Thikana News
০৬ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

সাংবাদিকদের হাতে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে ডলার

‘আসছেন, কষ্ট করছেন, একটা খরচ আছে না’
সাংবাদিকদের হাতে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে ডলার
সাংবাদিকতা একটি সম্মানজনক পেশা। কিন্তু সেই পেশার সৌন্দর্য অনেকটাই মলিন হয়, যখন নিউজ কাভার করার জন্য কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া সাংবাদিকদের হাতখরচ দেওয়া হয়। সেটা একজন পেশাদার সাংবাদিকের জন্য যেমনি লজ্জাকর, তেমনি অপমানেরও। তবে হলুদ সাংবাদিকদের জন্য এটা আবার পরম কাক্সিক্ষত। নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আগে এই প্রবণতা প্রায় না থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে এটি অনেক বেশি বেড়ে গেছে। বর্তমানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও কর্মীদের হাতে আয়োকজকদের পক্ষ থেকে একটি খাম ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওই খামের ভেতরে থাকে ২০ থেকে ২০০ ডলার। খামটি অনেকটা সাবধানতা ও গোপনে সাংবাদিকদের হাতে গুঁজে দেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রেই অনুষ্ঠানে আসা অতিথি ও দর্শকদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। এতে বেশির ভাগ সাংবাদিক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। আয়োজকদের চাপাচাপিতে অনেকে ওই ডলার গ্রহণ করলেও নীতিনিষ্ঠ ও আদর্শবান অনেক সাংবাদিক বিনয়ের সঙ্গে অর্থটি ফিরিয়ে দেন। বিষয়টি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং অপমানের শামিল বলে পেশাদার সাংবাদিকেরা মনে করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লক্ষ করা যাচ্ছে, আয়োজকদের পক্ষ থেকে অত্যন্ত গোপনে সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে ডলারভর্তি সেই খাম। সাংবাদিকদের হাতে সেটি গুঁজে দিয়ে বলা হচ্ছে, রাখেন, রাখেন। আপনি আসছেন, কষ্ট করছেন, এর একটা খরচ আছে না। আবার কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের বিল নগদে পেমেন্ট করার সময় কিছু বাড়তি অর্থ দেন। এমনও দেখা গেছে, বিজ্ঞাপনের বিল যদি ১৫০ ডলার হয়, এর সঙ্গে আরও ৫০ ডলার যোগ করে ২০০ ডলার দিয়ে বলেন, এই বাড়তি টাকাটা আপনি রাখেন, এটা আপনার খরচ। আপনি কষ্ট করে এসেছেন। এর একটা খরচ আছে না।
অনেক বিজ্ঞাপনদাতার মধ্যে এই প্রবণতা আছে, সংশ্লিষ্ট পত্রিকার কোনো সাংবাদিক অ্যাসাইনমেন্টে গেলে তার কাছে বিজ্ঞাপনের বিলটি ক্যাশে পেমেন্ট করেন। কিন্তু নিয়ম হচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতা ক্যাশে, কার্ডে, জেল করে বা চেকের মাধ্যমে তার বিজ্ঞাপনের বিল পেমেন্ট করে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার কাছ থেকে পেইড রিসিট কিংবা ইনভয়েস নেবেন। কিন্তু এটা অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে না। কিছু প্রোগ্রাম, ইভেন্ট এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের বিজ্ঞাপনের পেমেন্টের ক্ষেত্রে অনেক সময় সাংবাদিকদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কারণ এসব অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পেমেন্ট করা হয় অনুষ্ঠানের দিন। আর সেটাও পেমেন্ট করা হয় ওই অনুষ্ঠান কাভার করতে যাওয়া সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের কাছে। বিজ্ঞাপনের বিলটি যখন কিছুটা লুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন আশপাশের মানুষের সন্দেহ হয়, আয়োজকেরা ওই সাংবাদিককে উৎকোচ দিচ্ছেন কি না।
একটি সূত্র জানায়, কিছু কিছু সংগঠন মনে করে, তারা বিজ্ঞাপন দিয়েছে মানে ওই মিডিয়ার কোনো না কোনো সাংবাদিক অনুষ্ঠানটি কাভার করার জন্য যাবেনই। অনুষ্ঠানের দিন বিল পরিশোধ করার সুবিধা হলো অন্তত বিলটি নেওয়ার জন্য হলেও একজন সাংবাদিক যাবেন এবং তাদের সংগঠনের নিউজটি পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। ফলে তার উদ্দেশ্যও সফল হবে। বর্তমানে মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
অনেক আয়োজক আবার সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, নিউজটা করে দিয়েন কিংবা বিজ্ঞাপনটি ছেপে দিয়েন, টেককেয়ার করব। আসলে এই টেককেয়ার শব্দটি অত্যন্ত নেতিবাচক একটি শব্দ। কারণ টেককেয়ার করার কথা যারা বলেন, তারা না জেনেবুঝেই বলেন। আসলে যারা পেশাগত সাংবাদিক, তাদেরকে টেককেয়ার করার কোনো প্রয়োজন নেই। মোটকথা হলো একজন সাংবাদিককে কোনো রিপোর্ট কাভার করতে আসা-যাওয়ার জন্য কোনো টিএ, ডিএ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের বেতন-ভাতাসহ সকল খরচ বহন করে সংশ্লিষ্ট মিডিয়া প্রতিষ্ঠান। যারা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠেই কাজটি করেন।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এখন এটাই রেওয়াজ হয়ে গেছে, অনুষ্ঠানে চেক কিংবা ক্যাশে বেশির ভাগ সংগঠন বিজ্ঞাপন বিল পেমেন্ট করে। আবার কোনো কোনো সংগঠন আছে, মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর বিল পেমেন্ট করে না। এভাবে কয়েক মাস বা বছর পার হলে বলে, সেটা নাকি তামাদি হয়ে গেছে। বিজ্ঞাপন যেদিনই প্রকাশ হোক না কেন, এর বিল কোনো দিন তামাদি হয় না। প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন যত দিন বেঁচে থাকবে, এর মালিক যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিনই তা বকেয়া থাকবে। তিনি বকেয়া পরিশোধ না করে মারা গেলেও বিলটি তার নামে ওই মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের খাতায় বকেয়া হিসেবেই রয়ে যাবে।
এ রকম অনেক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান আছেন, যারা নিউইয়র্কে বিজ্ঞাপন দিয়ে এর বিল দেন না। বকেয়া রেখেই পরপারে পাড়ি জমান। তার নামে দুনিয়াতে ঋণ থাকলেও কেউ খবর রাখে না এবং কেউ কোনো দিন বিলও পরিশোধ করেন না। নিউইয়র্কের বৃহৎ একটি সংগঠনের সভাপতি কয়েক বছর হলো মারা গিয়েছেন। তার কাছে ঠিকানা পত্রিকাই ৬০০ ডলারের বিল পাওনা রয়েছে। তিনি অত্যন্ত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার পরিবার অনেকটাই ধনী। তাদের ১০টির বেশি দোকান আছে। ছয়টির বেশি বাড়ি রয়েছে। ওই ব্যক্তি এত সহায়-সম্পদ রেখে মারা গেলেও ৬০০ ডলার বিল আজ পর্যন্ত তার পক্ষে কেউ পরিশোধ করেনি।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একজন সাংবাদিক বলেন, আসলে আয়োজকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিছু মিডিয়া আছে, যারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বিজ্ঞাপনের জন্য হাহাকার করে। এসব মানহীন মিডিয়ায় কোনো প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিতে চায় না। বিজ্ঞাপন-খরায় ভুগতে থাকা এসব মিডিয়া যা পায়, যেভাবে পায়, তা-ই লুফে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের কারণে স্বনামধন্য মিডিয়া ও পেশাদার সাংবাদিকদের সম্মানহানি হচ্ছে। এই সুযোগটাই নিচ্ছেন বিজ্ঞাপনদাতারা এবং তারা সাংবাদিকদের টেককেয়ার করার মতো দুঃসাহস দেখাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন সাংবাদিক বলেন, কিছু কিছু বিজ্ঞাপনদাতা মনে করেন, ২০ থেকে ১০০ ডলারে একজন সাংবাদিককে তারা কিনে নিলেন। তার মতে, একজন আয়োজক ১০-১৫ জন সাংবাদিকের জন্য হাজার-দেড় হাজার ডলারের বাজেট না করে সেটা দিয়ে মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিলে মিডিয়া লাভবান হতো এবং তার অনুষ্ঠানটির কাভারেজ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা তৈরি হতো। যেসব সাংবাদিক আয়োজকদের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বঞ্চিত হচ্ছে। আর সেসব সাংবাদিক অর্থ নিচ্ছেন না, তাদের নীতি-আদর্শ প্রশংসিত হলেও তাদের প্রতিষ্ঠানও বিজ্ঞাপন না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রবীণ এক সাংবাদিক বলেন, যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন তাদের নিউজ কাভার করার জন্য সাংবাদিকদের অর্থ দিচ্ছে, সেটা অনৈতিক। এটা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা প্রয়োজন। যেকোনো অনুষ্ঠান হলে আয়োজকেরা তাদের পছন্দের মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। এর মাধ্যমে মিডিয়া লাভবান হবে আর প্রতিষ্ঠানটি ভালো কাভারেজও পাবে। এতে দুই পক্ষই লাভবান হবে। তবে যারা বিজ্ঞাপন দেবে, কেবল তারাই কাভারেজ পাবে, এমনটি যেন না হয়। তাহলে অনেক ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান ও আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়, এমন প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশনা অব্যাহত রেখে নিউইয়র্কে মিডিয়াগুলো দিনের পর দিন কমিউনিটির সেবা করছে। তাই কমিউনিটি ও বড় ব্যবসায়ীদের উচিত মিডিয়াকে টিকিয়ে রাখতে বিজ্ঞাপনসহ নানা পরামর্শ দিয়ে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা।

কমেন্ট বক্স