ইসলাম শান্তির ধর্ম। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলাম প্রথম মানবাধিকার নিশ্চিত করেছে। মানবাধিকার বলতে সেই অধিকারকে বোঝায় যা নিয়ে মানুষ জন্মায় এবং যা তাকে বিশিষ্টতা দেয় এবং যা হরণ করলে সে আর মনুষ্যত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারে না।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মদিনা রিপাবলিকে ৬২২ ইসায়ী সনে প্রণীত ৪৭টি শর্ত সংবলিত ‘মদিনা সনদ’ বা Charter of Madina ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। এ সনদে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার ও মর্যাদার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
খ্রিষ্টান, ইহুদি, পৌত্তলিক ও ‘মুসলিম সমঅধিকার গঠিত মদিনার বহু ধর্মভিত্তিক সমাজে প্রণীত ওই সনদে উল্লেখ ছিল-‘মদিনায় ইহুদি, নাসারা (খ্রিষ্টান), পৌত্তলিক এবং মুসলিম সবাই এক দেশবাসী, সবারই নাগরিক অধিকার সমান।’ সমানাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পৃথিবীর জন্য এটিই ছিল প্রথম।
আল কুরআন বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার অনন্য গাইড বুক। ইসলাম শোষণ-বঞ্চনা দূর করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ বিষয়ে আল কুরআনের নির্দেশ হলো-দুষ্টকে দমন করে শিষ্টের লালন করতে হবে। অর্থাৎ সৎ ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করতে হবে এবং অপরাধী ও অসৎ লোকদের অন্যায় ও অবিচারকে প্রতিহত করতে হবে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম নির্দেশিত মৌলিক ৪টি দায়িত্ব সম্পর্কে আল কুরআন ঘোষণা করেছে-‘যদি আমি তাদেরকে (বা মুসলমানদের) কোনো ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠা দান করি তাহলে তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করে ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করে। সব কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে।’ (২২/সূরা আল হাজ : ৪১)।
অর্থাৎ কুরআন নির্দেশিত দায়িত্বগুলো হলো-১. সচ্চরিত্র জাতি গঠনের জন্য নামাজ প্রতিষ্ঠিত করা (২৯/সূরা আনকাবুত-৪৫ দ্রষ্টব্য)। ২. ন্যায়বিচারপূর্ণ অর্থব্যবস্থা চালুর লক্ষে জাকাত আদায়ের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা (৯/তাওবা-৬০)। ৩. জনকল্যাণমূলক সব কাজ চালু করা এবং ৪. অনিষ্টকর সব কাজ বন্ধ করা। আল্লাহপাক যে বিধান আল কুরআনের মাধ্যমে দিয়েছেন আল্লাহর দৃষ্টিতে তা প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম করাই একজন প্রকৃত শান্তিকামী মানুষের পরিচয়।
ইসলামের মূল চাওয়া হচ্ছে, সব মানুষ আল্লাহর গোলাম হয়ে যাক, মানুষ যেন একে-অপরের গোলামি না করে। তাই তো আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা ও আদেশ দান করা।’ (৭/সূরা আলাফ-৫৪)। আল্লাহর অনুগত বান্দার নেতৃত্ব ছাড়া অন্যের গোলামিতে বাধ্য হতে হয় বলেই ইসলামের লক্ষ্য সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা।
আর সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত আছে শান্তি। দক্ষতা ছাড়া সততা অকেজো এবং সততা ছাড়া দক্ষতা বিপজ্জনক। হাদিসে আছে, দেশ শাসনভার আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে পবিত্র আমানত। এ আমানতের খিয়ানত হতে বিরত থাকলে শান্তি প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত সহজ।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসনের বিকল্প নেই। আল কুরআনে আমাদের যে কোনো মূল্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং এতে যদি আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়, তবে তাও করতে হবে বিনা দ্বিধায়। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন সে অনুযায়ী বিধান (বা বিচার-ফায়সালা বা সিদ্ধান্ত) দেয় না তারাই অবিশ্বাসী।’ (৫/সূরা আল মায়িদাহ-৪৪)। আর, আল্লাহর দেওয়া বিধানে কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব নেই।
এ বিধান অনুযায়ী সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই ইসলাম শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করেছিল। সামাজিক ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলাম-সমাজের মানুষকে কষ্ট দেওয়ার নাম ইসলাম নয়। রাসূল (সা.) আমাদের মানুষের হৃদয়কে সন্তুষ্ট করতে, ক্ষুধার্তকে আহার করাতে, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করতে, ব্যথিত লোকের ব্যথার উপশম করতে ও অন্যায়ভাবে কষ্টপ্রাপ্ত লোকের কষ্টের প্রতিকার করতে নির্দেশ দিয়ে এ কাজগুলোকে সর্বোত্তম কাজ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।
তিনি আমাদের চরিত্রবান হতে উৎসাহিত করেছেন। কেননা সামাজিক শান্তির জন্য প্রয়োজন উত্তম চরিত্রসম্পন্ন মানুষ। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে- ‘রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই উত্তম যার স্বভাব উত্তম।’ (বুখারি, মুসলমি) উত্তম চরিত্রবান তাকেই বলে যিনি ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতি নয় বরং সার্বজনীন স্বার্থের দিকে অধিক গুরুত্ব দেয়। সমাজের অন্যায় নির্মূল করতে ইসলাম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাও করেছে। (৫/সূরা আল মায়িদাহ-৩৮ দ্রষ্টব্য)।
পুঁজিবাদী অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য ইসলাম সুদভিত্তিক শোষণব্যবস্থার পরিবর্তে জাকাতভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বলেছে। হালাল রুজি সন্ধান করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) সন্ধান করবে।’ (৬২/সূরা জুমুআ-১০)। ধন সঞ্চয়ের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আল কুরআনে বলা হয়েছে-‘যাতে এ সম্পদ শুধু ধনীদের কুক্ষিগত না হয়ে পড়ে।’ (৫৯/সূরা হাশর-৭)।
ইসলাম প্রতিশোধে নয় প্রতিকারে বিশ্বাসী। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন যারা সিসানির্মিত প্রাচীরের মতো আল্লাহর পথে (অর্থাৎ ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য) সারিবদ্ধভাবে চেষ্টা করে।’ (৬১/সূরা আস সফ-৪)। কাজেই পার্থিব জীবনে ও পরকালীন অনন্ত সময়ের চিরস্থায়ী শান্তির লক্ষে মুসলমানদের সব হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্য ও সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। লেখক : মো. লোকমান হেকিম
ঠিকানা/এসআর