নিউইয়র্কে হয়ে গেল বাংলাদেশ ডে প্যারেড। এই প্যারেড নিয়ে কারো কারো মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীরা এটিকে একটি সফল প্রোগ্রাম বলে মনে করছেন। আর যারা অংশ নেননি বা যোগ দেননি, তারাই নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ আবার অংশ নিয়েছেন, কিন্তু পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি, বরং নাখোশ হয়েছেন। অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে ধরেছেন। সেই সাথে আয়োজকদের কারো কারো বিষয়ে অভিযোগের সুরে কথা বলেছেন। বলেছেন, এমন মানুষও আছে, যাদের পেছনে যাওয়া যাবে না। তারা নিজেরা যেমন আলোচনা করছেন, তেমনি বিভিন্নভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অনুষ্ঠানে গ্র্যান্ড মার্শাল নিয়েও প্যারেডের আগে বিরোধ দেখা দেয়। সেখানে এক বার্তায় বলা হয়, এবার কাউকে গ্র্যান্ড মার্শাল দেওয়া হবে না। পরে অবশ্য গ্র্যান্ড মার্শাল পদ দেয়া হয়।
কেমন হলো প্যারেড? এই প্রশ্ন এখন অনেকেরই। এটি আরো অনেক ভাল হতে পারতো। সবার অংশগ্রহণে হতে পারতো। কিন্তু সেটি হলো না। কেন কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষ যোগ দিলেন না। অনেক সংগঠনও যোগ দেয়নি। এ নিয়ে নানা জন নানা কথা বলছেন। সেই সাথে অনেকেই আয়োজকদের নিয়েও অনেক কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, আয়োজকদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যারা কমিউনিটির সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কিংবা সর্বজন গ্রহণযোগ্য এমন নয়। আর আয়োজকরা মনে করেন, তারা এই ধরণের একটি সফল অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন, যা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। কারণ ভাল একটি উদ্যোগের সাথে অনেকেই এগিয়ে আসেননি। আয়োজকরা আবশ্যই সবাইকে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আয়োজনে কোন অস্বচ্ছতা ছিল না। বিভিন্ন সংগঠনের রেজিস্ট্রেশনেরও সুযোগ রাখা হয়েছিল। প্রবাসে বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনা করেই সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল।
বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম বলেন, আমি প্রথম বাংলাদেশ সোসাইটির ব্যানারে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ডে প্যারেড করেছিলাম। ওই সময়ে হাজার হাজার মানুষকে আমরা সমবেত করতে পেরেছিলাম। ওই সময়ে আজকের মতো এত সুবিধা ও এত অর্থ ছিল না। অনেক কষ্ট করেই সেটি আমরা সোসাইটি থেকে করেছিলাম। আমাদের সোসাইটির তখনকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন হামিদুজ্জামান। আমাদের বাংলাদেশ ডে প্যারেডে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো- এখানে প্রবাসের সব সংগঠনকে যেমন অংশগ্রহণ করানো সম্ভব হয়নি, তেমনি সুধীজনদেরকে সম্পৃক্ত করা দরকার ছিল, তাও হয়নি। নিউইয়র্কের বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন পেশাজীব সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব সংগঠনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সেখানে লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিৎ করার দরকার ছিল। ৫০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষের সমাগম ঘটানো খুবই সম্ভব ছিল। কিন্তু এবার যারা আয়োজন করলেন, তা সবার অংশগ্রহণে একটি প্যারেড করতে পারলেন না। আর যারা আয়োজক ছিলেন, তাদের মধ্যেও শেষ পর্যন্ত ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বিভেদ দেখা দিয়েছে। গ্র্যান্ড মার্শাল নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। আমরা যখন প্যারেড আয়োজন করেছিলাম, তখন বুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলরকে গ্রান্ড মার্শাল করেছিলাম। এবারের অনুষ্ঠানে এখানকার বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আনা দরকার ছিল, কিন্তু তা হয়নি। বাংলাদেশ থেকে অনেক সুধীজনকে আনা যেতো, তাও করা হয়নি। আসলে সব মিলিয়ে এটি সফল অনুষ্ঠান হতে পারতো। কিন্তু সেভাবে হয়নি। যদি তারা তা করতে পারতেন, অবশ্যই ভাল হতো।
ফখরুল আলম বলেন, বাংলাদেশ একটি বিশাল ব্যাপার। এই কারণে আগামী দিনে যারা বাংলাদেশ ডে প্যারেডের আয়োজন করবেন, তাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, সবাইকে নিয়ে প্যারেড করতে হবে। ম্যানহাটানের মতো বড় জায়গায় প্যারেড করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হলে এক থেকে দু’বছর আগেই ভেন্যুর জন্য অনুমতি নিতে হবে। সমাজের বিশিষ্টজন ও সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে প্যারেড সফল করতে হবে।
হিংসা, বিদ্বেষ, বিভেদ, কে , কার চেয়ে বড়- এ মনোভাব পরিহার করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়েই প্যারেড করতে হবে। কার অর্থ আছে, সেটি যাতে বড় বিষয় না হয়। অর্থের মানদন্ড দিয়ে সবকিছু বিবেচনা না করে এমনভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ প্যারেডের গুরুত্ব আরো বেশি বাড়ে।
ব্র্রঙ্কসের অতি পরিচিত মুখ, কমিউনিটি লিডার আব্দুস শহিদ বলেন, এই প্যারেডে ব্রঙ্কসের মানুষের তেমন অংশগ্রহণ ছিল না। কারণ আয়োজকরা এটি একতরফাভাবে করেছেন। আমাদের ব্রঙ্কস থেকে কয়েকজন গেছেন। তারা তাদের মত করে গেছেন। এটি একতরফাভাবে না করে সবাইকে নিয়ে করা দরকার ছিল।
আব্দুস শহিদ আরো বলেন, আমরা ব্রঙ্কসে ২০০৪ সালে বাংলাদেশ প্যারেড করেছি। সেখানে অনেক লোকের সমাগম করেছিলাম। বাংলাদেশ প্যারেড মানে কেবল একটি নাম নয়। এটি বাংলাদেশের নাম জড়িয়ে করা, মানে হলো এটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। এবং বাংলাদেশের এমন একজন মানুষকে গ্রান্ড মার্শাল করতে হবে, যাঁর ভূমিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন একজনকে গ্রান্ড মার্শাল করতে হবে, যাকে দেশ, প্রবাস এবং মূলধারার সবাই চেনেন। কিন্তু আসলে এবারের বাংলাদেশ প্যারেডে সবার অংশগ্রহণ তারা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটা করতে পারলে ভাল হতো। শুনেছি গ্রান্ড মার্শাল পদের জন্য তারা ৫০ হাজার ডলারের স্পন্সর খুঁজেছেন। এটা কিন্তু নৈতিক নয়। গ্র্যান্ড মার্শাল-এর জন্য স্পন্সর কেন লাগবে?
তিনি বলেন, আসলে যারা অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছেন, তারা সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেননি। আর এ কারণেই সিটি পাঁচ বরোর সবাইকে যেমন সম্পৃক্ত করতে পারেনি, তেমনি আশেপাশের স্টেট থেকেও নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করা দরকার ছিল, সেটিও করেনি।
বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিও বাংলাদেশ ডে প্যারেড যেভাবে সম্মান জানানো দরকার ছিল, তা হয়নি। তাকে গভীরভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করা দরকার ছিল।
জ্যামাইকা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন (জেবিএ)-এর সাধারণ সম্পাদক রাব্বী সৈয়দ বলেন, আমি প্যারেডে অংশ নিয়েছি। তবে অভিজ্ঞতা খুব একটা ভাল নয়। খুবই ডিস-অ্যাপয়েন্টেড। প্রথমত বাংলাদেশ ডে প্যারেডের অর্গানাইজার, তারা সুশৃঙ্খল, সুচিন্তিত কিংবা পরিকল্পিতভাবে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করতে পারেননি। খুব কম সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বলা চলে এটি বাংলাদেশিদের নয়, হয়েছে এনওয়াইপিডির প্যারেড। কারণ এনওয়াইপিডি, বাপা, কারেকশন অফিসার এবং ফায়ার ডিপার্টমেন্টের গ্রুপগুলোর উল্লেখ্যযোগ্য উপস্থিতি ছিল। তাদেরকে যদি বাদ দেয়া হয়, তাহলে কতজনই বা ছিল। তারা সংখ্যায় বেশি ছিলেন ও অগ্রভাগে ছিলেন। এই প্যারেডে তাদের পাশাপাশি বাংলাদেশি বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি দরকার ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, আয়োজকরা তা সুসংগঠিত করতে পারেননি।
প্যারেড কোন সাধারণ র্যালি নয়। এটি বিশাল একটি ব্যাপার। প্যারেড করার জন্য অনেক মানুষের সমাগম প্রয়োজন হয়। এটি কোন আঞ্চলিক সংগঠনের অনুষ্ঠান নয়। যাদের প্যারেড, র্যালি ও সমাবেশ করার অভিজ্ঞতা আছে, এমন সব মানুষকেই এই আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত করার দরকার ছিল। তাদেরকে নিয়ে কাজ করলে আরো ভাল হতো।
মঞ্চে বিশৃৃঙ্খলা ছিল। এক পর্যায় গিয়ে গ্রান্ড মার্শাল কে হবেন- সেটিও ঠিক হয়নি। এটি কে হবেন- তাতো অনেক আগেই ঠিক করে রাখার কথা। কিন্তু তা হয়নি। গ্রান্ড মার্শাল নিয়ে বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। যা খুবই দুঃখজনক।
কমিউনিটির পরিচিত মুখ ও কমিউনিটি লিডার নাসির আলী খান পল বলেন, নিউইয়র্কে হয়ে গেল বাংলাদেশ প্যারেড। কেমন হলো প্যারেড? এ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, মিষ্টি-তিতা অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম সেখান থেকে। সব আলোচনা সমলোচনার উর্ধ্বে এই প্যারেড আমার কাছে ভাল লেগেছে, কারণ এ আমার প্রিয় দেশ বাংলাদেশের প্যারেড।
যারা আয়োজকরা শুরু করলেন শত বাঁধা উপেক্ষা করে তাদের প্রাণ ঢালা অভিনন্দন। তবে সবার জেনে রাখা ভাল যে, এ প্যারেডই প্রথম নয়। সম্ভবত ১৯৮৪ সালে আনিসুল হক খোকনের রূপসী বাংলার আয়োজনে সিটি হলে প্রথম বাংলাদেশি প্যারেড অনুষ্ঠিত হয় এবং আমি, তহুর আহমেদ, ডা. বিল্লাহ মার্শাল ছিলাম। রিয়েল এস্টেট ব্যাবসায়ী রাজীবের ওয়াইফ শম্পা সেখানে নাচ করেছিলো ও শহিদ হাসান গান করেছিলো। অতএব এটা প্রথম নয়। এটা সেকেন্ড।
আমার একটা প্রতিবাদ রইল এই আয়োজকদের বিরুদ্ধে। এবারের বাংলাদেশি প্যারেডে কোথায় আমার হাজারো বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক, বাংলাদেশের রূপকারের নাম উচ্চারিত হয় নাই। তার একটা ছবিও নেই। হায়রে রাজনীতি! হায়রে মিরজাফর!!
মাইকের যদি মুখ থাকতো, তবে চিৎকার করে বলতো- ‘ভাই, সহিদুল, মঈন চৌধুরী, গিয়াস আহমেদ, সোনিয়া, জেনারেল সেক্রেটারি আমায় আর টানাটানি কইরেন না, আমি পুলিশ কল করবো। বাংলাদেশির চেয়ে প্যারেডে পুলিশের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। এটা পুলিশের প্যারেড মনে হয়েছে। ৪০০ বাঙালি সংগঠনের শহর নিউইয়র্কের এই প্যারেডে একটি আঞ্চলিক সংগঠন ও বাপা এবং মুক্তিযোদ্ধার ২ দলের অংশগ্রহণ খুবই দুঃখজনক ব্যাপার।
মাইকে একবার ভেসে আসলো শাহ নেওয়াজ সাহেবের কণ্ঠে আমি Grand Marsha, কিন্তু পরবর্তীতে আবার গিয়াস আহমেদ বললেন, এই প্যারেডে কেউ Grand Marshal নেই। ব্যাপারটা এখনও বোধগ্যম হলো না।
তবে সবশেষে সাধুবাদ জানাতেই হবে শাহ নেওয়াজসহ সবাইকে, যারা আয়োজনের এত কঠিন একটা শুভকাজ আবার শুরু করার জন্য।