ঠিকানা রিপোর্ট : শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ‘অন্যায় আচরণের শিকার’- এমন অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাবর খোলাচিঠি লিখেছেন বিশ্বের ৪০ বিশিষ্ট ব্যক্তি। রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রের ওই ৪০ বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা খোলাচিঠিতে ড. ইউনূসের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আচরণে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। চিঠিটি গত ৭ মার্চ মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের ৭ নম্বর পৃষ্ঠাজুড়ে বিজ্ঞাপন আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। পরদিন ৮ মার্চ সেই বিজ্ঞাপনকে খবর আকারে প্রকাশ করেছে দেশের বেশ কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পোর্টাল। তবে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত বিজ্ঞাপনটিতে ড. ইউনূস কী ধরনের অন্যায় আচরণের শিকার হয়েছেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকার অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে ৪০ বিশ্বনেতার নামে বিজ্ঞাপন আকারে খোলাচিঠি প্রকাশের ঘটনায় দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এর সমালোচনা করেছেন। তারা এটিকে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের নতুন কৌশল বলে গণ্য করছেন।
ইংরেজিতে লেখা ওই চিঠিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠিতে নিজেদেরকে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিয়ে ৪০ বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন, ‘যারা আপনার দেশের জনগণের সাহস ও উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রশংসা করে, আমাদের মধ্যে সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের নেতা ও সমাজসেবক আছেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতো আমরাও বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ও সারা বিশ্বে গৃহীত উদ্ভাবনগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত। আপনার দেশের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থেকেই আমরা আপনাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের একজন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মহান অবদানকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
ড. ইউনূস বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মানবিক উন্নয়নে যে অবদান রেখে চলছেন, তা অব্যাহত রাখতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। তারা বলেন, টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিতে কীভাবে একটি প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে লালন করা যেতে পারে, সে বিষয়ে অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবে বাংলাদেশ তার ভূমিকায় ফিরে আসবে, এ ব্যাপারে আশাবাদী। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই অধ্যাপক ইউনূসের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। তাকে নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত না রেখে দেশ-বিশ্বের জন্য আরও ভালো কিছু করার শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্বের কোটি মানুষ আশা করে, এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য হবে।
চিঠিতে সই করেছেন সংগীতজ্ঞ ও অধিকারকর্মী বোনো; ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন; ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট লর্ড মার্ক ম্যালোচ ব্রাউন; সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন; রেজাল্টস অ্যান্ড সিভিক কারেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ডেলি-হ্যারিস; ডাল্লায়ার ইনস্টিটিউট ফর চিলড্রেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির প্রতিষ্ঠাতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) রোমিও ডাল্লায়ার; এমেরিতা চিলড্রেন ডিফেন্স ফান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট মারিয়ান রাইট এডেলম্যান; মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিসেন্ট ফক্স; সংগীতজ্ঞ পিটার গ্যাব্রিয়েল; নাসার সাবেক মহাকাশচারী রন গারান; ইউনিসেফের সাবেক উপনির্বাহী পরিচালক ও জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব কুল গৌতম; গ্লাসগো ক্যালেডিনিয়ান ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক পামেলা গিলিস; রকফেলার ফাউন্ডেশন ও ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পিটার সি গোল্ডমার্ক জুনিয়র; অধিকারকর্মী জেন গুডাল; যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর; রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সিইও জন হিউকো; উদ্যোক্তা ও সমাজসেবী মো. ইব্রাহিম; ইংল্যান্ডের হাউস অব লর্ডসের কেসি মেম্বার ব্যারনেস হেলেনা কেনেডি; রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি; টেড কেনেডি জুনিয়র; ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বিনোদ খোসলা; জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন; গায়ক, গীতিকার ও অধিকারকর্মী অ্যানি লেনক্স; মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আর্থার লেভিট; সাবেক মার্কিন কম্পট্রোলার অব দ্য কারেন্সি ও স্প্রিং হারবার হোল্ডিংসের জেন লাডউইগ; ভিএমওয়্যারের সাবেক সিইও পল মারিজ; ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব শিকাগোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সিইও মাইকেল এইচ মস্কো; ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি; চ্যাথাম হাউসের সাবেক প্রধান নির্বাহী স্যার রবিন নিবলেট; বিশ্বব্যাংকের সাবেক ইউএস বোর্ড ডিরেক্টর ও সাউদার্ন ব্যান করপোরেশনের উপদেষ্টা জ্যান পিয়ারসি; ইয়েল ল’ স্কুলের স্টার্লিং প্রফেসর অব ল রবার্ট পোস্ট; মিশিগানের সাবেক মার্কিন সিনেটর এবং ব্যাংকিং, হাউজিং ও নগর উন্নয়ন-সংক্রান্ত সিনেট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান ডোনাল্ড রিগেল; আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন; এলেন সিডম্যান; অভিনেত্রী ইয়ার্ডলি স্মিথ; অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন; ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ইমেরিটাস অধ্যাপক ডেভিড সুজুকি; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাইড স্কুল অব বিজনেসের সাবেক ডিন পিটার তুফানো; বৈশ্বিক নারীবিষয়ক সাবেক মার্কিন অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ মিলেন ভারভির এবং উইকিপিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলস।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গ্রামীণ টেলিকমের মালিক ও গ্রামীণ ফোনের প্রায় ৩৪ শতাংশের মালিক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশংসা করে বিশ্বের ৪০ জন খ্যাতনামা ব্যক্তির বক্তব্য ওয়াশিংটন পোস্টে ছাপা হওয়ার পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা, মুখরোচক গল্প আর উঠেছে নানা প্রশ্ন। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রীসহ সরকার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
কাতার সফর নিয়ে ১৩ মার্চ সোমবার বিকেলে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে ৪০ জনের নাম ব্যবহার করেছে আমাদের বিশেষ একজন ব্যক্তির পক্ষে, এর উত্তর কী দেব জানি না। আমার একটা প্রশ্ন আছে, প্রশ্নটা হলো যিনি এত নামীদামি নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত, তার জন্য ৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট দিতে হবে কেন? তাও আবার বিদেশি পত্রিকায়। এটাই আমার প্রশ্ন আর কিছু নয়। অ্যাড দিতে হলো কেন?’
গত ৯ মার্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ড. ইউনূসের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আচরণের বিষয়ে যে অভিযোগগুলো তুলে বিশ্বনেতারা উদ্বেগ জানিয়েছেন, সেগুলো একেবারে অলীক।
১০ মার্চ তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘এটি একটি বিজ্ঞাপন। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে ৪০ জনের নামে একটি বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়েছে। বিজ্ঞাপন আর বিবৃতির মধ্যে পার্থক্য আছে। এ রকম বিবৃতি কেনা বা বিজ্ঞাপন দিয়ে বিবৃতি, সেটাকে আবার কোটি টাকা খরচ করে প্রকাশ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। যেভাবেই হোক, ইউনূস সাহেব নোবেলজয়ী। তার পক্ষে এ রকম একটা বিবৃতি বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাপানো, এটি তার ব্যক্তিত্বকেই খর্ব করেছে। আমার প্রশ্ন, তার এত টাকা কোথা থেকে আসে?’
ড. ইউনূসের পক্ষে ৪০ বিদেশির ওই চিঠির প্রতিবাদ জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিষদ। সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক পরিষদের ৫০ বুদ্ধিজীবীর পক্ষে ১১ মার্চ শনিবার এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ ইউনূসের ‘ভালো থাকা নিয়ে উদ্বেগ’ জানানো ৪০ বিদেশির বক্তব্য বাস্তবতাবর্জিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ড. ইউনূসকে মহানায়ক বানাতে তৎপর মার্কিন লবি : ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকমের দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অর্থ লোপাট, কল্যাণ তহবিলের অর্থ বিতরণ না করে ৪৫ কোটি ৫২ লাখ ১৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ এবং ২ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরের অভিযোগ রয়েছে।
এ অবস্থায় গত বছরের অক্টোবরে ইউনূসকে মহানায়ক বানানোর তৎপরতা শুরু করে মার্কিন লবি। গত ৬ অক্টোবর ইউনূসকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্রনিউজ। যুক্তরাষ্ট্রের ফান্ডে দেশটির একটি এনজিওর অর্থায়নে চলে অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি। প্রতিবেদনটি করেন বিতর্কিত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ইউনূসের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
এর এক সপ্তাহ পর ১৩ অক্টোবর ইউনূসকে মহানায়ক বানিয়ে খবর প্রকাশ করে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট। সেখানে বলা হয়, নোবেলজয়ী ইউনূসের বিরুদ্ধে নিপীড়ন বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। এ মাসে তাকে দুদকে উপস্থিত হতে হবে, আসতে পারে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞাও।
ইকোনমিস্টের এই প্রতিবেদন ধরেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রধান কেনিথ রথ টুইট করেন, যেখানে ইউনূসের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। কেনিথের পথেই হাঁটেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম সিএনএনের সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিসটফ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রধান কেনিথের টুইটকে যুক্ত করে রিটুইট করেন তিনি। সেখানে তিনি লেখেন, বিশ্বের জন্য অনেক করেছেন ড. ইউনূস।