Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের হত্যাকান্ড এবং সাংবাদিক নঈম নিজাম

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের হত্যাকান্ড এবং সাংবাদিক নঈম নিজাম
বসুন্ধরা গ্রুপের একটি দৈনিকের সম্পাদক নঈম নিজাম ঢাকার দৈনিক মানবজমিনের ঈদসংখ্যায় (১২ এপ্রিল) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে জানা-অজানা এবং তথ্যবহুল এক দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে যত লেখালেখি, বইপত্র ও মতামত রয়েছে, এসবের বাইরে তিনি নতুন কিছু তথ্য দিয়ে পাঠ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। সেই হত্যাকাণ্ডকে বা হত্যাকারীদের প্রতিহত করতে না পারার জন্য আওয়ামী লীগের সব নেতাকে দায়ী করেছেন।  অতি প্রাঞ্জল ও আবেগী ভাষায় লেখা বিষয়বস্তু নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই, বরং সে অমার্জনীয় ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের দায়ী করার পাশাপাশি রাজনীতি/গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের ব্যত্যয় ঘটানোর নায়কদের কথা উল্লেখ থাকলে আরও সর্বজনীন হতো। তাই দু-একটি বিষয় নিয়ে একটু দ্বিমত করতেই হয়, কারণ সে সময়ের বাস্তব অবস্থা ওনার বর্ণনামতো ছিল না। যেমন জনমত, শেখ হাসিনার উদারতা বা জিয়াউর রহমানকে খোঁচা ইত্যাদি।
জনাব নঈম নিজাম লিখেছেন বা ধারণা দিয়েছেন, জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল, যে কেউ একজন প্রতিরোধের ডাক দিলে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ত বা সারা দেশ উত্তাল হয়ে যেত। আসলেই কি তা-ই? ব্যাপারটি বিপরীত। কেউ যদি তৎকালীন দেশি বা আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকার আর্কাইভ, জে এন দীক্ষিতের লিবারেশন ইয়ার, অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের লিগ্যাসি অব ব্লাড বইগুলো ঘাঁটেন, দেখবেন দেশে কী পরিমাণ অরাজকতা ও গণ-অসন্তোষ ছিল। এই অসন্তোষ জন্মেছে লুটপাট, দুর্নীতি, একদলীয় শাসনব্যবস্থা আর রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের কারণে। আর চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষে লাখো মানুষের মৃত্যু কোন দেশের জনগণ সরকারকে বাহবা দেয়? অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে একটু অভাব-অনটন থাকতেই পারে। কিন্তু স্বাধীনতার পর যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য এসেছিল, তা লুটপাট না করে জনগণের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারলে দুর্ভিক্ষ এড়ানো সম্ভব ছিল। এই লুটপাটের মহাযজ্ঞ দেখেই মার্কিন পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। দ্বিতীয়ত, ওই বর্বর হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিল সামরিক বাহিনী (যদিও পরবর্তীকালে দেখা গেল, কিছু বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত অফিসারও সম্পৃক্ত ছিল)। এমনিতেই দুর্ভিক্ষ, লুটপাট এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নৈতিকভাবে দুর্বল ছিল, সেখানে সেনাবাহিনী কর্তৃক রক্ষীবাহিনীকে অকার্যকর করতে পারার পর সামরিক বাহিনীর সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ভাবাটা একেবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত। সে সময়ে গণসম্পৃক্ততা পরিমাপ করার ঘটনা একটি ঘটেছে, যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা সেটা মানতে নারাজ। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান করার পরের দিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর তার মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পক্ষে ধানমন্ডি থেকে একটি মিছিল বের করার পর জনমনে একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল বা রটেছিল, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসছে। কিন্তু এর তিন দিন পর, তাহের/জাসদের প্ররোচনায় সাধারণ সৈনিকদের পাল্টা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান দৃশ্যপটে এলে সেই রাতের বেলায় কারও কোনো আহ্বান ছাড়াই লাখ লাখ মানুষের ঢাকার রাস্তায় নেমে আসাটা আওয়ামীবিরোধী মনোভাবটা প্রমাণ করে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা কাদের সিদ্দিকি তো ডাক দিয়েছিলেন, কতজন সাড়া দিয়েছিল?
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদারতার কথা বলেছেন জনাব নঈম নিজাম। একজন মানুষ ক্ষমতায় থাকার জন্য এত জঘন্যভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার পর তাকে কোনো রকম উদার বলা যায় কি? জনাব নঈম নিজাম কি বিবিসির সেরাজুর রহমানের সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটির কথা জানেন? আর যে মানুষগুলোর কথা নঈম নিজাম বললেন, তাদেরকে কাছে টেনেছেন উদারতার জন্য নয়, ক্ষমতায় যাওয়ার বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। জনাব নিজাম কি জানেন না আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সেই বিখ্যাত উক্তি : ‘বাঘে ধরলেও ছাড়া পাওয়া যায়, কিন্তু শেখা হাসিনা ধরলে আর ছাড়ে না।’ জাসদের ইনু, এইচ টি ইমাম, মে. জে. খলিলুর রহমানসহ এ রকম আরও অনেকে, যারা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন, সবাইকে টেনেছেন রাজনৈতিক কারণে। আরও একটি উদাহরণ নিন। আওয়ামী লীগের মোশতাক গং, যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং জেল হত্যায় সরাসরি জড়িত, প্রধানমন্ত্রী কত দিন তাদের নাম নিয়েছেন বা তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্্গার করেছেন? অথচ জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা না থাকলেও প্রতিনিয়ত গালি খেতে হয়; এমনকি বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত একজন মানুষকে রাজাকার বা বাঙালিদের ওপর গুলি চালনাকারী বলে প্রচারণা চালানো হয়। প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের সব নেতা প্রতিনিয়ত বক্তৃতা বা টকশোতে হুবহু একই কায়দায় বঙ্গবন্ধু হত্যার নিষ্ঠুরতা বর্ণনা দিয়ে জিয়াকে গালাগাল শুরু করেন, অর্থাৎ পাবলিককে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন যে জিয়াই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছেন। আবার জিয়ার দল ক্যান্টনমেন্টের দল কিন্তু এরশাদ একই কায়দায় দল করলেও গালমন্দ শুনতে হয় না বরং কাছে টেনে একসঙ্গে সরকার গঠন করলেও কোনো সমস্যা হয় না। সুতরাং রাজনীতি এবং উদারতা এক জিনিস নয়।
প্রতিদিনের সম্পাদক জিয়ার সঙ্গে খুনি রশীদ ফারুকের সাক্ষাৎকারের বিষয়টি উল্লেখ করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে জিয়াও ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তা না হলে তিনি ওদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি কেন? নঈম সাহেব যেভাবে বর্ণনা করেছেন, আসলে সাক্ষাৎকারটি সে রকম নয়। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের বইটিতে সে সাক্ষাৎকারের বর্ণনা রয়েছে। রশীদ সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের কথা না বলে বলেছিল একটা পরিবর্তন দরকার। জিয়া সহমত পোষণ করে বলেন, তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়, তোমরা চেষ্টা করতে পারো এবং একই সঙ্গে তার সেক্রেটারিকে বলে দিয়েছিলেন, রশীদ যেন আর তার সঙ্গে দেখা না করতে পারে। জিয়ার এই উক্তি দায়িত্বহীনতার মধ্যে পড়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সে সময়ে সমগ্র ক্যান্টনমেন্টের পরিবেশটাও বিবেচ্য। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৭০-৯০% ভোট পেলেও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় মাত্র ২০% ভোট পেয়েছিল, যা অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের লিগ্যাসি অব ব্লাড বইতে তুলে ধরা হয়েছে। ওই লেখক পরবর্তী সময়ে ক্যান্টনমেন্টে আওয়ামী লীগ-বিরোধী ভোটের কারণসমূহ নিয়ে জিয়া ও মীর শওকত আলীর আলোচনা করেছিলেন। ৪৬ ব্রিগেডের শাফায়াত জামিল জানতেন রশীদ গং কিছু একটা করতে যাচ্ছে। তিনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হচ্ছে? রশীদ কোনো কিছু অস্বীকার না করে বলল, আমার বিরুদ্ধে কিছু করলে আপনিও ফাঁসবেন, কারণ আপনি আমার যশোর ক্যান্টনমেন্টে বদলি রহিত করে ঢাকায় রেখে দিয়েছেন। শাফায়াত জামিল আর কোনো পদক্ষেপ তো দূরের কথা, কোনো উক্তিই করেননি। খালেদ মোশাররফ তো নিজেই রক্ষীবাহিনীর উপপ্রধানকে মোশতাকের আনুগত্য করতে রেডিও স্টেশনে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। আর রশীদের জিয়ার সঙ্গে দেখা করাটা যদি খুনে জড়িত ধরা হয়, তাহলে মেজর ডালিম বহুবার বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য কামরুজ্জামান হেনার সঙ্গে দেখা করে ক্ষমতা নিতে বলেছিল, ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামও জানতেন কিছু একটা হচ্ছে, তারাও বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত? এই তথ্যটুকু আওয়ামী লীগের একসময়ের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইদের ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বইয়ের ২৮৫ পৃষ্ঠায় আধ্যাক ইউসুফ আলীর সাক্ষাৎকারে বর্ণিত হয়েছে।
জনাব নঈম নিজামের রাজনৈতিক মেধা ও প্রজ্ঞা প্রশ্নাতীত। তবে তাকে বিনয়ের সঙ্গে বলব, তিনি যদি বঙ্গবন্ধু সরকারের ভুল পদক্ষেপ নিয়ে একটু সামান্য আলোকপাত করতেন, তাহলে এটা হতে পারত তথ্যবহুল ইতিহাসের একটু অংশ। তিনি নিশ্চয় জানেন, যখন কোনো সুশাসন থাকে, তখন জনগণ সরকারের পাশে থাকে এবং একটি বিপুল জনপ্রিয় সরকারকে গুটি কয়েক মধ্যম শ্রেণির ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসাররা উৎখাতের কখনোই সাহস রাখে না। তবু এই সুন্দর প্রতিবেদটির জন্য জনাব নঈম নিজাম ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

কমেন্ট বক্স