অর্থ বলতে মূলত আধুনিক মুদ্রাব্যবস্থাকে বোঝায়, যা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে এবং নিজস্ব মানে বিদ্যমান। স্বাবলম্বী বলতে মুদ্রা বা সম্পদ ব্যবহার করে অর্জিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বোঝায়। নিবন্ধটিতে তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকার চেষ্টা থাকবে, যদিও আলোচনার বিষয়টি অবশ্যই গুরুগম্ভীর। প্রচুর নগদ অর্থ থাকাকে স্বাবলম্বী হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, কারণ যেকোনো পরিস্থিতিতে নগদ অর্থ সব সময় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম না হলে হঠাৎ দৈন্য-দুর্দশার কারণ ঘটতে পারে। তাই নগদ অর্থের পাশাপাশি অন্যান্য আর্থিক সমৃদ্ধিও থাকা প্রয়োজন, যাতে একটি খাতে মন্দাভাব দেখা দিলেও অন্য খাতের মাধ্যমে তা পুষিয়ে নেওয়া যায়। যদিও বিনিয়োগের জন্য অর্থ একটি অতি প্রচলিত ও সহজ মাধ্যম। অর্থ দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা, শিল্প স্থাপন, জমি ও অন্যান্য যাবতীয় ক্রয়সহ নানাবিধ আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব। অর্থ ব্যতীত অন্য কোনো মূল্যবান সামগ্রীর মাধ্যমে তা সহজে বিনিময়যোগ্য নয়, যদিও একমাত্র নগদ অর্থই সামর্থ্যবান হিসেবে বিবেচনাযোগ্য নয়। আর্থিক ব্যবস্থাকে প্রাণিদেহের সঙ্গে তুলনা করা হলে অর্থ হলো দেহের রক্ততুল্য। শরীর ও তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখার জন্য দেহে যেমন নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত থাকা প্রয়োজন, সুখী-সমৃদ্ধ জীবনযাপনের জন্যও তেমনি ন্যূনতম আর্থিক সচ্ছলতা থাকা আবশ্যক।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারণা দুটি প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও প্রকৃতপক্ষে এ ধারণা দুটির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। কোনো দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির শতকরা হারকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা উন্নতি করছে, তার প্রধান নিয়ামক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বলতে মোট দেশজ উৎপাদনের বর্ধিত অংশের শতকরা মানকে বোঝায়। অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলতে আর্থসামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়াই দেশের প্রকৃত জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি এবং তার ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মানের বৃদ্ধিকে বোঝালেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে বোঝায় দেশের প্রকৃত জাতীয় আয় ও প্রকৃত মাথাপিছু আয়ের কাঠামোগত পরিবর্তনকে। এ ম্যাডিসনের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য হলো, ‘ধনী দেশের আয় স্তরের বৃদ্ধিকে সাধারণত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলা হয় এবং দরিদ্র দেশে এটাকে বলা হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন।’
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সম্পদশালী ও অর্থনীতিবিদদের নিকট অত্যন্ত জটিল বিষয় হলেও সাধারণ মানুষের নিকট মোটেও জটিল নয়। বাজেটে কর আরোপের ফলে রাজস্বের হ্রাস-বৃদ্ধি ও জনজীবনে এর প্রভাব নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বহু গবেষণা প্রয়োজন হলেও জনগণের বুঝতে তেমন সময় ও গবেষণার প্রয়োজন হয় না। অন্য দিনের সমান অর্থ নিয়ে কেনাকাটা শেষে বাজারের থলির ওজনই তাকে জীবনমানের হ্রাস-বৃদ্ধির সূচক নির্ধারণ করে দেয়। যদিও এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী রাজনীতিকেরা জনগণকেই শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রবৃদ্ধিকে জনজীবনের বিশাল উন্নতি হিসেবে প্রচার করা হলেও জনজীবনে এর প্রভাব কতটা ইতিবাচক, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সকল বিষয়ের গড় যে যুক্তিসংগত নয়, তার একটি বাস্তব উদাহরণ গ্রহণ করা যেতে পারে। এক স্কুলের দুজন খুব দক্ষ শিক্ষক। একজন অঙ্কের, অন্যজন ভূগোলের। তারা একদা একসঙ্গে অন্যত্র যাওয়ার সময় তাদের গন্তব্যের মাঝপথে একটি খাল দেখতে পান। খালে সাঁকো এবং পারাপারের জন্য অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় হেঁটেই খাল পার হতে হবে। এ অবস্থায় পরিধেয় কাপড় শুকনো রাখাও জরুরি। ফলে কীভাবে খাল পার হওয়া যায় ভাবনার একপর্যায়ে স্থানীয় একজন লোককে পেয়ে তার নিকট থেকে খালে কোথায় কী পরিমাণ পানি আছে, তা জেনে নিয়ে অঙ্কের শিক্ষক পানির গড় করে দেখেন যে হাঁটুর উপরে খুব অল্প পানি। সুতরাং তিনি হেঁটে খাল পার হলে কাপড় ভিজবে না বিবেচনা করে খাল পার হতে চাইলে ভূগোলের শিক্ষক রাজি না হওয়ায় গোঁয়ার্তুমি করে একাই খালে নেমে মাঝে গিয়ে পানিতে ডুবে গিয়ে পরনের সব পোশাক ভিজিয়ে ফেলে বেকুব বনে যান। অতঃপর পাড়ে উঠে পুনরায় অঙ্ক কষে দেখেন, তার অঙ্কের ফলে কোনো ভুল নেই। তখন ভূগোলের শিক্ষক খাল এঁকে বিভিন্ন পয়েন্টে রেখা টেনে পানির উচ্চতা নির্ধারণ করে দেখালে অঙ্কের শিক্ষকের গড়ের ধারণা পাল্টে যায়। অর্থাৎ সব গড়ের ফলাফলের ভিত্তিতে যে বাস্তবতার মিল হয় না, তা তার বোধগম্য হয়। বাস্তবতা হলো জীবনের অনেক গড় হিসাবই অঙ্কশাস্ত্রের গড় হিসাবে চলে না। আর জোর করে চালাতে গেলে তার ফলও বাস্তবভিত্তিক হয় না। হয় গড় অঙ্কের মতো বেকুবিপনা।
গড় হিসাবের প্রবৃদ্ধি যে বাস্তবভিত্তিক নয়, তা প্রমাণের জন্য নিচের আলোচনাটি উপলব্ধি করা যেতে পারে। ধরা যাক, কোনো এক গ্রামে দুই হাজার লোকের বসবাস, যার মধ্যে মাত্র দুজন বিলিয়নিয়ার, যাদের রয়েছে খুব বড় মাপের শিল্প ও ব্যবসা। পক্ষান্তরে বাকি সবাই সাধারণ গৃহস্থ, যাদের আয়ের প্রধান উৎস কৃষিনির্ভর উৎপাদন ও ক্ষুদ্র ব্যবসা। বছর শেষে দেখা গেল, বৈরী আবহাওয়ার কারণে তেমন ভালো ফসল পাওয়া গেল না এবং বিশ্ব মহামারির প্রভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। ফলে বিগত বছরের তুলনায় তাদের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক অথচ দুজন বিলিয়নিয়ারের উপার্জন বিগত বছরের চেয়ে ঢের বেশি। বাস্তবতা হলো গরিবেরা অধিকতর গরিব হয়েছে, পক্ষান্তরে ধনীরা হয়েছে অধিকতর ধনী। কিন্তু অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুসারে মাথাপিছু গড় আয় ও প্রবৃদ্ধি পূর্বের বছরের তুলনায় অনেক বেশি। অর্থনীতির এ বিশ্লেষণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিকট কতটা স্বস্তিদায়ক এবং এর ফলে তাদের অবস্থার কতটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। বরং দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণে সরকারি তরফে সাহায্য-সহযোগিতার কোনো সুযোগ থাকলেও দুজন ধনীর সঙ্গে গড় আয়ের হিসাবে প্রবৃদ্ধি নির্ণয়ের কারণে তা থেকেও তারা বঞ্চিত হবে। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে মাথাপিছু গড় আয় নির্ধারণ ও তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি সংশোধনপূর্বক সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে উচ্চবিত্তের জন্য আলাদা ও বাকি সবার জন্য আলাদা (দুই ভাগে) নির্ণয় সময়ের দাবি। অন্যথায় প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। ফলে প্রাপ্ত ত্রুটিপূর্ণ পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আর্থিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে তা জনকল্যাণে যথাযথ ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হবে বৈকি!
বাজেট প্রণয়নকারী স্ব স্ব সরকারের বার্ষিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার ঘোষিত অর্থ বিল বা আর্থিক ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আইন। যার খসড়া উপস্থাপনের শুরু থেকে আইনে পরিণত হওয়া পর্যন্ত এর পক্ষে-বিপক্ষে সরকার, বিরোধী দল ও অর্থশাস্ত্রে অভিজ্ঞ সুশীল সমাজ কর্তৃক নানাবিধ বিশ্লেষণ চলতে থাকে। পক্ষে-বিপক্ষে উভয় শ্রেণির বক্তব্যে উঠে আসে জনকল্যাণ, অথচ বাজেটের মাধ্যমে জনকল্যাণ কতটা নিশ্চিত হয় পূর্বের প্যারাসমূহে তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাজেট ঘোষিত বার্ষিক অর্থবিল হলেও বিভিন্ন কারণে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পণ্যের ওপর আরোপিত করসমূহের সংযোজন-বিয়োজন করতে দেখা যায়। ফলে বাজেট বার্ষিক অর্থ ব্যবস্থাপনার আইন হিসেবে কতটা যুক্তিপূর্ণ, তাও বিবেচনার দাবি রাখে। আশা করি, ওই আলোচনা থেকে পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়টি সবাই উপলব্ধি করে জনকল্যাণে বাস্তবসম্মত নীতি প্রণয়নে সম্যক ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হবেন। তবেই বাজেট হবে জনকল্যাণে অবদান রাখার ক্ষেত্রে প্রতিভূ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক। সেন্ট এলবান্স, নিউইয়র্ক।