Thikana News
০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব

পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব
রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের সুমহান বার্তা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান শুরু হয়েছিল ১১ মার্চ সোমবার। শাওয়ালের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ৮ এপ্রিল সোম বা ৯ এপ্রিল মঙ্গলবার পবিত্র মাহে রমজান এক বছর কিংবা অনেকের জীবন থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নেবে। আর প্রায় এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে ইসলাম ধর্মাবলম্বীগণ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে ও যথাযোগ্য মর্যাদায় পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্্যাপন করবেন। নিজস্ব প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতর উদ্্যাপনে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমানই যথাসাধ্য ত্যাগ স্বীকার ও আনন্দ উপভোগ করেন। আবার বিত্তশালী মুসলমানদের ওপর জাকাত এবং ফিতরা ধর্মীয় বাধ্যতামূলক বিধান হওয়ায় ঈদুল ফিতরের তারিখে ধনীদের আকাশ আড়াল করা হর্ম থেকে হতদরিদ্র-নিঃস্ব মুসলমানের পর্ণ কুটিরেও আনন্দের ঢেউ জাগে। সুদূর আটলান্টিকের অপর পারেও পবিত্র ঈদুল ফিতরের চাঁদরাতে মেহেদি লাগানো এবং নানা ধরনের বর্ণাঢ্য আয়োজন মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তাকে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে তুলে ধরে। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মুসলিম তরুণ-তরুণী ছাড়াও আমোদ-আনন্দপ্রিয় ভিন্ন সম্প্রদায়ের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরাও হই-হুল্লোড়ে মেতে ওঠায় প্রবাসে সম্পূর্ণ ভিন্ন আমেজ ও পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কেনাকাটার ধুম পড়ায় ভিড়বাট্টা সৃষ্টি হয় এবং স্বাভাবিক চলাফেরায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও পথচারীরা তেমন বিরক্তি বোধ করেন না। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবারও খোলা ময়দানে বা উন্মুক্ত সড়কে পবিত্র ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের সুযোগ থাকবে। ঈদের সালাত, খুতবা এবং বিশেষ মোনাজাত শেষে যাবতীয় বিভেদ-বিসম্বাদ ভুলে গিয়ে উপস্থিত মুসল্লিরা পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে সহমর্মিতার চিরায়ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। সংক্ষেপে বলা চলে, আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলমানের জাতীয় উৎসব পবিত্র ঈদের চিরায়ত সংস্কৃতি ও আমেজে আমাদের জীবনকে নতুনভাবে আলোড়িত করবে। পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আমরা বিশ্বপ্রতিপালকের দরবারে যাবতীয় আসমানি গজব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সন্ত্রাস ও হানাহানিমুক্ত শান্তিপূর্ণ বিশ্ব কামনা করছি।
ঈদুল ফিতর রজনীর গুরুত্ব : সহজাত অজ্ঞতা, চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব এবং মানুষের চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় আমরা অনেকেই প্রাত্যহিক ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল ইত্যাদি পালন করি না। বরং শবে বরাত, শবে কদর, আশুরা ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ দিবসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করে থাকি। লক্ষণীয়, বিশ্ব মুসলিমের নিকট ঈদুল ফিতরের রজনী বা চাঁদরাত শবে বরাত, শবে কদর, আশুরা ইত্যাদির মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের পরিত্রাণের জন্য যে পাঁচটি বিশেষ রজনীর কথা পবিত্র হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ঈদুল ফিতর রজনী তার অন্যতম। অথচ পরিপূর্ণ ধর্মীয় জ্ঞান এবং মূল্যবোধের অভাবে আমরা এই পরম গুরুত্বপূর্ণ রজনী হেলাফেলায় ও আনন্দ-কৌতুকে কাটিয়ে থাকি। মূলত ইবাদত-বন্দেগির স্থলে শুধু হাসি-আনন্দে ঈদের রজনী কাটিয়ে দেওয়া ইসলামি শরিয়তে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। উন্নতমানের জীবনযাপন ও জীবিকার তাগিদেই স্বজনদের স্নেহসান্নিধ্য এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে আমরা প্রবাসী হয়েছি এবং আটলান্টিকের এ-পারে বসতি গড়েছি। কিন্তু স্বদেশপ্রেমের অন্তঃসলীলা ফল্গুধারা সতত প্রবহমান আমার হৃদয়ের গভীরে ও মনমন্দিরে। তাই স্বজনদের স্নেহকাতর মুখচ্ছবি মানসপটে ভেসে ওঠামাত্রই নিজেদের অজান্তে আমরা অশ্রুসজল হয়ে উঠি। আবার কলুর বলদের মতো কর্তব্যের ঘানিটানা ও নিয়তিলাঞ্ছিত প্রবাসজীবনে অনেকের অশ্রু বিসর্জনই জীবনাচরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাদের মতো ভাগ্যবিড়ম্বিতদের উচিত যেকোনো মূল্যে ঈদের রাত জেগে সালাত আদায় করা এবং নিজেদের যাবতীয় অপরাধ মার্জনা, পরলোকগত পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের আত্মার চিরপ্রশান্তির জন্য অশ্রুসিক্ত নয়নে বিশ্বপ্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করা।

ঈদ : আরবি ভাষার ঈদের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে আনন্দ বা উৎসব। বস্তুত ঈদ হচ্ছে বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় খুশি ও আনন্দের উৎসব। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক জাতিরই উৎসবের দিন রয়েছে। আর আমাদের উৎসব হবে ঈদ (বুখারি ও মুসলিম)। বিশ্ব মুসলিম প্রতিবছর একবার ঈদুল ফিতর এবং একবার ঈদুল আজহাÑএ দুটি ঈদ উদ্্যাপন করে থাকেন। আর ঈদুল ফিতর হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ও বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসারীদের প্রথম জাতীয় উৎসব। ঈদের পারিভাষিক অর্থ আনন্দ আর ফিতরের অর্থ সাওম ভঙ্গ করা। তাই এককথায় বলা যায়, ঈদুল ফিতরের অর্থ হচ্ছে সাওম ভঙ্গের আনন্দ।

পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কৃপা ভিক্ষা, সন্তুষ্টি অর্জন ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের খাতিরে কায়মনোবাক্যে একনাগাড়ে এক মাস সাওম পালন শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিবসে মুসলমানরা ঈদুল ফিতর উদ্্যাপন করে থাকেন। বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর ওপর রমজান মাসের যে ইবাদত নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন, তা যথাসাধ্য পালন করার তৌফিক দানের জন্য বিশ্ব মুসলিম ঈদুল ফিতরের দিবসে অশ্রুসিক্ত নয়নে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে থাকেন। ঈদের দিবসে বিত্তশালী মুসলমানদের দৃষ্টিনন্দন হর্ম থেকে হতদরিদ্র মুসলমানের জীর্ণ কুটিরেও সমানভাবে হাসি-আনন্দের ঢেউ জাগে। বুকের ওপর পাথরচাপা দিয়ে স্বজনদের বিয়োগব্যথা এবং যাবতীয় বিরহ-বেদনা ভুলে গিয়ে বিশ্ব মুসলিম প্রতিবছর যথাসাধ্য হাসিমুখে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্্যাপন করে থাকেন। ঈদের দিবসে মুসলমানরা নিজ নিজ এলাকার মসজিদ বা ঈদগাহে সমবেত হয়ে দুই রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেন। ঈদের সালাত আদায় করা ওয়াজিব। অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে এই সালাত আদায় করতে হবে।
ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব : স্বার্থের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত এবং ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত বিশ্ব মুসলিমের জীবনে ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব বর্ণনাতীত। ধনী মুসলমানদের ওপর এ দিবস উপলক্ষে সাদকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করা হয়েছে। গরিব, অসহায় ও মিসকিন মুসলমানরাও যেন পবিত্র ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হন, সে জন্য ধনী মুসলমানদের ওপর ফিতরকে ওয়াজিব করা হয়েছে। ঈদের সালাতের আগেই ফিতর আদায় করার জন্য ধর্মীয়ভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ঈদুল ফিতরের দিবসে আপামর নির্বিশেষে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার খোঁজখবর নেওয়া এবং সবার সঙ্গে সালাম বিনিময় করা সকল মুসলমানের উচিত।

ঈদুল ফিতরের ওয়াজিব দুটি : ক. ফিতরা দেওয়া এবং খ. ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করা।
ঈদের দিনের সুন্নতের মধ্যে রয়েছে : ক. গোসল করা, খ. খোশবু বা আতর লাগানো, গ. পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিধান করা, ঘ. নামাজ আদায়ের পূর্বে মিষ্টিজাতীয় কিছু খাওয়া, ঙ. ময়দান বা মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করা এবং চ. ঈদগাহ বা মসজিদে যাওয়ার সময় ধীরে ধীরে তাকবির উচ্চারণ করা। [সম্ভব হলে ঈদগাহ বা মসজিদে এক পথে যাওয়া এবং নামাজ শেষে ভিন্ন পথে বাড়ি ফেরা।]
ঈদের তাকবির : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।

ঈদের সালাত আদায়ের নিয়ম : ঈদের দিন সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য ঠিক মাথার উপর আসা পর্যন্ত সালাত আদায় করা যায়। সারিবদ্ধ হয়ে সালাত আদায় করতে হয় বিধায় প্রথমেই কাতার বা সারি করে নিয়ত করতে হয়। নিয়ত জানা না থাকলে ‘আমি কেবলামুখী হয়ে ইমামের পেছনে ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত নামাজ অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায় করছি’ বললেই চলবে। নিয়তের পর তাকবিরে তাহরিমা বলে হাত বাঁধতে ও সানা পড়তে হবে। এরপর ইমামের সঙ্গে অতিরিক্ত তিনবার তাকবির বলতে এবং প্রথম দুবার কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে ছেড়ে দিতে হবে ও তৃতীয় বার অন্যান্য সালাতের মতো হাত বাঁধতে হবে। এরপর ইমাম স্বাভাবিক নিয়মে প্রথম রাকাত শেষ করে দ্বিতীয় রাকাতের রুকুতে যাওয়ার পূর্বে অতিরিক্ত তিনটি তাকবির বলবেন এবং উপরিল্লিখিত নিয়মে তাকবির বলে ও হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে ছেড়ে দিতে হবে ও চতুর্থ তাকবিরে রুকুতে যেতে হবে। এরপর স্বাভাবিক নিয়মে সালাত শেষ করে ইমাম খুতবা দেবেন। খুতবা শোনাও ওয়াজিব বিধায় মুসল্লিগণকে মনোযোগসহকারে তা শ্রবণ করতে হবে। খুতবা শেষে সংঘাত-বিক্ষুব্ধ বিশ্ববাসী, বিশেষত বিশ্ব মুসলিমের সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হবে। তারপর যাবতীয় ভেদাভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা ভুলে গিয়ে চিরায়ত রীতি মোতাবেক পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে ধরে সৌভ্রাতৃত্ব প্রদর্শন করবে।

মূলত ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট (ক্ষমা করে দাও এবং ভুলে যাও)-ঈদের এই চিরায়ত আবেদনের অভাবই বর্তমানে বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ববোধে ফাটল ধরিয়েছে এবং সর্ববিধ সংঘাতে জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে। এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আমরা এই বিষবাষ্প থেকে পরিত্রাণের জন্য বিশ্বপ্রতিপালকের নিকট মিনতি জানাচ্ছি। স্মর্তব্য, যাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ এবং বুকে বুক মিলিয়ে আমরা গত বছরের ঈদুল ফিতর উদ্্যাপন করেছিলাম, তাদের কেউ কেউ হয়তো-বা ইতিমধ্যে বিশ্ববিধাতার আদেশে পার্থিব জীবনের ইতি টেনে কবরবাসী হয়েছেন। আগামী বছরের পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে কে বা কারা কবরবাসী হবেন, একমাত্র বিশ্বপ্রতিপালকই তা সম্যক অবহিত। তাই এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে অতীতকালীন যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণা ভুলে যাওয়ার এবং পরস্পরকে ক্ষমা করে দেওয়ার অনুরোধ রইল।

পরিশেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঠিকানা পরিবারের পক্ষ থেকে সকল লেখক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাকে জানাচ্ছি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং উষ্ণ অভিবাদন। আর স্বজনহারাদের জানাচ্ছি গভীর সহমর্মিতা এবং প্রয়াতদের আত্মার মাগফিরাত ও জীবিতদের দীর্ঘায়ু কামনা করছি। ঈদ মোবারক।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। 
 

কমেন্ট বক্স