সারা যুক্তরাজ্যে পাঁচ লাখেরও অধিক বাংলাদেশির বাস। এদের অধিকাংশ আবার বৃটিশ নাগরিক। তাছাড়া অনেক বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে অবৈধভাবে বসবাস করে। প্রতিবছর অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী লেখাপাড়ার জন্য যুক্তরাজ্যে আসে, লেখাপড়া শেষে অনেকে আবার দেশে ফেরে না। অবৈধভাবে এদের অনেকে যুক্তরাজ্যে থেকে যায়। প্রায় দু’লাখ ৮৩ হাজার বাংলাদেশির বাস লন্ডন শহরে। এদের অধিকাংশ বাস করে ইস্ট লন্ডনে। তবে আনুপাতিকভাবে টাওয়ার হ্যামলেট্স্ এলাকায় বাংলাদেশিদের বাস অনেক বেশি। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অধিকাংশ বাংলাদেশি এসেছে সিলেট অঞ্চল থেকে এবং এখানে বাংলাদেশের সিংহভাগ লোক হোটেল, গ্রোসারি ও রেস্টুরেন্টের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
লন্ডনের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত টাওয়ার হ্যামলেটের একটি রাস্তার নাম ‘ব্রিকলেইন’। অনেকের কাছে এটি ‘বাংলা টাউন’ নামে পরিচিত। রাস্তাটির আগের নাম ছিল ‘হোয়াইট চ্যাপেল স্ট্রিট’। পঞ্চদশ শতকে এখানে ইট ও টাইলস তৈরি করার পর জমা রাখা হতো বলে পরে নাম হয় ‘ব্রিক লেইন’।
এখানকার ট্রেন স্টেশনের নাম ‘হোয়াইট চ্যাপেল’। এই স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করে হাজারো মানুষ। স্টেশনের নাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা দেখে বেশ ভালো লাগলো। লন্ডনের ব্যস্ততম এই এলাকার স্টেশনটির নাম বাংলায় লেখার বিষয়টিকে অত্যন্ত গৌরবের ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী অর্জন বলে মনে করছেন স্থানীয় প্রবাসীরা। এছাড়া বাঙালি দোকানের নামও অনেকে বাংলায় লিখেছেন।
বাংলায় লেখা এই সাইনবোর্ড দেখে বাঙালিদের মনে যে অনুভূতি জাগবে, তা-ই বাংলাপ্রীতি বা ভালোবাসা। এত বাঙালি ও দোকানপাট ওরা এই এলাকাটিকে বাংলাদেশের ‘গুলিস্তান’ বলে গণ্য করে। রাস্তার দু’পাশের সব দোকানই বাংলাদেশি মালিকানাধীন। পথে-ঘাটে সবসময় বাংলা ও হিন্দি কথা শোনা যায়। সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা বের হয়, যেখানে দেশের সব খবরাখবর থাকে। এখানে একটি মুভি হলও দেখলাম, যেখানে ভালো বাংলা ছবি আসলে সবাই মনভরে উপভোগ করে। ব্রিকলেইনের রাস্তা ধরে হাঁটতেই মনে হলো ঢাকার নিউ মার্কেটের কথা। যেমন মার্কেটের ভেতরে দোকান, মার্কেটের বাইরে রাস্তার দু’পাশে ফুটপাতে অসংখ্য দোকান। এখানেও পসরা সাজিয়ে বসে আছেন হকারদের দল। দোকানিরা প্রায় সবাই বাংলায় কথা বলছেন। দোকানি, ক্রেতা এবং সে পথ দিয়ে যাতায়াতকারী সবাই প্রায় বাঙালি।
এখানে প্রায় ১০০টিরও বেশি রেস্তোরাঁ রয়েছে শুধু এই ব্রিক লেইনে। রেস্তোরাঁগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আছে গ্রোসারি, মাছের দোকান, মুদি দোকান, হেয়ার সেলুন, বিউটি পার্লার, মিষ্টির দোকান, ফার্মেসি, রিয়েল এস্টেট, ট্যাক্স ফাইলিং, শাড়ির দোকান, সোনার দোকান, অডিও-ভিডিও, কয়েকটি কম্বলের দোকানও নজরে এলো। লাইসেন্সপ্রাপ্ত মদের দোকানও দেখলাম। কি পাওয়া যায় না এখানে? পানের দোকানের পাশ দিয়ে গেলে পান-মশল্লা ও জর্দার খুশবু ভেসে এসে নাকে লাগে। রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে গেলে সুস্বাদু সব খাওয়ার খুশবু মনকে উতলা করে দেয়।
সারাবছরই এখানকার গ্রোসারিগুলোতে বাংলাদেশ থেকে আসা নানারকম মাছ, শাকসবজি, শুঁটকি, পটল, কাকরল, পাটশাক, সাজনা, জলপাই, আমড়া, কলার মোঁচা, সিলেট থেকে আসা সাতকড়াসহ প্রায় সব কিছুই পাওয়া যায়। নানারকম আচার, চানাচুর, মুড়ি, হজমি, নারিকেলের নাড়ু, চাল কুমড়ার বড়ি, যবের ছাতুÑ সবকিছু মিলে এই বাংলা টাউনে হেন কোন বাংলাদেশি জিনিস নেই, যা পাওয়া যাবে না এখানে। আমি আশ্চর্য হয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছি, আর অবাক হয়ে মানুষজনকে দেখছি।
আমার ননদের স্বামী প্রায় ৩০ বছর আগে অফিসের কাজে কয়েক মাসের জন্য লন্ডন ছিল। তখন সে ব্রিক লেইনের এক সিলেটি পরিবারে থাকতো। লাঞ্চ বাইরে করলেও সকালের নাস্তা ও রাতের খাওয়া সেই পরিবারের সঙ্গে করতো। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট চেষ্টা করতেন ভালো ও সুস্বাদু রান্না করতে। আমি তখন দেশে থাকি, উনার কাছে শুনেছি এই ব্রিক লেইনের গল্প। আমার ননদের স্বামী কুমিল্লার, স্বভাবতই তার সিলেটের রান্নাপদ্ধতি মনমত হয়নি। কিছুদিন পর উনি একটি রেস্টরেন্টের খোঁজ পেলেন, যার মালিক কুমিল্লার। তারপর মাঝেমাঝেই ওই রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য যেতেন। উনার সবকিছু হতে হবে ভাজা মাছের দোঁপিয়াজা। যাই হোক, এত বছর পর আমি সেই ব্রিক লেইনে দাঁড়িয়ে। উনার কাছে ব্রিক লেইনের মজার মজার গল্প শুনতাম, আর অবাক হতাম। রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা পর্যটক দেখলে ডেকে ভেতরে নিতে চেষ্টা করে। যা আমি আগে কোথাও দেখিনি। বাংলাদেশের বাইরে এ যেনো এক টুকরা সোনার বাংলাদেশ।
রেস্টুরেন্টগুলোতে বাঙালি কর্মচারীর মাঝে কোনো কোনো রেস্তোরাঁয় ব্রিটিশও (সাদা লোক) কাজ করে। আসলে ব্যবসার প্রয়োজনে কাস্টমার ধরতে তাকে রাখা হয়েছে। কেননা আজকাল বিদেশিদের কাছে ইন্ডিয়ান ফুড বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাই বিদেশি কর্মচারী রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে তারা বাংলায় কথা বলতে পারে। আমরা একটা রেস্তোরাঁয় ভাষা সমস্যাই পড়লাম। কেননা সিলেটের ভাষা বোধগম্য হচ্ছিলো না। তখন সেই ছেলেটাই ব্রিটিশ একসেন্টে ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করলো। বৃটিশ একসেন্ট আমার একটু অসুবিধা হলেও আমার ছেলের কাছে ভালো বোধগম্য হচ্ছিলো। কেননা ও প্রতিবছর লন্ডনে আসে আমার কাজিনের বাসায়।
এখানে অনেক ইয়াং ছেলে আছে, যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, তবে তারা এসব রেস্তোরাঁয় সুন্দর কাজ জুটিয়ে নিতে পারে। দেশে পরিবারকেও মাসে মাসে এখান থেকে পাঠানো টাকায় চালিয়ে নেয় জীবন। তবে সবার ভাগ্য একরকম যায় না। অনেকে সপ্তাহে ২/৩ দিন কলেজ যেয়ে বৈধ ভিসা ঠিক রাখে সামনের সোনালী দিনের আশায়। একদিন নিজের পায়ের নিচের মাটি তার আপন হবে, পরিবার সে আনতে পারবেÑ তারাও একদিন ব্রিটিশ হবে।
বর্তমানে এই বাংলা টাউনটি এমন একটি বৈচিত্র্যময় স্থানে পরিণত হয়েছে, যেখানে এলে কেউ কখনো হতাশ হবে না! প্রত্যেকের জন্য আকর্ষণীয় কিছু না কিছু রয়েছে। লন্ডনের ব্রিক লেইন এলাকাটি বহু প্রজন্ম ধরে বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় গন্তব্যস্থান। এ এলাকা এবং তার আশেপাশে যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল এবং অভিবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হিসেবে পরিণত হয়েছে। দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার অনেক মানুষ পাড়ি দিয়েছিলো বিলেতে নানা কারণে। সেই থেকে এ এলাকাটি লন্ডনের সবচেয়ে প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময় এলাকা হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশিদের কাছে। যত দিন যায়, দেশের সবকিছু তারা হাতের কাছে পায় বলে জীবন আরো সহজ হয়েছে। ঈদের সময় ঈদের কেনাকাটা, রোজার ইফতারির সব রকমারী খাওযার পসরা সাজিয়ে রেস্টুরেন্টগুলো বসে আছে। ইফতারির দাওয়াত চলছে বাড়িতে, হলে কমিউনিটির ইফতার পার্টি করছে, মসজিদে তারাবি পড়া হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে বাংলা কমিউনিটি এখানে সবকিছু অতি সহজে পাওয়ার ব্যবস্থা ও উপভোগের মাধ্যমে দেশ থেকে এখানে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করছে। আগে মাতা-পিতা ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতে দেশে নিয়ে যেতো, এখন এখানে ভালো হল ও সবকিছুর সুব্যবস্থা থাকায় আর এ ব্যাপারে ছেলে-মেয়ের বিয়ের জন্য দেশে যাওয়াটা অত্যাবশকীয় নয়।
ব্রিক লেইন যখন ‘বাংলা টাউন’ নামে মনোনীত হলো, এই এলাকার মানুষের মনে আনন্দ আর ধরে না। এখানে বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানী কামিলা কয়েক মাস আগে ব্রিক লেইনের রেস্তোরাঁয় এসেছিলেন ইন্ডিয়ান ফুডের স্বাদ নিতে ও বাংলাদেশি কমিউনিটির সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করতে।
আমি তিনবার লন্ডনে বেড়াতে গেছি। প্রতিবছরই ব্রিক লেইন বেড়াতে গেছি। প্রথমবার একটি ছোট পার্কে শহীদ মিনার দেখেছিলাম। পরের বার টাওয়ার হ্যামলেট্্সে আলতাব আলী পার্কে দেখলাম ইঞ্চি ইঞ্চি করে গড়ে উঠেছে কংক্রিটের স্থায়ী শহীদ মিনার। লন্ডনের বাঙালিরা বাংলা ভাষা আন্দোলনের কথা ভোলেনি। শহীদ মিনারটি দেখে খুব ভালো লাগলো। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জানবে যে ভাষার জন্য অনেক মানুষকে শহীদ হতে হয়েছে, যা নাকি পৃথিবীর কোনো দেশের ইতিহাসে নেই।
ব্রিক লেইন দিয়ে হাঁটতে গেলে কখনোই মনে হবে না যে আমি বৃটেনের অতি সুন্দর ঐতিহ্যবাহী লন্ডন শহরের কোনো এক রস্তা দিয়ে যাচ্ছি। মনে হবে ঢাকার কোনো এক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। ব্রিক লেইনকে আমরা বাংলাদেশিরা বাংলাদেশর একটি অংশ বানিয়ে ফেলেছি।