ইসলামের উৎপত্তিস্থল আরবের হিজাজ থেকে বাংলাদেশ ৬০০০ কিলেমিটার দূরে। নবী করিম (সা.) এর সময়কাল থেকেও আমরা কমপক্ষে সাড়ে ১৪০০ বছর পরের। কিন্তু ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সেই নবীযুগ থেকেই স্থাপিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৬১৭ সালের দিকে চীনে যাওয়ার সময় চারজন সাহাবি বাংলাদেশের উপকূলে জাহাজ নোঙর করেন। তারা এদেশে দুই বছর ছিলেন। এরপর তাবেয়িগণ বাংলাদেশে আসেন। পীর, আউলিয়া ও মুসলিম বিজয়ীগণ হাজার বছর ধরে এ দেশকে ভালোবেসে মুসলিম সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
আল্লাহর নবী মদিনায় হিজরত করার পর দেখলেন, মদিনায় অন্য ধর্মের লোকেরা বার্ষিক উৎসব-পার্বণ উদ্্যাপন করে। বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়ও ধর্মীয় ও জাতিগত উৎসব ছিল। পারস্যের লোকেরা নওরোজ উৎসব পালন করত। নওরোজ অর্থ নববর্ষ। রোমানরা পালন করত যিশুখ্রিষ্টের জন্মোৎসব, বড়দিন। নবী করিম (সা.) একদিন আল্লাহর নির্দেশে মুসলিম জাতির ঈদ উৎসবের ঘোষণা দিলেন। ঈদুল ফিতর সম্পর্কে বললেন, সব সম্প্রদায়েরই ঈদ (আনন্দ উৎসব) আছে, আর এটি আমাদের ঈদ। অপরদিকে ১০ জিলহজ তারিখকে ঘোষণা করলেন কোরবানির ঈদ হিসেবে।
প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে আসে বলে ঈদকে ঈদ বলা হয়। আরবি ঈদ শব্দটির অর্থ বারবার ফিরে আসা। পরিভাষায় ঈদ অর্থ উৎসব। এক মাস রমজানের রোজা শেষে নতুন চান্দ্রমাসের প্রথম দিনটি ঈদুল ফিতর। ফিতর শব্দের অর্থ এক মাসব্যাপী রোজা ছেড়ে দিনের বেলা প্রথম পানাহার করা। পানাহার ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরুর দিন দুই রাকাত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে এ ঈদ পালিত হয়। জিলহজ মাসের ১০ তারিখেও দুই রাকাত নামাজ পড়ার পর আল্লাহর দেওয়া হালাল পশু কোরবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহা উদ্্যাপিত হয়। এ দুই ঈদেরই উদ্দেশ্য আল্লাহর মহত্ত্ব ও বড়ত্ব প্রচার করা এবং বান্দাদের রহমত, বরকত ও ক্ষমা লাভ। উৎসব ও আনন্দ। সাম্য, মৈত্রী, সৌজন্য ও সম্প্রীতি।
একটি ভূখণ্ডের সকল মানুষ সম্মিলিত জীবনে বিশেষভাবে যে কাজগুলো করে, এসবই তাদের সংস্কৃতি। আরবি মৌল থেকে উৎসারিত এবং মধ্য এশিয়া থেকে আগত সংস্কৃত ভাষার শব্দ ‘সংস্কৃতি’ মূলত আরবি ‘সুন্নতি’ শব্দের প্রতিবিম্ব। এ দুটি শব্দের ব্যবহারিক অর্থও খুবই কাছাকাছি।
বাংলাদেশের শতকরা ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান। তাদের জীবনে ইসলামি বোধ-বিশ্বাস ও চেতনার সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির জীবনযাত্রা। যেমন বাঙালি মুসলমানের জীবনে আজান, নামাজ, মসজিদ, মাদরাসা, আলেম, পীর, মাশায়েখ, ওয়াজ, তাফসির, সভা, মাহফিল, দাড়ি, টুপি, পর্দা, হিজাব, নেকাব, কিরাত, হামদ, নাত, জায়নামাজ, তাসবি, তারাবিহ ইত্যাদি দুধচিনির মিলনের মতো মিশে আছে। ইসলাম মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, সহজাত অভ্যাস, খাদ্য, দেশজ রীতি-পদ্ধতিকে আপন করে নিয়েই অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
যে জন্য রোজা আল্লাহর ফরজ বিধান বাংলাদেশে ঘুরেফিরে বছরের ১২ মাসেই এসে থাকে আর মানুষ সব ঋতুতেই রোজা রাখে। সাহ্্রি ও ইফতারে নিজের দেশীয় খাদ্যসামগ্রী দিয়েই করে। আরবের সঙ্গে এ দেশের খাদ্যাভ্যাসের মিল থাকা জরুরি নয়। চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা আফ্রিকার মুসলমানরা এক নিয়মেই রোজা রাখেন কিন্তু সাহ্্রি-ইফতারির খাদ্য-পানীয় হয় নিজ নিজ অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস বা বৈচিত্র্যের সঙ্গেই। এটি হচ্ছে ইসলামের সাংস্কৃতিক উদারতা ও সৌন্দর্য। ঈদুল ফিতরও সারা বিশ্বে ইসলামের বিধান হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু এর সাজ পোশাক, ঈদগাহের আবহ, খাদ্য-পানীয়, আনন্দ-বিনোদন ইত্যাদি হয় দেশীয় সংস্কৃতি সহযোগে। পবিত্র, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরে নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও সুরভিত করে ঈদগাহে যাওয়ার হুকুমটিই আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক কারণে বাঙালির জীবনে একসময় নতুন জামা গায়ে দেওয়ার রূপ পরিগ্রহ করে। যেটি ধর্মীয় বিধান নয় বলে অনেক সময় কেবল শিশু-কিশোরদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। বড়রা নতুন জামার গুরুত্ব দেন না কিংবা অর্থসংকট, জামাকাপড় আছে, হাতে সময় নেই ইত্যাদি কারণে ঈদের কাপড় নেন না। কারণ, এটি ধর্মীয় বিধান কিংবা ঈদের জরুরি অনুষঙ্গ নয়।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এতে কোনো বিষয়ই পরিবর্তনীয় নয়। উৎসবেরও এখানে বিধান ও নৈতিক দর্শন রয়েছে। সাংস্কৃতিক রূপরেখা রয়েছে। এর আলোকে মানুষ সমাজ ও অর্থনীতির কারণে ব্যবহারিক বৈচিত্র্য থাকতেই পারে। তবে বিধান ও নৈতিক দর্শনে কোনো পরিবর্তন ইসলাম সমর্থন করে না। এ হিসেবে ঈদ অসংখ্য বিধান, নৈতিক ও মানবিক সৌন্দর্যের প্রকাশস্থল। যেমন রমজান মানবতা, ধৈর্য, পরিশীলন, সহমর্মিতা, উদারতা, ক্ষমা, মাহাত্ম্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও পুণ্যসাধনার মাস। এতে মানুষের প্রতি আল্লাহর নির্দেশনা, সান্ত্বনা, প্রীতি ও কল্যাণ কামনার ভান্ডার মহাগ্রন্থ আল কোরআনের চর্চাই মুখ্য। কোরআনি চরিত্র অর্জন রমজানের প্রধান সাধনা। এর পরই আসে ঈদ। তো স্বাভাবিকভাবেই এতে ভ্রাতৃত্ব, মিলন, সম্প্রীতি, মানবিকতা, ক্ষমা, সৌজন্য ফুটে ওঠার কথা, যা মুসলিম সামাজে অবশ্যই পরিস্ফুট হয়। আর্থিক আদান-প্রদানও এসব বিধানের অনুষঙ্গ। ফিতরা সব মানুষকে সুখী-সচ্ছল ও সামাজিক করার বিধান। জাকাত অর্থ-সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যাপক ব্যবস্থাপনা। ঈদ তখনই উৎসব হয়ে ওঠে, যখন মানুষ আল্লাহর বিধান মেনে সুমানুষে পরিণত হয়। ইসলামের কোনো বিনোদন বা উৎসবও অর্থহীন বিষয় নয়। এর প্রতিটি রীতি-পদ্ধতি বিধান ও সংস্কৃতি মানবসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ইবাদতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোরবানির ঈদও ইবাদত, সামাজিকতা, মানবিকতা ও অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। রমজান ও ঈদুল ফিতর ইবাদত, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, মানবিকতা, নাগরিকদের নৈতিক উৎকর্ষের জন্য নিবেদিত। একটি জীবনব্যবস্থার প্রতিটি বিধান, রীতি, নির্দেশনা, উপদেশ, প্রণোদনা মানুষের আধ্যাত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনের উৎকর্ষের জন্য হওয়াই স্বাভাবিক। এর কোনোটিই একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। হাজার বছরের বাংলায় ঈদ উৎসব মুসলমানদের জীবনের চির প্রধান ও শ্রেষ্ঠ উৎসব। এটি ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জাতীয় উৎসব, যার বিকল্প বা বিবর্তন চিন্তা ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ ও তার রাসুল মনোনীত বিধান দুই উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। বাঙালি মুসলমানদের জন্য ঈদই আল্লাহ-প্রদত্ত এবং ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির সমন্বিত মহোৎসব।
লেখক : তালিবে ইলম ও প্রাবন্ধিক