নজরুলের এক দীর্ঘতম অভিব্যক্তির নিঃসংকোচ বর্ণনা দেখতে পাই-
‘বল ত এ-সব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা? -ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে
আছে লিখা।
তুমি জান না কো, কিন্তু পথের ধূলিকণা জানে
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে।
আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায় ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে সেবিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরই গান,
তাদেরই বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজম মহা-উত্থান,
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান!’
(কুলি-মজুর)
কাজী নজরুল ইসলাম যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন সমগ্র বিশ্বের পরিস্থিতি ছিল টলটলায়মান এবং অনেকটা ভারসাম্যহীন। মানুষের মধ্যকার বিশ্বাসের নানা রকম টানাপোড়েন এবং মানবিক সংকট। নিপীড়িত মানুষের সীমাহীন সমস্যা, অন্যদিকে বিশ্বের রাষ্ট্রতান্ত্রিক বৃত্ত ভেঙে সুপার পাওয়ারসমূহের অস্ত্র প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি। সর্বত্র যুদ্ধংদেহী মনোভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ এবং জনগোষ্ঠীর ওপর শক্তিমত্তা পরিদর্শন ও আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। সেই সঙ্গে ভারতবর্ষে ২০০ বছরের গোলামি যুগ।
তখন বিশ্বের অনেকগুলো রাষ্ট্র ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনাধীন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দুঃশাসন, নিপীড়ন ও শোষণমূলক ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যেই ভারতবর্ষে অনেক বিখ্যাতজনের আবির্ভাব ঘটে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ, নিপীড়িত গণমানুষের মুক্তির দিশারি বিদ্রোহী কবি ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের অন্যতম।
ছোটবেলা থেকেই নজরুলের মাঝে আশ্চর্য রকম মেধা-মনন ও প্রতিভার উজ্জ্বলতম দিকগুলো ফুটে উঠতে থাকে। যদিও শিশুকাল থেকেই তাঁকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাল্যকালেই তিনি পিতৃহীন হয়ে এতিম হয়ে যান। ফলে ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের কশাঘাতের যন্ত্রণা, অভিভাবকহীন এবং ভোগান্তি তাঁকে মর্মে মর্মে উপলুব্ধ ও মুখোমুখি করেছে।
তবে এ কথা সত্যি, কাজী নজরুল ইসলামের পারিবারিক ঐতিহ্য ও সুনাম ছিল। তিনি ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। কিন্তু জন্মের সময়কালে তাঁর পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিল না। ফলে নানা রকম টানাপোড়েনে এবং দারিদ্র্যের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। এ জন্য কৈশোরোত্তীর্ণের আগেই পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁকে চাকরি করতে হয়েছে। মসজিদের খাদেম কিংবা রুটির দোকানে কাজ করতে হয়েছে। লেটো দল কিংবা নানান কিসিমের মানুষের মাঝে তিনি কাজ করেছেন। একসময় চা-রুটির দোকানে চাকরিও করেছেন। একজন মজুরের জীবনের কশাঘাত কেমন কঠিন হতে পারে, নজরুল তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। মানুষের প্রতি পেশিশক্তির অবিচার, নিপীড়ন ও অত্যাচারের মাত্রা দেখে ক্রমাগত নজরুলকে সংক্ষুব্ধ করে তোলে। তাঁর ভেতরকার জেদ ও অপ্রতিরোধ্য চেতনা কুলি-মজুর থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের কল্যাণের কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়।
‘কুলি-মজুর’ কবিতায় খেটে খাওয়া মানুষ ও শ্রমিকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের অধিকার প্রশ্নে ধনিকদের চোখে আঙুল দিয়ে
রুটির দোকানে একবার আসানসোলের দারোগা জনাব মফিজুল্লাহর সঙ্গে কিশোর নজরুলের পরিচয় হয়। দোকানে নজরুলের কাজকর্ম ও বুদ্ধিমত্তা দেখে তিনি চমকিত হন। নজরুলের চোখেমুখে বিচক্ষণতা, বিস্ময়কর প্রতিভা ও মননশক্তির ছাপ পরিলক্ষিত হয়। তখন তিনি নজরুলকে স্কুলে ভর্তি করানোর প্রস্তাব দিলে নজরুল রাজি হয়ে যান। প্রথমে দারোগা সাহেব নজরুলকে তাঁর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেন। এমনও কথা আছে, বাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি নজরুলকে তখন ফুটফরমায়েশের কাজও করতে হয়েছে। তবে সে জন্য তিনি পাঁচ টাকা মাসিক ভাতাও পেতেন।
পরবর্তী সময়ে দারোগা সাহেবের বিশেষ সহযোগিতায় নজরুল ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেশনের মাঝামাঝি স্কুলে ভর্তি হয়েও নজরুল ৯৮% নম্বর পেয়ে ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
কিন্তু এক বছর পর নজরুল পুনরায় নিজ গ্রামে ফিরে আসেন এবং ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি (১৯১৫-১৭ সালে) অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য প্রস্তাব আসে। নজরুল রাজি হয়ে যান। তিনি প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় নির্বাচিত হলে ১৯১৭ সালের শেষ দিকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।
স্কুলজীবনে মফিজুল্লাহ দারোগার আনুকূল্য ছাড়াও ছাত্রজীবনের শেষ দিকে নজরুল সিয়ারসোল স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরা হলেন উচ্চাঙ্গসংগীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারার নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যে পারদর্শী হাফিজ নুরুন্নবী এবং শিল্প-সাহিত্যচর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিশোর বয়সে স্কুলে থাকাকালীন সমাজের নানা রকম অসংগতি ও বৈপরীত্য দেখে নজরুলের মাঝে স্বাধীনতার মন্ত্র গ্রথিত হয়। তাঁর শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবাসম্পন্ন একজন বিপ্লবী চেতনার মানুষ। নজরুল তাঁর কাছ থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব সম্পর্কে অনেক কিছু জ্ঞাত হন।
১৯১৭ সালের শেষ দিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত নজরুলের সামরিক জীবনের পরিধি ছিল আড়াই বছর। সামরিকজীবনে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছিলেন। সেনানিবাসের রেজিমেন্টে তিনি ফারসি ও আরবি ভাষা শেখেন। এ সময় নজরুলের মাঝে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ের ওপর নানা রকম প্রতিভা পরিলক্ষিত হয়। তিনি সংগীতানুরাগী সৈনিক বন্ধুদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি সংগীতচর্চা করেন।
সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হন। একই সঙ্গে তাঁর ভেতরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। সেনানিবাসে (চাকরিরত অবস্থায়) বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সাহিত্য রচনা করেন। সেসব লেখা পর্যায়ক্রমে কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।
নজরুলের সে সময়কার রচনাবলির মধ্যে রয়েছে ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’, ‘সওগাত’ (মে ১৯১৯) নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদ, জুলাই ১৯১৯) এবং অন্যান্য রচনা : গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; কবিতা ‘আশায়’, কবিতা ‘সমাধি’ প্রভৃতি।
উল্লেখ্য, করাচি সেনানিবাসে থাকাবস্থায় তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা, যেমন প্রবাসী, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। তা ছাড়া তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এমনকি পারস্যের কবি হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের কিছু কাব্যগ্রন্থ ছিল।
কিশোর বয়স থেকে শুরু করে এবং সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর করাচি সেনানিবাসেই মূলত নজরুলের আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যচর্চার যাত্রা। সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে তাঁর ভেতরে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটে। এ ছাড়া তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ইরাক মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ড. সুকুমার সেন রচিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ‘মেসোপটেমিয়া গিয়া নজরুল স্বাধীনতাকামী নবজাগ্রত মুসলিম রাষ্ট্র তুর্কীর উদ্যম খানিকটা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। ইহাই তাঁহার বিদ্রোহ-উল্লাসের সুর আনিয়াছিল।’
কিন্তু এটাও বলতে হবে, ছোটবেলা থেকেই নজরুলের মধ্যে একধরনের তেজস্বিতা, ক্ষিপ্র মনোভাব ও প্রতিবাদী চেতনা পরিলক্ষিত হয়। কোথাও কোনো অন্যায় ও অসংগতি চোখে পড়লে তিনি ব্যথিত হতেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও মৌলিক অধিকারের বিষয়ে তাঁর মধ্যে সব সময় মানবীয় কল্যাণচিন্তা, স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য ক্ষিপ্র মনোভাব জাগ্রত ছিল।
মানুষের সুখের সঙ্গী হওয়ার চেয়ে দুঃখী ও নিপীড়িত মানুষের বিপদে দুঃখের সঙ্গী হয়ে থাকাটা বেশি শ্রেয়। তাঁর রচিত বিপ্লবী গান ও কবিতার মাধ্যমে প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাকামী একটি বিরাট বিপ্লবী যুব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। শুধু তা-ই নয়, নজরুল সরাসরি গণমুক্তি আন্দোলনে যোগদানও করেছিলেন। গণমানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য নজরুলের রাজনৈতিক ভাবনা ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও ব্রিটিশবিরোধী ধ্যান-ধারণাও ছিল গণমুখী এবং স্পষ্ট। সর্বক্ষেত্রেই তিনি প্রকাশ্যে ভারতবর্ষের অবহেলিত মানুষের অধিকার রক্ষা ও মুক্তির লড়াইয়ের মনোভাব পোষণ করতেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রকাশ্য প্রতিবাদ করতেন। সাহিত্যের বহুলাংশে বিপ্লবের দীক্ষাসম্মত কাব্যগাথা বিপ্লবী সংগীতের ঝংকার তুলে ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে তুলেছিলেন। কবিতায় তাঁর প্রতিবাদের ভাষাও ছিল দুঃসাহসী ও সুদৃঢ়। তিনি লেখেন :
‘শোন্ অত্যাচারী! শোন রে সঞ্চয়ী!
ছিনু সর্বহারা, হব সর্বজয়ী ॥
ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম মাঝ
নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ।’
নজরুলের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন ছিল নিশ্চয় একদিন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মূলোৎপাটন ঘটবে। মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার সূর্য উদিত হবে। একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।
সুমিতা চক্রবর্তীর রচনা থেকে জানা যায়, ‘নজরুল কিশোর বয়স থেকেই স্বাধীনতা চেয়েছেন। জীবনের পুরো সময় যত দিন সুস্থ ছিলেন, সর্বসময়েই স্বাধীনতাসংগ্রামে আত্মনিয়োজিত হওয়ার জন্য সবাইকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছেন। সেই চেতনা আমরা দেখতে পাই নজরুলের যুদ্ধে যাবার সংকল্প থেকে। যে তরুণ সতেরো বছর বয়সে যুদ্ধযাত্রী বাঙালি সৈনিকদের দেখে আলোড়িত হয়েছিলেন এবং নিজে যুদ্ধে যাবার সংকল্প করেছিলেন। তাঁর রাজনীতিবোধ যথেষ্ট পরিণত এবং সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল সন্দেহ নেই।’
আগেই উল্লেখিত হয়েছে, সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে নজরুল কলকাতায় ফিরে আসেন এবং পুরোপুরিভাবে সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত হন।
প্রথমেই তিনি কৈশোরের বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেসে ওঠেন। কিন্তু সেখানে জাতিভেদ পোষণকারী কয়েকজন হিন্দুর বিরাগভাজন হন। এই বন্ধুদের চিন্তা-চেতনার ফারাক দেখে নজরুল অনুধাবন করলেন, এখানে থাকা ঠিক হবে না। যদিও তাঁর বন্ধু শৈলজানন্দ চেয়েছিলেন নজরুলকে তিনি তাঁর সঙ্গে রাখতে। কিন্তু নজরুল থাকেননি। অতঃপর তিনি সবকিছু নিয়ে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার অফিসে ওঠেন। সেখানে তিনি বিরামহীন লিখতে শুরু করেন।
ব্যক্তিজীবনে নজরুল যেমন ছিলেন তীক্ষè বুদ্ধিমান ও প্রখর মেধাবী, তেমনি তাঁর সূক্ষèতা ও অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রের অসংগতি ও বৈপরীত্যসমূহ সহজেই ধরতে পারতেন। সত্যকে সত্য বলা এবং মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে কোনো দ্বিধা করতেন না। যা সত্য তা-ই। কোনো তোষামোদি কিংবা গোঁজামিল নেই। সমাজের অধিকারহারা মানুষের মুক্তি এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য নজরুলের হৃদয়ে সর্বদা বিপ্লবের আগুন প্রজ্জ্বলিত ছিল। কোনো জেল-জুলুম ও মৃত্যুভয় তাঁকে বিপ্লবী মনোভাব ও মুক্তমনা চিন্তা-চেতনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। একইভাবে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতালাভের আকাক্সক্ষায় নজরুলের রাজনৈতিক ভাবনা ছিল বাস্তবমুখী। সকল প্রকার নিপীড়ন ও শোষণের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বিপ্লবী সাহিত্য রচনা করে তিনি ভারতবর্ষের গণমানুষকে স্বাধীনতাসংগ্রামের দীক্ষা দান করেছেন এবং তাঁদের মুক্তিকামী জনতাকে স্বাধীনতাসংগ্রামে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
শুধু ভারতেই নয়, পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের জন্য নজরুলের সাহিত্যাদর্শ মাইলফলক। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের রণসংগীত ও বিপ্লবী গানসমূহ বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
পরাধীন দেশে, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মুক্তির পথ ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য গণমানুষকে উদ্দীপ্তকরণের হাতিয়ার হিসেবে নজরুল বেশ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সেসব পত্রিকার মাধ্যমে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বাণী সম্প্রসারিত হয়। তাঁর সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে সর্বপ্রথম কাজী নজরুল ইসলাম প্রকাশ্যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
নজরুল ছিলেন শক্তিশালী কলমযোদ্ধা। তাঁর শাণিত লেখনীতে ফুটে উঠেছে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন বিপ্লবী ধারার সৃজনশীল সাহিত্য। কেননা গণমানুষের আকুতি এবং তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি সর্বদা নজরুলকে চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত করে রাখত। কবি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মধ্য দিয়ে সর্বপ্রকার অন্যায়, জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন, যা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত কাঁপিয়ে তুলেছিল। সে জন্য পরবর্তী সময়ে নজরুলকে জেলও খাটতে হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণপ্রক্রিয়া ও তাদের গণবিরোধী অন্যায় কার্যক্রম এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে নজরুলের ভূমিকা ছিল বজ্রের মতো কঠিন। তিনি সর্বপ্রথম উপমহাদেশের মজলুম জনতাকে সরাসরি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা দান করেন। তিনি কবি-সাহিত্যিকদের কলমযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। এমনকি রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য সবাইকে স্বাধীনতাসংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীরা তাঁর নিকট থেকে প্রেরণা লাভ করেন। কোনো প্রকার জেল-জুলুমকে ভয় না করে সাহসিকতার সঙ্গে দৃপ্তকণ্ঠে তিনিই সর্বপ্রথম বাঙালি কলমসৈনিক, যিনি উচ্চারণ করেন :
‘কারার ঐ লোহ কপাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/ রক্ত জমাট/ শিকল পূজায় পাষাণ বেদী/ ওরে ও তরুণ ঈশান/ বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ ধ্বংস নিশান/ উড়ুক প্রাচীর/ প্রাচীর ভেদি...’
‘লাথি মার ভাঙরে তালা/ যত সব বন্দী-শালায়/ আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি।’
‘এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/ এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।’
বিদ্রোহী কবি নজরুল পরাধীনতার শিকল ভেঙে ভারতবর্ষের মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের পথ দেখিয়ে লিখেছেন জাগরণী কবিতা এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করেন।
এই বিদ্রোহী কবিতা হচ্ছে নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জাগরণী শক্তি এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বিপ্লবী কবিতা। শোষক ও উৎপীড়িতের বিরুদ্ধে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম সাহসী হাতিয়ার। যে কবিতার সমতুল্য বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই। কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতার শুরুটাই হয়েছে আত্মবিশ্বাস, অদম্য সাহস ও দুর্জয় মানসিকতা ও দৃঢ়তার ওপর। শুধু বাংলা ভাষা নয়, বিদ্রোহী কবিতার স্থায়ী প্রেরণা ও আবেদন পৃথিবীর সকল ভাষাভাষী মানুষের মুক্তি ও কল্যাণে নিবেদিত। কবিতাটির যাত্রালগ্নে তিনি শুরু করেছেন এভাবে-
‘বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি,
নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!’
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি পূর্বের তুলনায় অনেক গুণ বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পাঠক এবং গণমানুষের মনে উৎসাহ, উদ্দীপনা জাগায়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে এ ধরনের প্রতিবাদমুখর কবিতা বাংলা সাহিত্যে প্রকাশিত হয়নি। এই কবিতাটির মাধ্যমে কবি তৎকালীন শাসকের বিরুদ্ধে তাঁর দুঃসাহসী অবস্থানকে তুলে ধরেন। ভারতবর্ষের মানুষদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন করে তোলেন।
তেমনি ‘বিদ্রোহের বাণী’ নামক সুদীর্ঘ কবিতায় বিপ্লবের দীক্ষাসম্মত উল্লেখ করেন :
‘যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামি ভাই করব সেথাই বিদ্রোহ!
ধামা-ধরা! জামা ধরা! মরণ-ভীতু! চুপ রহো!
আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ!’
এ ছাড়া ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লিখে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কাজী নজরুল ইসলামের ওপর ব্রিটিশ শাসকেরা নিপীড়ন চালায়। তিনি এক বছর জেল খাটেন।
নজরুলের কবিতায় স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল মানুষকে যেভাবে জাগিয়ে তুলেছে, অন্য কোনো বাংলা কবিতা ও গানে মানুষের মধ্যে সে রকম জাগরণ আনা সম্ভব হয়নি। তিনি লেখেন :
‘ভীম কারার ওই ভিত্তি নাড়ি!
লাথি মার ভাঙলে তালা!
যত সব বন্দীশালায়-
আগুন জ্বালা,
আগুন জ্বালা, ফেল উপড়ি!’
তিনি (৭ জানুয়ারি ১৯২৩) কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী থাকা অবস্থায়ও প্রতিবাদমুখর ছিলেন। তিনি তাঁর যুবক অনুসারীদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারবিরোধী বিপ্লব-সংক্রান্তে যোগাযোগ করতেন। তিনি বলেন, ‘আবার বলছি, আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই।’ জেলের অভ্যন্তরে তিনি লেখেন (৭ জানুয়ারি ১৯২৩, রবিবার) :
‘ঐ অত্যাচারীর সত্য পীড়ন/ আছে তাঁর আছে ক্ষয়;
সেই সত্য আমার ভাগ্য-বিধাতা/ যার হাতে শুধু রয়।’
কবিতা ও গান ছাড়াও নজরুল বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখেও তিনি বিপ্লবের অনুপ্রেরণা দান করেন।
‘তরুণের সাধনা’, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’, ‘মন্দির ও মসজিদ’, হিন্দু-মুসলমান’, ‘জন-সাহিত্য’, ‘যদি আর বাঁশী না বাজে’সহ অনেক লেখা বাংলা সাহিত্যে চিরন্তন ও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
সব ধরনের সাহিত্য রচনা এবং সাহসী কাব্য লেখনীর মাধ্যমে তিনি গণমানুষকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম পরাধীনতা, ব্রিটিশ শাসকের শোষণের কবল থেকে জাতিকে প্রথম ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ও মুক্ত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। যাঁর প্রত্যয়ী লেখনী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা ভারতবর্ষের গণমানুষকে মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রাণিত হওয়ার পথ দেখিয়েছে। তিনি জাগ্রত করেছেন মানবীয় জাতীয়তাবোধ। তাঁর বিপ্লবী ধারার শাণিত লেখা ব্রিটিশ শাসকের ভিত কাঁপিয়ে তুলেছিল। তিনি ছিলেন মানবতার কবি। রাষ্ট্রপুঞ্জ ও রাজনীতিতে শাসকশ্রেণির অবদমিত ষড়যন্ত্র, হিংসাবর্তী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষেত্রে এবং আমাদের আত্মবিস্মৃতি জাতিকে এমনভাবে আর কেউ আহ্বান জানাতে পারেননি।
নজরুল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি। কৈশোর থেকেই তাঁর মাঝে অসাধারণ কাব্যক্ষমতা ও সাহিত্যপ্রতিভার দিকগুলো পর্যায়ক্রমে ফুটে উঠতে থাকে। অসুস্থ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর শিল্পবোধ ও বিরামহীন সাহিত্যরচনায় ন্যস্ত ছিলেন। তাঁর সমতুল্য প্রতিবাদী কবি ভারতবর্ষে বিরল। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, গণমানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতাসংগ্রামে নজরুলের কিংবদন্তি কবিতা, সংগীত ও সমগ্র সাহিত্যকর্ম বিরাট ভূমিকা রাখে। তিনি ছিলেন দুঃসাহসী, দুর্জয় মানসিকতার এক অপ্রতিরোধ্য কবি। বিপ্লবী ও প্রতিবাদী সাহিত্যের জন্যই তিনি ব্রিটিশ সরকারের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। জেল খেটেছেন। কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে কোনো আপস করেননি।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানববিধ্বংসী যুদ্ধ, আগ্রাসন এবং আমাদের অবক্ষয়ী সমাজের সকল প্রকার অত্যাচার, নিপীড়ন, অনাচার ও অসংগতির বিরুদ্ধে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য চিরকাল নিপীড়িত মানুষকে জাগাতে প্রেরণা জোগাবে। চিরকাল তাঁর শিল্পবোধ, কর্মজীবন ও সাহিত্যাদর্শ মানবতার কল্যাণের পাথেয় হবে এবং গণমানুষের মুক্তির পথে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তিনি অবিস্মরণীয় এবং চির অনির্বাণ ॥
(জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রবন্ধটি রচিত)
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক