Thikana News
০১ নভেম্বর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫





 

ঐতিহ্যবাহী মেমোরিয়াল ডে-২০২৪

ঐতিহ্যবাহী মেমোরিয়াল ডে-২০২৪





 
আধুনিক বিশ্বের তিলোত্তমা বা অমরাবতী যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর সংলগ্ন ২৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৪ বর্গমাইল বা ৭৬ লাখ ৬৩ হাজার ৯৪০.৬ বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ডসমেত সর্বমোট ৩৮ লাখ বর্গমাইল বা ৯৮ লাখ ৪১ হাজার ৪৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে গঠিত। প্রায় ৩৩ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত সুবিশাল আমেরিকা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে যুগে যুগে অসংখ্য দেশপ্রেমিক আমেরিকান বীর সেনানীকে বুকের তাজা রক্তের ঢল বইতে দিয়ে হয়েছিল। তাদের সুমহান আত্মত্যাগের দুগ্ধবারিতে স্নাত হয়েই কালের অগ্রযাত্রায় বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্র গৌরব ও মর্যাদায় অম্লান। বলার অপেক্ষা রাখে না, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রাচুর্য-সমৃদ্ধি এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আশীর্বাদধন্য যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি। তাই বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লাখ লাখ ভাগ্যান্বেষী মানুষ জীবনঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এই অনিশ্চিত যাত্রায় দুর্গম-দুর্লঙ্ঘ পথ ও শ্বাপদসংকুল বন-বাদাড় মাড়াতে গিয়ে অনেকের পথিমধ্যেই পার্থিব জীবনের অবসান ঘটছে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে গিয়ে সীমান্তরক্ষীদের সর্বদা গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। অবশ্য বিশ্ব অভিবাসীর শ্রম-ঘামে গড়ে ওঠা আমেরিকাও বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে সকল অভিবাসীকে নিজের সুশীতল নীড়ে যথাসম্ভব নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে।
যাহোক, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল ছিন্ন করতে গিয়ে লাখ লাখ আমেরিকানের আত্মাহুতির যে সূচনা ঘটেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়েও অসংখ্য দেশপ্রেমিক আমেরিকানকে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায়। আর সকৃতজ্ঞ জাতি ও দেশ প্রতিবছরের মতো এবারও ২৭ মে সোমবার হৃদয়ভান্ডার উজাড় করে দেশবরেণ্য বীর সৈনিকদের পরম শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছে। গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে গোড়ার দিকে ডেকোরেশন ডে (বরেণ্য দিবস) হিসেবে এর উদ্্যাপন সূচিত হয়। পরে ১৯৭১ সালে এটি ফেডারেল হলি ডে (জাতীয় ছুটি দিবস) হিসেবে দাপ্তরিকভাবে অনুমোদন লাভ করে। চোখ ঝলসানো কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আমেরিকানরা এই বিশেষ দিবসটি উদ্্যাপন করে থাকেন। এই বিশেষ দিবসে বহু আমেরিকান গোরস্থান ও স্মৃতিসৌধে পারিবারিকভাবে জড়ো হন এবং প্যারেডেও অংশগ্রহণ করেন। মূলত প্রথাগতভাবে মেমোরিয়াল ডের মধ্য দিয়ে উত্তর আমেরিকায় অনানুষ্ঠানিকভাবে গ্রীষ্ম ঋতুর সূচনা হয়ে থাকে। অবশ্য বর্তমানে মেমোরিয়াল ডে অবকাশে আমেরিকানদের সপরিজনে প্রমোদভ্রমণ, গোগ্রাসে হটডগ বারবিকিউ গলাধঃকরণ প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষঙ্গ সংযোজিত হয়েছে।
মেমোরিয়াল ডে : যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে কর্মরত যেসব যোদ্ধা দেশমাতৃকার স্বার্থে হাসিমুখে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে মেমোরিয়াল ডে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। দেশের খাতিরে আত্মোৎসর্গকারী বীর সৈনিকদের প্রতি জাতীয় পর্যায়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর মে মাসের শেষ সোমবার এটি উদ্্যাপন করা হয়। ১৯৬২ সালের মেমোরিয়াল ডের প্রশান্তির প্রার্থনায় ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন ফিটজগার্লড কেনেডি বলেছিলেন, আমাদের বীর সেনানীদের প্রতি আমেরিকানরা শুধু শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন না, বরং ন্যায় ও স্থায়ী শান্তির সন্ধানে সাফল্য লাভের জন্য আমেরিকানদের ঐক্যবদ্ধ প্রার্থনা করা উচিত। মেমোরিয়াল দিবসে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর প্রয়াত বীরদের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদর্শনের লক্ষ্যে সারা দেশে জনগণ প্যারেডে অংশ নেন, বীর সৈনিকদের কবরগুলোকে বর্ণাঢ্যভাবে সুশোভিত করেন এবং সূর্যাস্ত থেকে দুপুর পর্যন্ত জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এদিকে ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস ন্যাশনাল মোমেন্ট অব রিমেম্বারেন্স অ্যাক্ট পাস করে। ওই আইনের আওতায় মেমোরিয়াল ডে প্রার্থনা এবং শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্থানীয় সময় বেলা তিনটা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। স্মর্তব্য, আমেরিকানদের ফেডারেল ছুটির প্রকৃত কারণ স্মরণ করিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে ক্লিনটন প্রশাসন ন্যাশনাল মোমেন্ট অব রিমেম্বারেন্স (জাতীয় স্মরণ মুহূর্ত) প্রবর্তন করেছিল।
ফিরে দেখা অতীত : অনস্বীকার্য যে, দ্য সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক, হৃদয়বিদারক ও ঐতিহাসিক ঘটনা। এই গৃহযুদ্ধ কনফেডারেসি এবং উগ্রপন্থী শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদী মনোবৃত্তির সুরক্ষিত হর্মে বড় ধরনের ফাটল ধরিয়েছে। তাই ১৮৬৫ সালের বসন্তকালের শেষে গৃহযুদ্ধের অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে মোড় নেয়। বস্তুত শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদের সমূল উৎপাটন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে দাসত্ব প্রথার কলঙ্কমুক্ত করার খাতিরে স্বয়ং ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ওই গৃহযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সহায়-সম্পদের বর্ণনাতীত ক্ষয়ক্ষতি এবং ব্যাপক প্রাণহানির পর অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রে দাসমুক্তি সনদ বাস্তবায়িত হয়। ১৮৬৫ সালের ১৯ জুন দাসমুক্তি সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হওয়ায় আফ্রিকান-আমেরিকানরা একে কৃষ্ণকায়দের প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদ্্যাপন করে থাকে। গৃহযুদ্ধের অবসানের পর অবশ্য গুপ্তঘাতকের গুলিতে প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনও প্রাণ হারান। তৎকালীন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের প্রথম জাতীয় গোরস্থানগুলো প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বীর সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা প্রদর্শনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ১৮৬০ দশকের শেষ পাদে বিভিন্ন শহর এবং নগরে আমেরিকানরা বসন্তকালীন শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন শুরু করেন। তারা প্রয়াতদের আত্মার চিরপ্রশান্তি কামনায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিরও আয়োজন করতেন। অবশ্য মেমোরিয়াল ডে ঐতিহ্যের আদি উৎস সম্পর্কে কোনো তথ্যভিত্তিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কমিউনিটি স্বাধীনভাবে মেমোরিয়াল সমাবেশের আয়োজন করে থাকে। তবে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী, গৃহযুদ্ধে কনফেডারেসির আত্মসমর্পণের এক মাসের মধ্যেই সদ্য দাসত্বমুক্ত সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ার চার্লসটনের একদল জনতা সর্বপ্রথম মেমোরিয়াল ডে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপনের শুভসূচনা করে। পরে ১৯৬৬ সালে ফেডারেল সরকার নিউইয়র্কের ওয়াটারলুকে দাপ্তরিকভাবে বার্থপ্লেস অব মেমোরিয়াল ডে (বরেণ্য দিবসের জন্মস্থান) ঘোষণা করে।
ঐতিহাসিক ওয়াটারলু : ১৮৬৬ সালের ৫ মে ওয়াটারলুর সর্বস্তর ও পেশার বাসিন্দারা সকল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কেনাকাটা বন্ধ করে দিয়ে নিহত সৈনিকদের কবরগুলোকে চোখ ঝলসানো ফুল ও বাহারি রঙের পতাকা দিয়ে সুসজ্জিত করেছিলেন এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক বার্ষিক অনুষ্ঠানমালার সূচনা করেছিলেন।
ডেকোরেশন বা বরেণ্য দিবস : ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৮৬৮ সালের ৫ মে ‘নর্দার্ন সিভিল ভেটারন’ শীর্ষক অর্গানাইজেশনের নেতা জেনারেল এ লোগান মে মাসের শেষে জাতীয়ভাবে একটি স্মরণীয় দিবস উদ্যাপনের উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি বজ্রদীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, বিগত বিপ্লবের সময় যেসব বীর সেনানী দেশকে রক্ষায় আত্মাহুতি দিয়েছেন এবং যাদের মরদেহ প্রতিটি সিটি, গ্রাম ও গির্জার পাদদেশের পুণ্যভূমিতে সমাহিত রয়েছে, তাদের সমাধিগুলোকে ১৮৬৮ সালের ৩০ মে পুষ্পশোভিত কিংবা বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত করা হবে। মূলত আমেরিকার ইতিহাস পর্যালোচনা করে ৩০ মে কোনো যুদ্ধবিগ্রহ বার্ষিকী উদ্্যাপনের প্রমাণাদি পাওয়া না যাওয়ায় জেনারেল এ লোগান ৩০ মেকে ডেকোরেশন ডে বা বরেণ্য দিবস হিসেবে উদ্্যাপনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে, প্রথম ডেকোরেশন বা শোভন দিবসে সিভিল ওয়ারে নিহত ২০ সহস্রাধিক সৈনিকের সমাধিস্থল আর্লিংটন ন্যাশনাল সেমিটারিতে (জাতীয় গোরস্থানে) ৫ সহস্রাধিক অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতিতে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়েছিলেন জেনারেল জেমস গারফিল্ড। নিহতদের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের স্তুতিবাদ ছাড়াও জেনারেল জেমস গারফিল্ড তাদের আত্মার চিরপ্রশান্তি কামনা করেছিলেন। এদিকে পরবর্তী বছরগুলোতে অনেকগুলো নর্দার্ন স্টেটও অনুরূপ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বিশেষ স্মরণসভার আয়োজন করে এবং ১৮৯০ সাল নাগাদ প্রতিটি স্টেটই দাপ্তরিকভাবে ডেকোরেশন ডে ছুটি অনুমোদন করে। পক্ষান্তরে প্রথম বিশ^যুদ্ধের সমাপ্তির আগ পর্যন্ত সাউদার্ন স্টেটগুলোর বাসিন্দারা আলাদা দিবসগুলোতে বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রথা অব্যাহত রাখেন।
যাহোক, নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে সময়ের অগ্রযাত্রায় তিন দিন সপ্তাহান্ত ছুটির উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার বানে মেমোরিয়াল ডের প্রকৃত তাৎপর্য ও ঐতিহ্য বহুলাংশে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মেমোরিয়াল ডে-কেও বাণিজ্যিক উপকরণে পরিণত করার ব্যাপক তৎপরতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকেই জাতীয় বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পরিবর্তে দীর্ঘ অবকাশে সপরিজনে প্রমোদ ভ্রমণসহ নানাবিধ বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে মগ্ন হচ্ছেন।
ঐতিহাসিক মেমোরিয়াল ডে উপলক্ষে ঠিকানার পক্ষ থেকে বীর শহীদদের আত্মার চিরপ্রশান্তি এবং তাদের স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
২৭ মে ২০২৪

কমেন্ট বক্স