। তারপর আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি শুরু করলেন এবং অভিশপ্ত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া (আ.) বেহেশত থেকে ভূমণ্ডলে নিক্ষিপ্ত হলেন। কয়েকশ বছর কান্নাকাটির পর আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর অছিলায় মহান আল্লাহ তায়ালা ১০ই মহররম অনুশোচনাগ্রস্ত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়ার (আ.) অপরাধ মার্জনা করেন এবং আরাফার ময়দানে তাঁরা পুনর্মিলিত হন। আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারের অপরাধে নিজ সম্প্রদায়ের পাপিষ্ঠ জনগণ হজরত নুহকে (আ.) বস্তায় পুরে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। নদী থেকে উদ্ধারের পর হজরত নুহ (আ.) আল্লাহর নির্দেশে কিস্তি তৈরি করলেন এবং স্বীয় স্বল্পসংখ্যক অনুসারী এবং জোড়ায় জোড়ায় প্রতিটি পশুপাখি নিয়ে ১০ রজব কিস্তিতে আরোহণ করেছিলেন। অবিরাম এবং প্রবল বর্ষণে গোটা পৃথিবী তলিয়ে গেল এবং স্বীয় অনুসারীদেরসহ নুহ (আ.) এর কিস্তিটি তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সাগরের উত্তাল উর্মিমালার বুক চিরে ছয় মাস ধরে গোটা বিশ^ পরিভ্রমণ করল। অবশেষে ১০ই মহররম কিস্তিটি সিরিয়া বা মুছেলের অন্তর্গত জুডি পাহাড়ের চূড়া স্পর্শ করল (সুরা হুদ, আয়াত ৪৪, অধ্যায় একাদশ)। জুডি পাহাড়ের চূড়ায় কিস্তির মাঝে কিছুদিন অবস্থান শেষে পানি কমে যাওয়ায় আল্লাহর নির্দেশে হজরত নুহ (আ.) তাঁর অনুসারী এবং পশু-পাখিসহ বৃষ্টিবিধৌত ভূখণ্ডে অবতরণ করলেন এবং নতুনভাবে বসতি গড়া শুরু করলেন (সুরা হুদ, আয়াত ৪৮, অধ্যায় একাদশ)।
পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুসারে, আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদ-বিরোধী জালেমদের নির্যাতন এবং নিগ্রহে অতিষ্ঠ হয়ে হজরত ইউনুস (আ.) আল্লাহর সম্মতি ছাড়াই গোপনে স্বদেশ ত্যাগের উদ্দেশ্যে জাহাজে আরোহণ করেছিলেন। পরে ধরা পড়ায় তাঁকে গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হলো এবং প্রথমে একটি মাছ তাকে ও পরে আরেকটি দৈত্যাকার সামুদ্রিক মাছ ইউনুস (আ.) সহ প্রথম মাছটিকে ভক্ষণ করেছিল। দীর্ঘ সময় মাছের পেটে থাকার পর দয়াময় আল্লাহ তায়ালার বিশেষ রহমতে ইউনুস (আ.) ১০ই মহররম সমুদ্রের উপকূলীয় চরায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এবং পুনর্জীবন লাভ করেছিলেন। হজরত মুসা (আ) এবং তাঁর অনুসারী বনি ইসরায়েলের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মিসরের প্রবল প্রতাপান্বিত কাফের ফেরাউনের অমানুষিক নির্যাতনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ১০ই মহররম। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে, অনুসারীদেরসহ হজরত মুসার (আ.) যাত্রা সুগম করার খাতিরে সর্বশক্তিমান আল্লাহ ঐতিহাসিক রেড সি বা লোহিত সাগরের মধ্যভাগে প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলেন। আর ঘোটকীর পশ্চাৎ অনুসরণকারী ইতিহাসধিক্কৃত ফেরাউনের সসৈন্যে সলিলসমাধি রচিত হয়েছিল অতলস্পর্শী রেড সি বা লোহিত সাগরে। ৬১ হিজরিতে ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম মর্মস্পর্শী ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল অবরুদ্ধ ফোরাত নদের উপকূলবর্তী কারবালার প্রান্তরে। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সাহাবি উমাইয়ার ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও লম্পট পুত্র ইয়াজিদের নির্দেশে প্রিয় নবীর (সা.) প্রাণাধিক প্রিয় কনিষ্ঠ দৌহিত্র ইমাম হোসেনকে ৭২ জন সঙ্গী-সাথিসহ নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল ৬১ হিজরির ১০ই মহররম। সংগত কারণেই উল্লেখ করতে হচ্ছে, ঊষর কারবালার অবরুদ্ধ মরুপ্রান্তরে নিহতদের সবাই ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরিবারের পুরুষ সদস্য। লাখ টাকা পুরস্কারের লোভে ইতিহাসধিক্কৃত সীমার হজরত ফাতিমার (রা) জঠরজাত এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর (রা) পরম আদরের ধন এবং বেহেশতে যুবকদের অন্যতম সরদার মুমূর্ষু হজরত হোসেনের শির মোবারক ৬১ হিজরির ১০ই মহররম দেহ থেকে আলাদা করেছিল। তারপর বর্শায় বিদ্ধ করে ইমাম হোসেনের ছিন্নমস্তক নিয়ে পাপিষ্ঠ সিমার নরপশু ইয়াজিদের রাজধানীতে সশরীরের হাজির হয়েছিল। সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড অদ্যাবধি বিশ^ মুসলিমকে বর্ণনাতীত শোকে মুুহ্যমান এবং অশ্রুসিক্ত করে। বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে প্রতিবছর ১০ই মহররম শিয়া ধর্মাবলম্বীরা তাজিয়াসহ শোকমাতম, সুন্নি বিশ^ মুসলিম নানাবিধ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে থাকেন। ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে ১০ই মহররমের বিভিন্ন ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা, বিশেষত কারবালার স্মৃতিচারণা করে বিশ^ মুসলিম অশ্রুসিক্ত ও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কারবালার ঊষর প্রান্তরে মহানবীর (সা.) অসহায় বংশধরদের করুণ কাহিনি ১০ই মহররম উপলক্ষে পর্যালোচনাকালে হায় হোসেন হায় হোসেন আর্ত আহাজারিতে অনেকেই আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলেন।
করণীয় ও বর্জনীয় : পবিত্র হাদিসগ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) পবিত্র রমজানের ফরজ সাওমের পর আশুরার সাওমের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আমি কখনো আশুরা ছাড়া অন্য কোনো দিবসে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে রোজা পালনের ক্ষেত্রে এত বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে দেখিনি। (সহি আল-বুখারি)। আশুরার দিবসের রোজা পালনকারীকে এক বছর রোজা পালনকারীর সওয়াব প্রদান করা হবে বলেও হজরত মুহাম্মদ (সা.) উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, আশুরার তারিখে রোজা পালনকারী ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের মহানবী (সা.) রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। তারা সবিনয়ে উত্তর দিলেন, হে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, এই বিশেষ দিবসে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা শাসকগোষ্ঠীর পাশবিক নির্যাতনের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তখন হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, আগামী বছর, আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে, আমরা নবম তারিখেও রোজা রাখব। কিন্তু পরের বছর মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেন। (মুসলিম)। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মহররমের নবম তারিখে রোজা রাখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন বিধায় ইসলামি বিশেষজ্ঞরা নবম ও দশম মহররম কিংবা দশম ও একাদশ মহররম রোজা রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, আশুরার দিবসে যে ব্যক্তি স্বজনদের জন্য উদারহস্তে ব্যয় করেন, আল্লাহ তার প্রতি সারা বছর সদয় থাকবেন (বাইহাকি)। আশুরা উপলক্ষে পরিবার-পরিজনের জন্য সাধ্যমতো অর্থব্যয়ের পাশাপাশি অসহায় ও গরিবদের দুর্দশা লাঘবেও যথাসাধ্য সদকা ও জাকাত প্রদানের তাগিদ দিয়েছেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। বর্তমানের বিবর্তিত ও অধঃপতিত সমাজব্যবস্থায় স্বজনদের ভূরিভোজন আয়োজনের পাশাপাশি অসহায়দের দুর্দশা লাঘবে আন্তরিক হলে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ নতুন মাত্রা পাবে, ইনশা আল্লাহ। এ ছাড়া পবিত্র আশুরার তারিখে কোরআন তেলাওয়াত, নফল সালাত আদায় ও অন্যান্য সকল ইবাদত-বন্দেগির বিশেষ তাগিদ রয়েছে ইসলামি শরিয়তে। তবে অত্যুৎসাহী শিয়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা ধরনের মতভেদ রয়েছে। উল্লেখ্য, ইসলামি শরিয়তে বাড়তি ইবাদত-বন্দেগির জন্য যে পাঁচটি দিবস-রজনীর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, আশুরা তার অন্যতম। তবে অন্যান্য বিশেষ দিবসের ইবাদত-বন্দেগি করা হয় রাতে; শুধু আশুরার ইবাদত-বন্দেগি দিবাভাগে করা হয়ে থাকে।
মূলত বাস্তুহারা ফিলিস্তিনি, ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত ইরান-ইরাক-তুরস্ক-সিরিয়া-মধ্যপ্রাচ্য-পাকিস্তানসহ বর্তমানে ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত নামকাওয়াস্তে মুসলমানরা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট চরম আজাব-গজবের অতলস্পর্শী সাগরে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। আবার লেফাফাদুরস্ত ধার্মিক এবং স্বার্থপর নেতৃবর্গও শয়তানের প্ররোচনায় কিংবা ব্যক্তি-গোষ্ঠী-পারিবারিক-দলীয় স্বার্থে বর্তমানে জাগতিক মোহে পুরোপুরি আবিষ্ট হয়ে পড়েছেন। আর ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত মুসলমানরাও পারলৌকিক পাথেয় সংগ্রহের তুলনায় পার্থিব ভোগবিলাসিতা, ক্ষমতার বাহাদুরি এবং পরস্ব হরণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রয়েছেন। পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকার্জন বা হালাল রোজগারের প্রতিযোগিতা আধুনিক সভ্য ও ভদ্র সমাজে অচল ও আধুনিকতা পরিপন্থী। তাই বাম হাতের লেনদেনের মাধ্যমে অল্প দিনে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতার নামে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে আমরা সবাই মূলত স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য জাহান্নাম খরিদে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিদের ৯৫ শতাংশই জীবন ও জীবিকার তাগিদে কিংবা আমেরিকার মায়া মরীচিকার হাতছানিতে প্রলুব্ধ হয়ে বাংলার সহস্র বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং স্বজনদের স্নেহসান্নিধ্য ছিন্ন ও করুণাকাতর মুখচ্ছবির মর্মবেদনা বুকে চাপা দিয়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দুর্গম-দুর্লঙ্ঘ্য পথপ্রান্তর এবং শ^াপদসংকুল বনবাদাড় মাড়াতে গিয়ে অসংখ্য ভাগ্যান্বেষী বাংলাদেশির পথিমধ্যে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আগত বাংলাদেশিদের বৃহত্তর অংশই প্রাকৃতিক বৈরিতা ও হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা উপেক্ষা করে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। আবার অনেকেই নিজেদের নতুন প্রজন্ম ও নির্ভরশীলদেরও শিক্ষা-দীক্ষায় একবিংশ চাহিদার উপযোগী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে সময়ের অগ্রযাত্রায় সর্বস্তরে এবং সর্বক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিদের অহেতুক ও অসম প্রতিযোগিতা বর্তমানে প্রতিহিংসায় রূপ নিয়েছে। ফলে চিরায়ত বাংলার শাশ্বত মমত্ববোধ ও পরার্থপ্রিয়তা নির্বাসনে যাওয়ায় পান থেকে চুন খসে পড়ার মতো তুচ্ছ বাগ্্বিতণ্ডা-মনোমালিন্যকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধর্মীয় বিধিবিধান আমাদের জীবনাচরণ থেকে বহুলাংশে বিদায় নিয়েছে এবং সংসার ভাঙার ঘটনাও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার প্রবাসজীবনের পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও ভরণপোষণের চাপে আমরা অনেকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কলুর বলদের মতো অহর্নিশ জীবনরথের ঘানি টেনে যাচ্ছি। তাই জীবনরথের ঘানি টানার পর হাড্ডিসার অচল দেহ নিয়ে নিতান্ত সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকের পক্ষেই ধর্মকর্মে ইচ্ছেমতো সময় দেওয়ার সুযোগ এবং সংগতি হচ্ছে না। যাহোক, হিজরি ১৪৪৬ সালের সূচনাপর্বে, বিশ্ব প্রতিপালকের নিকট আমাদের কায়মনোবাক্যে আরাধ্য : হে রাব্বুল আলামিন, তুমি আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হওয়ার তওফিক দান করে বিশেষভাবে ধন্য করেছ এবং হিজরি ১৪৪৬ বর্ষে পদার্পণের হায়াত দান করে কৃতজ্ঞতার ডোরে আবদ্ধ করেছ। পবিত্র কোরআনের ২৪তম অধ্যায়ের মক্কায় অবতীর্ণ সুরা যুমার ৫৩ নং আয়াতে তুমি বলেছ : লা তাকনাতুম্ মির-রাহমাতিল্লাহে, ইন্নাল্লাহা ইয়াগফেরুজ যুনুবা, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহিম (আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপরাধীদের অপরাধ মার্জনাকারী; বাস্তবিকই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু)। অতএব, হিজরি নববর্ষে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আমাদের আত্মশুদ্ধির সুযোগ করে দাও। অবৈধভাবে সম্পদ আহরণ, পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, অন্যের প্রতি অহেতুক বিদ্বেষ পোষণ, পার্থিব সম্পদের লোভ-লালসা-মোহ ইত্যাদি পাপাচার থেকে দয়া করে আমাদের মুক্তি দাও! ইহকালীন ধন-সম্পদ আহরণের চেয়ে পরকালীন পাথেয় সঞ্চয়ের মনোভাব আমাদের অন্তরে জাগ্রত করো। পেশি ও দানবীয় বা অসুরীয় শক্তির পতন ঘটিয়ে বিশ্বজুড়ে শান্তির মৃদুমন্দ মলয় বইয়ে দাও। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
৯ জুলাই ২০২৪।