ষাটের দশকে ছাত্রসমাজের একটা বৃহৎ অংশ সমাজতন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিল। বিশ্বাসটা ছিল-এ দেশ হতে সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। নির্বাসন দিতে হবে অপসংস্কৃতিকে। বাঙালির চিন্তা ও চেতনা প্রাধান্য পাবে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। আর সংস্কৃতির বিভাজন নিয়ে যে সংকট, তার অবসান চাই। উর্দুভাষী পাকিস্তানিরা রবীন্দ্রনাথকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল। এই সময়ে আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করার দায়িত্বটা এসে পড়েছিল ছাত্রসমাজের কাঁধে। তার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত রেখে সংগ্রাম করেছেন বাংলার শিক্ষিত সমাজ, বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ আর শ্রমজীবী মানুষ।
আসলেই পৃথিবীর যেকোনো জাতিরই আত্মপরিচয়ের মূলে রয়েছে সেখানকার জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধ। কীভাবে আমরা বড় হয়ে উঠলাম? বাল্যজীবন থেকে বিবাহিত জীবন এবং তারপর কর্মজীবনÑপ্রতিটি পদক্ষেপে বাঙালি মনন ও মানসিকতার প্রতিফলন হয়েছে। এই সর্বজনীন স্বীকৃতিই হচ্ছে সংস্কৃতির বিকাশ জন-গণ-মনে। বিশ্বব্যাপী পণ্ডিতেরা বলছেন, ‘বিশ্বের যেকোনো দেশেই অভিবাসন হোক না কেন, প্রতিটি জাতির নৈতিক দায়িত্ব তার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করা।’
বলছিলাম সমাজতন্ত্রের কথা। এ কথা সত্যি-স্বাধীনতার পর আমাদের চিন্তায় কিছুটা মত ও পথের পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতার সুবাদেই আজ আমাদের বিশ্বব্যাপী পদচারণ। কিন্তু যে অঞ্চলেই আমরা থাকি না কেন, যে ভাষাই আমার ও আপনার রপ্ত থাকুক না কেন-পরিচয়ে আমরা বাঙালি। আমরা বাংলা নামের দেশের মানুষ। এ দেশের জারি-সারি-পুঁথি আর মুর্শিদী, এ দেশের মুড়ি-মুড়কি-ক্ষীর কিংবা পিঠাÑসব মিলিয়েই বাংলাদেশ। পান্তা ও ইলিশও বাংলাদেশ। তবে শুধু এক দিনের ‘নববর্ষ’ যেন সব আলো নিভিয়ে না দেয়। এই আলোয় জ্বালিয়ে রাখতে হবে সারাটি বছর। তাহলে বিশ্ব জানবে-এই দেশের মানুষের শিল্পবোধ রয়েছে। রয়েছে সৌন্দর্য অনুভূতি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তার তুলির টানে আমাদের অভাব এবং স্বভাব দুটোই ফুটিয়ে তুলেছেন। বলা হয়েছে সেই শিল্পই ভালো, যার উৎপত্তি প্রয়োজন থেকে। প্রয়োজন ছিল আমাদের মৃৎশিল্প, কুটিরশিল্পসহ পটুয়ার আঁকা ছবি। শিল্পীর আঁকা ছবি আর কবির কবিতা-বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া।
ষাটের দশকে যে গণ-অভ্যুত্থান, তার মূলে ছিল আমাদের এই দায়িত্ববোধ। সেই থেকেই তো আমাদের স্বাধীনতাÑমানুন বা না-ই মানুন।
এখানে উল্লেখ্য, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলার শিল্পীরা পথে-প্রান্তরে ছুটে বেড়িয়েছেন। গেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের গান। উদ্দীপ্ত করেছেন মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে। আমি গর্বিত আমার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন বন্ধুও ছিলেন এই কাফেলায়। কাদেরী কিবরিয়া, শহীদ হাসান ও রথীন্দ্রনাথ রায়Ñএই তিনজনের কণ্ঠ আজও মানুষের হৃদয়ে ঘুরেফিরে। ওইখানেই তো শিল্পের শক্তি। সংগীতের মাঝ দিয়ে মানুষের চিত্ত ও চেতনাকে জাগ্রত করা। কথা-বাণী ও সুর হৃদয়ের সেই তন্ত্রেই আঘাত হানে, যেটা অপেক্ষায় থাকে এক নতুন বাণীর আশায়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও নববর্ষের আহ্বানে গান গেয়ে গেছেন। বলেছেন, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। নতুনের আহ্বান করে গেয়েছেন, ‘হে নতুন দেখা দিক বারবার’। তার সবচেয়ে আবেদন এই গানটির সুরেÑযেখানে নতুনকে আহ্বান করে গাইছেন, ‘অগ্নিস্নানে শুচী হোক ধরা’। কী হৃদয়স্পর্শী দার্শনিক ভাবনা। সারা বছরের পুঞ্জীভূত গ্লানি জরা-মলিনতা-দীনতা সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাক। নতুন দিন উদ্ভাসিত হোক নবগাহনে। শুচি জীবন প্রাণে আনে নতুন স্পন্দন। আর মানুষ চিরকালই নতুনত্বের সন্ধানী। নতুনের মাঝ দিয়েই আমাদের সংগ্রামী জীবন, কর্মজীবন এবং বিদগ্ধ জীবনÑনবজীবনের পথ খোঁজে। বলে, ‘নব আনন্দে জাগো আজিÑনব আনন্দে জাগো’।
তবে নববর্ষ উদ্্যাপন করতে গিয়ে কোনো অতিরঞ্জন যেন না হয়, সেটাও মনে রাখা দরকার। বিষয়টি কেমন? উদাহরণ দিই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে। কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমে বলছেন, ‘ভাতে জল দিয়ে ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। সকাল হলেই খাব ইলিশ দিয়ে?’ অথচ এই ভাতটিই ‘পান্তাভাত’ নামে পরিচিত যুগ যুগ ধরে। বাংলার মেহনতি মানুষ সারা দিনের কর্মক্লান্ত দেহে গাছের ছায়ায় বসে আনন্দে খায় এই পান্তাভাত। শহুরে জীবনধারায় ড্রইংরুমের পান্তাভাতে সেই স্বাদ নেই। সেই আমেজও নেই। সেটা পহেলা বৈশাখও নয়। বৈশাখ বিলাস নয়। পহেলা বৈশাখ আসবে চিরাচরিত ধারায়।
নববর্ষ আসবে নিজস্ব ভাবধারায়। যতটা স্বাভাবিকভাবে সেটাকে বরণ করে নেব, ততটুকুই গ্রহণযোগ্য। উল্লেখ্য, বাঙালি মন ও মানসিকতায় নববর্ষ একটি শৈল্পিক দিন। বাঙালি কৃষ্টি-সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলকে আরও বিস্তৃত করার দিন। যেখানে থাকবে সূক্ষ্ম জীবনদর্শন এবং সৌন্দর্যবোধ। আসলে পুরাতনকে ভেঙে নবজীবনের নব জয়যাত্রা। দিনের পর দিন চলে যায়। মত বদলায়। পথ বদলায়। বহুদিনের প্রচলিত রীতি-নীতিকে বিসর্জন দেওয়ার মতো দুঃসাহসও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সনাতন ভাবধারাকে কি বদলানো যায়? মানুষের অনুভূতি, জীবন ও জগতের চিরন্তন সত্যাবলি কোনো দিন বিলুপ্ত হওয়ার নয়। সেটাই বৈশাখের অগ্নিস্নান।
থাক সেসব তত্ত্বকথা। বাংলা নববর্ষ প্রসূত এক সুন্দর আনন্দের সমারোহে। এই দিনটি আহ্বান করে বাঙালি মনন কান্না ও শোককে পেরিয়ে প্রেম-ভালোবাসা-হাসি ও চিত্তের প্রফুল্লতায় মেতে ওঠে। এই যৌবন জল তরঙ্গে মুছে যায় বিষাদ আর হতাশা। জীবন খোঁজে আলোর স্পন্দন। যার পরশে কেটে যাবে সামনের অনাগত দিনগুলো। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে যাবে। এই মুক্তাঙ্গনে বাংলা নববর্ষ আমাদের সাহস জোগাবে, যেন আমাদের মূল্যবোধ ও আত্মপরিচিতিকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে পারি। বিশ্ব জানবেÑএই দেশ ক্ষুধার্তের দেশ নয়। এ এক সুন্দর দেশÑবাংলাদেশ।
প্রবাসে শত কর্মব্যস্ততার মাঝে এই দেশকে আমরা খুঁজে বেড়াই প্রতিনিয়ত। মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নান পেরিয়ে আমরা আজ নতুন পথের পথিক। বাঙালি সত্ত্বা যতই আমাদের ভেতরের জগৎটাকে আলোকিত করবে, ততই আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও শিক্ষা দিয়ে দেশজ কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে উদ্বুদ্ধ হব। শুধু গান গেয়ে পথচলাতেই বীরত্ব নেই। বীরত্ব হচ্ছে কর্মে। বীরত্ব হচ্ছে সভ্যতার বিকাশে নিজস্ব অবদানের। এত সব ভাবনার পরও পেছনের বাঁধন ডেকে যায় নিয়তÑবলে, ‘ভাবছি কবে আবার এইসব সোনালী দৃশ্যগুলি/ আঁচলে বেঁধে পাড়ি দেব/ শ্রাবণের মেঘ/ কবে কখন বাউল বাতাসে/ ভেসে আসবে হাস্নাহেনার গন্ধ/ মনে হবে নদীর জলে/ মাথা রেখে/ দিব্যি করে চলেছিÑ স্মৃতির স্নান।’
শুভ বাংলা নববর্ষ।