প্রবাসীর সম্পত্তিতে লোলুপ দৃষ্টি আত্মীয়-স্বজনের
প্রবাসীরা বিদেশে অর্জিত অর্থ দিয়ে দেশে সম্পত্তি কেনেন। তাদের স্বপ্ন থাকে অবসর-জীবনে বাংলাদেশে চলে গিয়ে বাকি জীবনটা সেখানেই কাটাবেন। আবার অনেক প্রবাসী প্রবাসে সম্পত্তি না কিনে দেশে সম্পত্তি কেনেন এটা মনে করে যে, তার উত্তরাধিকারীরা একসময় দেশে গিয়ে বাস করবে। কিন্তু যে আশায় বাবা-মায়েরা তার সন্তানের জন্য দেশে সম্পত্তি কেনেন, বেশির ভাগ সন্তানই দেশে যেতে চায় না। তারা সম্পত্তিও নিতে চায় না বরং বলে দেশের সব সম্পক্তি বিক্রি করে ঝামেলা শেষ করে দিতে। কারণ বাংলাদেশে উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তির দখল বুঝে পাওয়া অনেক কঠিন। দেশে সম্পত্তির মালিক হওয়ার চেয়ে সেটি রক্ষা করা আরও কঠিন। আবার অনেকেই উত্তরাধিকারী কিংবা ওয়ালিমা সূত্রে সম্পত্তির মালিক হন। কিন্তু বিদেশে থাকার কারণে প্রবাসীদের সম্পত্তির ওপর আত্মীয়স্বজনদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। তারা প্রবাসীর অংশ বুঝিয়ে দিতে চান না। কেউ কেউ আবার প্রবাসীর সম্পত্তি দখল কওে বসেন। আর কাগজে-কলমে খাসজমি হিসেবে নথিভুক্ত করান। ফলে প্রবাসীরা দেশে গিয়ে নিজের সম্পত্তির দখল নিতে পারেন না। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সময়েরও সীমাবদ্ধতা আছে। সম্পত্তি বুঝে পাওয়ার জন্য যেসব প্রক্রিয়া, তা করার জন্য কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েন। কেউ কেউ আবার সিস্টেম না বোঝার কারণেও সমস্যায় পড়েন। স্পিড মানিও চাওয়া হয় কোনো কোনো অফিসে, সেখানে গিয়েও ভোগান্তির শেষ নেই। সব মিলিয়ে প্রবাসীর সম্পত্তি ও তাদের উত্তরাধিকারী বা ওয়ারিশদের সম্পত্তি বুঝে নিতে গিয়ে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেকেই পরিস্থিতি জটিল হওয়ার কারণে হাল ছেড়ে দেন। আবার কেউ কেউ হাল ধরে থাকেন। সব মিলিয়ে অনেক প্রবাসীই দেশের সম্পত্তি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে সময় পার করছেন। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও যাকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন, তিনিও দখলের চেষ্টা করেন। এমনকি নকল মালিক সেজে তারা প্রবাসীর জমির ওপর ব্যাংক থেকে লোন নেন। একটি নয় একাধিক ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সম্পত্তির নামে লোন নিয়ে তারা অর্থ আত্মসাৎ করেন। প্রবাসীর সম্পত্তি যারা দখল করেন তারা ক্ষমতাবান। এ কারণে কোনো প্রবাসী তার সম্পত্তি ফিরে পেতে গেলে তাকে নানা ধরনের হুমকি-ধমকিও দেওয়া হয়। প্রাণে মারার হুমকি পেয়ে প্রবাসীরা দেশ ছেড়ে চলে আসতে হন। এসব শ্রেণি ছাড়াও বিভিন্ন সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী টার্গেট করে প্রবাসীদের সম্পত্তি দখল করে নেয়।
ভুক্তভোগী অনেক প্রবাসী বলেছেন, তারা প্রবাসে অনেক কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে দেশে সম্পত্তি করেছেন। প্রবাসে থাকেন বলে এসব সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব কাউকে না কাউকে দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেই কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, দেখাশোনা করতে করতে একসময় ওই সম্পত্তির ওপর তাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। তারা স্বপ্ন দেখেন সম্পত্তিটি নিজের করে নেওয়ার। সুযোগ বুঝে একপর্যায়ে দখলই করে বসেন। যারা বাড়ি দেখাশোনা করেন, প্রবাসী মালিক দেশে গেলে প্রথম কয়েক দিন তারা খুশি থাকলেও একসময় বিরক্ত হন যে তিনি বিদেশে চলে যাচ্ছেন না কেন। কারণ প্রবাসী মালিক দীর্ঘদিন দেশে থাকলে তাদের মনে একধরনের ভয় কাজ করে। তারা মনে করেন, এই বুঝি মালিক ফিরে এল এবং সম্পত্তিটির দখল চলে গেল। এই আশঙ্কা থেকে প্রবাসী যখন দেশে যান, তখন নিজে কিংবা তার পরিবার-পরিজনের মাধ্যমে ওই রক্ষক ব্যক্তিটি বিভিন্ন কৌশলে জানার চেষ্টা করেন, তিনি কবে বিদেশে ফিরে যাবেন। সংশ্লিষ্ট প্রবাসী দ্রুত ফিরে যাওয়ার কথা শুনলে তারা স্বস্তি পান কিন্তু দীর্ঘ সময় দেশে অবস্থানের কথা শুনলে তাদের দুশ্চিন্তা বাড়ে।
পরিবারের সদস্য কিংবা আত্মীয়স্বজন ছাড়া যারা বাইরের মানুষের কাছে বাসাবাড়ি বা সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব দেন, সেখানে আরও ভয়ানক চিত্র। এ ক্ষেত্রে সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য সাধারণত একজন ম্যানেজারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই ম্যানেজারই সম্পত্তি দখল করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। প্রবাসীদের মধ্যে যাদের দেশে পরিবারের কেউ নেই, তাদের প্রাণ নিয়ে ফিরে আসাও কঠিন হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন খবর থেকে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রবাসীদের বাড়ি কিংবা জমি দখলের ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। জীবিকার তাগিদে ২৭ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন আলাউদ্দিন আহম্মদ হারুন। এর মধ্যে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বড় ভাই কামাল উদ্দিন আহম্মদের সঙ্গে যৌথভাবে আড়াই কাঠা জমি কেনেন। সেখানে দুজনের অর্থায়নে বহুতল বাড়িও নির্মাণ করা হয়। তবে এক যুগ পর ২০২৩ সালে দেশে ফিরে আলাউদ্দিন দেখেন, পুরো বাড়ির মালিকই তার বড় ভাই। তিনিই নাকি হেবা দলিল (দানপত্র) করে ভাইকে জমি-বাড়ি দিয়েছেন! কাগজপত্রও সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন আলাউদ্দিন। তদন্তে বেরিয়ে আসে, কৌশলে ভুয়া দলিল বানিয়ে পুরো সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছেন কামাল।
২৪ বছর ধরে ইতালিপ্রবাসী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকুট গ্রামের মো. তাজুল ইসলাম ২০২২ সালে এসেছিলেন ছুটিতে। এসেই দেখেন ২৪ শতাংশের একটি পুকুর এবং বসতবাড়ি-সংলগ্ন ১১ শতাংশ জমি বেদখল হয়ে গেছে। বাংলাদেশ দূতাবাসে করা তাজুলের অভিযোগ থেকে জানা যায়, তারই ভাতিজা ছদর উদ্দিন মানিক ও তার পরিবারের অন্যরা মিলে এই সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন। ছদর উদ্দিন মানিক ঢাকা কাস্টমস বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা।
শুধু একজন আলাউদ্দিন কিংবা তাজুল নন, তাদের মতো হাজারো প্রবাসীর স্থাবর সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে নানা কৌশলে। সাতক্ষীরার দেবহাটার শিমুলিয়ায় আদালতের নির্দেশ অমান্য করে আমেরিকান প্রবাসী শামসুর রহমান রতন কাজী নামে ৮৪ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের ৪১ বছরের ভোগদখলীয় জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলামসহ তার লোকজনের বিরুদ্ধে। মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা চাচা-ভাতিজা আমেরিকান বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ছিল। এর জের ধরে মুন্সিগঞ্জে ভাতিজা তার চাচাকে গুলি করেন। পরে চাচা নিহত হন। এরপর ওই প্রবাসী আটক হন। তাকে দেশ থেকে এখানে এনে কারাগারে আটক রাখা হয়। গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পূর্ব থানা এলাকার ৫০ নং ওয়ার্ডের শালিকচূড়া বাসপট্টি এলাকায় আমেরিকান প্রবাসী নুরনবী চৌধুরী ও তার ভাইদের জমি দখল করে সড়ক নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে গাজীপুর সিটির ৫০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী আবু বক্কর সিদ্দিকের বিরুদ্ধে। উত্তরাধিকারী জাল সনদ তৈরি করে সিলেটের বিয়ানীবাজারে যুক্তরাজ্য প্রবাসীর সম্পত্তি নিজ নামে রেকর্ড করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের সৌদি প্রবাসী মাহফুজুর রহমান উপজেলার হাড়িয়া চৌধুরীপাড়া এলাকায় ২৭ শতাংশ জমি কিনে ঘর তোলেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা ওই জমি থেকে সোয়া তিন শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ইতালি প্রবাসী মো. নবী হোসেনের কেনা ১০ লাখ টাকার জমি প্রতারণামূলকভাবে দলিল করে দখলে নিয়েছেন তারই ভগ্নিপতি মো. আব্দুল হক চিশতী। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে মোহাম্মদ আলী নামের এক প্রবাসীর ৪২ শতক জমি দখল করে অবৈধ ইটভাটা স্থাপন করার অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার লক্ষ্মণপুর ইউনিয়নের বেতিয়াপাড়া গ্রামে যমুনা ব্রিকফিল্ড নামে এ অবৈধ ইটভাটা গড়ে তুলেছেন আমিন উল্লাহ মজুমদার নামের এক ব্যক্তি। মাদারীপুরের কালকিনিতে মোহাম্মদ আলী হোসেন সরদার নামে এক পাকিস্তান প্রবাসীর ২২ শতাংশ জমি দখল করে বসতঘর নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে। ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ আলমনগর গ্রামের ওমান প্রবাসী মো. জহিরুল ইসলামের বসতভিটার সামনের প্রায় ২৪ শতাংশ ভিটেজমি জবরদখল করে প্রভাবশালী প্রতিবেশীরা ঘর উঠিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী প্রবাসী পরিবার। সারা দেশে এ রকম শত শত উদাহরণ রয়েছে।
প্রবাসীদের নিজেদের কেনা সম্পত্তি যেমন বেদখল হচ্ছে, তেমনি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিও বুঝিয়ে দিচ্ছেন না তার পরিবারের অন্য সদস্যরা। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী এক প্রবাসী বলেন, আমার নানার বাড়ির সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। ওই সম্পত্তি বুঝে নেওয়ার জন্য দেশে গিয়েছি। দেশে গিয়ে দেখি, আমার ওই সম্পত্তি এখন আর আমাদের নেই। কারণ ওই সম্পত্তি খাসজমি হয়ে গেছে। এটি ইচ্ছে করেই আমার মামা করিয়েছেন। আমার সব মামাই এখানে থাকেন কেবল একজন ছাড়া। তিনি দেশে থাকেন। তিনি সেখানে সব সম্পত্তি ভোগ করছিলেন। তিনি খাজনাও দেননি। এ কারণে ওই সম্পত্তি খাস হয়ে গেছে। এখন ওই সম্পত্তি চাইলেও আমরা আমাদের নামে করতে পারছি না। ওটি যে খাসজমি নয়, আমরা উত্তরাধিকারী আছি, আগে সেটা আদালতে প্রমাণ করতে হবে। সেটি প্রমাণ করতে হলে আমাদের অনেক সময় লাগবে। কারণ এ নিয়ে আমার মামা আবার একটি মামলাও ঝুলিয়ে দিয়েছেন। ওই সম্পত্তি অনেক বড়। ঢাকার সেন্টারে জায়গা। তিনি বলেন, জমিজমা-সংক্রান্ত মামলা নিস্পত্তি হতে অনেক সময় লাগে। তিনি বলেন, এ রকম কেবল আমি নই। আমার মতো অনেক প্রবাসীর ভাগ্যে এমন ঘটনা ঘটেছে। আত্মীয়স্বজনেরাই দেখা যাচ্ছে সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছে। ফলে সেখানে ওয়ারিশরা বা উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তি বুঝে নিতে পারছেন না।
এ বিষয়ে জ্যামাইকা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের (জেবিএ) সাধারণ সম্পাদক রাব্বী সৈয়দ বলেন, প্রবাসীরা দেশে পদে পদে সম্পত্তি নিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রথমত, উত্তরাধিকারী সম্পত্তি দেশে যার দখলে আছে, তিনি একাই সব দখল করতে চান। অন্যদের ভাগ বুঝিয়ে দিতে চান না। আবার যাকে সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়, সেটি তিনি দেখাশোনার নাম করেই দখল করে নেন। অনেক সময় দেখা যায়, সম্পত্তি নিয়ে মারামারি ছাড়াও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটছে।
রাব্বী সৈয়দ আরও বলেন, প্রবাসীদের কেউ উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি পেলে তা বুঝে পাওয়া ও নামজারি করা এখন অনেক কঠিন। এটাতে আবার নানা ধরনের স্পিড মানির দরকার হয়। আর বিদেশ থেকে সম্পত্তি দখল করার জন্য দেশে গেলে একজন প্রবাসীর যে ধরনের সহায়তা পাওয়া দরকার, সেটি অনেক সময় পাওয়া যায় না। এ জন্য একটি আলাদা ডিপার্টমেন্ট অথবা টাস্কফোর্র্স করা দরকার, যাতে প্রবাসীদের সকল সম্পত্তির জটিলতা ও সমস্যার সমাধান হয়। কেউ যাতে প্রবাসীর সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করতে না পারে, তাও নিশ্চিত করা দরকার।
কমেন্ট বক্স