Thikana News
০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মুসলিম দর্শনে ‘ফানাফিল্লাহ’

মুসলিম দর্শনে ‘ফানাফিল্লাহ’
স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টাই সুফিবাদের মর্মকথা ও মুখ্য বিষয়। আপন নফসের সঙ্গে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করতে পারলেই কেবল ইহকাল ও পরকালে শান্তি পাওয়া যাবে। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়।
যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। আর তাসাউফ দর্শন বা সুফিবাদ অনুযায়ী এই সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। সেই পথ হলো ফানা ফিশ্শাইখ, ফানাফির রাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে আল্লাহ-প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। আর এ কাজটি কারও পক্ষে একা করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন একজন কামেল মুর্শিদ।
যিনি মাধ্যম বা অসিলা হিসেবে আল্লাহকে পাওয়ার পথ দেখিয়ে দেবেন। যিনি পথভ্রষ্টদের এরূপ সাধনায় সমর্পিত করিয়ে থাকেন, ইসলামের পরিভাষায় তাদেরকে পীর-মুর্শিদ বলা হয়। পাপের সাগরে নিমজ্জিত মানুষকে হেদায়েতের জন্য কালপরিক্রমায় আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী-অলি-আউলিয়া-পীর-মুর্শিদদের জগতে পাঠিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টির আদি থেকে শুরু করে ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
সুফিবাদের একমাত্র মূল বিষয়টি হলো আপন নফসের সঙ্গে, নিজ প্রাণের সঙ্গে, নিজের জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মা আল্লাহ যে শয়তানটিকে আমাদের পরীক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে এ জড় জগৎ থেকে মুক্তি পাওয়া। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহকে জানার এবং আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টাকে সুফি দর্শন বা সুফিবাদ বলা হয়।
হজরত ইমাম গাজ্জালির (রহ.) মতে, ‘আল্লাহ ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিবাদ। সুফ অর্থ পশম আর তাসাউফের অর্থ পশমি বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাব্সু’স-সুফ)। অতঃপর মরমি তত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাউফ। যিনি নিজেকে এরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন, ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফি নামে অভিহিত হন।
সুফিগণের মতে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক। এর সপক্ষে সুফিগণ মুহাম্মদ (সা.) এর একটি হাদিস উল্লেখ করেন, যা হলো, ‘মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। জেনে রাখো এটি হলো কল্ব বা হৃদয়।’ আল্লাহর জিকর বা স্মরণে কল্ব কলুষমুক্ত হয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কল্বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। যাঁরা তাঁর প্রেমার্জন করেছেন, তাঁদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করাই হলো সুফিদর্শন।
যদিও প্রাচীন ও আধুনিক সুফিদের সিংহভাগই ছিল সুন্নি ইসলামের অনুসারী, মধ্যযুগের শেষভাগে শিয়া ইসলাম পরিমণ্ডলের ভেতরেও কিছু সুফিধারার বিকাশ ঘটে। যদিও সুফিগণ কট্টর রীতিনীতির বিরোধী, তার পরও তারা ইসলামি আইন কঠোরভাবে মেনে চলেন এবং তারা ইসলামি ফিকহ ও ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন ধারার অন্তর্ভুক্ত। সুফিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাদের সন্ন্যাসবাদ, বিশেষত জিকির নামক আল্লাহকে স্মরণচর্চার সঙ্গে তাদের ঐকান্তিক সম্পর্ক, যা তারা প্রায় সময় সালাতের পর করে থাকে।
প্রারম্ভিক উমাইয়া খিলাফতের জাগতিক দুর্বলতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। তারা মুসলিমের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য হারে অনুসারী লাভ করে এবং এক সহস্র বছর সময়ের মধ্যে বহু মহাদেশ ও সংস্কৃতিতে তারা বিস্তৃতি লাভ করে, প্রাথমিকভাবে আরবি ভাষায় এবং পরবর্তী সময়ে ফারসি, তুর্কি ও উর্দু ভাষায় অন্যদের মাঝে তাদের বিশ্বাসের প্রচার ও প্রসার করে। সুফিগণ তাদের ধর্মপ্রচার ও শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। উইলিয়াম চিট্টিকের মতে, ‘বিস্তৃত পরিসর হতে দেখলে, সুফিবাদকে ইসলামি বিশ্বাস ও চর্চার অন্দরসজ্জা ও প্রগাঢ়তার কার্যক্রম হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে।’
যত অল্পে তুষ্ট থাকবে, ততই মানসিক স্বাধীনতা ভোগ করতে সক্ষম হবে। ক্রোধ মনুষ্যত্বের আলোকশিখা নির্বাপিত করে দেয়। আজকের কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে না রাখাটাই প্রকৃত কর্মী পুরুষের পরিচায়ক। আদবই তাসাউফের মূল বস্তু, মানে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কোরআন ও হাদিসের রীতি-নীতি অনুসরণ করাই প্রকৃত দরবেশি।
এই তিনটিকে পবিত্র রাখুন-শরীর, পোশাক ও আত্মা। টেস্ট করে দেখুন, অনেক মানুষই বিষধর জন্তুর চেয়ে কম হিংস্র নয়। হামেশা জিকির ব্যতীত আল্লাহর নৈকট্য কেউ লাভ করতে পারে না। মুখ যদি ঠিক হয়ে যায়, তবে আত্মাও সংশোধন হয়ে যায়। ক্রোধের সর্বোত্তম চিকিৎসা হচ্ছে নীরবতা। তিনটি বস্তুই প্রকৃত সম্পদ-বিদ্যা, ভদ্রতা ও ইবাদত। মানুষের সঙ্গে কথা কম বলে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে বেশি কথা বলার চেষ্টা করো।
মহব্বতের সঙ্গে মুর্শিদের চেহারা মোবারক দর্শনে পাপ মোচন হয়। এমন ইবাদত করো, যা দ্বারা আত্মিক সাধ অনুভব করতে পারো। দুনিয়ার জীবনে যে ইবাদতে স্বাদ নেই, আখিরাতে তা দ্বারা কতটুকু ফায়দা হবে। সবকিছুরই স্বাভাবিক পরিবর্তন আছে। কিন্তু স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয় না। বুদ্ধিমানের সংসারী জীবন বোকার দরবেশির চেয়ে উত্তম। আত্মা শুদ্ধ করা প্রত্যেক নরনারীর জন্য আদর্শ ফরজ। এলমে তাসাউফ দ্বারা আমাদের আত্মার উন্নতি ও অবনতি বিষয়ে জানা যায়।
আল্লাহ তায়ালাকে মহব্বত করো, কেননা তিনি তোমাদিগকে ভালোবাসেন। ঝগড়া চরমে পৌঁছার আগেই থেমে যাও। দুষ্ট লোককে তার দুষ্টামিই গ্রাস করবে। আপন পাপরশিতেই সে বাঁধা পড়বে। যাকে ঘৃণা করবে তাকে ভয়ও করবে। অন্যকে সম্মান করতে শেখো। এর দ্বারা সকলের সঙ্গেই বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হবে। যে ব্যক্তি পাপের মতো পুণ্যকেও গোপন রাখে, সে-ই খাঁটি লোক। মুরিদের পক্ষে পীরের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি উভয় অবস্থায় একই প্রকার খেদমত হওয়া উচিত। গিবত করা আর মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়া একই কথা।
কারও নাম-যশ শুনেই বিভ্রান্ত হয়ো না। সর্বদা জিকির করলে শয়তান দূরে থাকে এবং কবরে আজাব হয় না ও জাহান্নাম হতে নাজাত পাওয়া যাবে। উপবাস আল্লাহ তায়ালার স্বভাব। আল্লাহ্ তায়ালার প্রিয় প্রেমিকগণ এই উপবাস দ্বারা ইবাদত সাধনার শক্তি লাভ করেন। মুরিদের কাছে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো বিপরীত মনোভাবাপন্ন লোকের সঙ্গে ওঠাবসা করা। এমন ইবাদত করো, যা দ্বারা আত্মিক স্বাদ অনুভব করতে পারো। দুনিয়ার জীবনে যে ইবাদতে স্বাদ নেই, আখিরাতে তা দ্বারা কতটুকু ফায়দা হবে। খেদমতে দেহের জ্যোতি এবং বিশ্বাসে প্রাণের জ্যোতি বাড়ে। যে নামাজ মানুষকে পাপের কাজ থেকে বিরত রাখে না, সে নামাজ শুধুই নামাজ, প্রকৃত নামাজই নয়।
দিলের কাকুতি-মিনতি ও ভয়ের সঙ্গে সকাল-বিকাল মাঝামাঝি শব্দে তোমার প্রতিপালকের জিকির করো; গাফেলদের শামিল হয়ো না। হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় করো। সাদেকিনের সঙ্গ লাভ করো। যারা তার প্রভুকে সন্তুষ্ট করার জন্য সকাল-বিকাল ডেকে থাকে, তোমাদের আত্মাকে তাদের সঙ্গে রাখো। আল্লাহ তায়ালা বলেন, বড়ত্ব, গর্ব ও অহমিকা আমারই, আর ক্ষমতা আমার গোপনীয় পার। আজিজি ব্যতীত মহব্বত পয়দা হয় না। নিশ্চয় জানিয়ো আল্লাহর নিকট কাজের ফলাফল মানুষের নিয়ত অনুসারে হয়ে থাকে।
আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য অসিলা অন্বেষণ করো এবং তাঁর রাস্তায় পরিশ্রম করো, তাহলে মুক্তি লাভ করবে। আসুন, সবাই নামাজ কায়েম করি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে আমার জিকির হতে বিমুখ থাকবে, তার জীবন বিড়ম্বনাময় এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় ওঠাব। প্রতিটি নিঃশ^াস খেয়াল কালবের ভেতর ডুবিয়ে রাখো আর না হালকা হওয়ার ভয় আছে। তরিকত শিক্ষা বা মোরাকাবার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহকে লাভ করা। নির্জনতাকে পছন্দ করা এবং গোপনে ইবাদত করা, এই দুটি কাজ খাঁটি আবেদের লক্ষণ।
নিজের ওপর সবর করতে সক্ষম ব্যক্তিই মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে অধিক অগ্রগামী। যে ব্যক্তি জীবনে একবারও নিজের অন্তরে খোদাকে হাজির পেয়েছে, সেই ব্যক্তিই প্রকৃত সুখী। এক মুহূর্ত কোনো কামেল অলির সঙ্গে থাকা একশ বছর বেরিয়া বন্দিগি হতে উত্তম। বিপদে তীরের লক্ষ্যস্থল হয়ে উহ্্ শব্দ না করাই প্রকৃত সবর। যে ব্যক্তি লোভ ত্যাগ করে অল্পে তুষ্টি অবলম্বন করে, সে ইজ্জত ও মনুষ্যত্ব লাভ করে। এশকের ব্যথায় ব্যথিত ব্যক্তির ওষুধ মাশুকের দিদার ছাড়া আর কিছু নেই।
 

কমেন্ট বক্স