বিভিন্ন মওসুমে বাংলাদেশে কালো টাকা সাদা হয়। গেল সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের ধুম পড়েছিল। এখন রোজার ঈদের আগে আবারো কালো টাকা সাদা করার ধুম পড়েছে। প্রথমে কালো টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়। এরপর তা রেমিট্যান্সের মাধ্যমে সাদা হয়ে দেশে ঢুকছে। সংকটে থাকা বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকে হঠাৎ বিদেশ থেকে অস্বাভাবিক পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার পর কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে জোরেশোরে।
গত মাসে ন্যাশনাল ব্যাংকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, তা প্রায় এক বছরের সমপরিমাণ। গত জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স প্রায় ১৬ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ কোটি ৩৬ লাখ ডলারে। জানুয়ারিতে যেখানে এসেছিল দুই কোটি ডলারেরও কম।
ন্যাশনাল ব্যাংকে ফেব্রুয়ারিতে আসা প্রবাসী আয়ের বড় অংশ গেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দেশটি থেকে গেছে ১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত মাসে সার্বিকভাবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রেমিট্যান্স বেড়েছে ৬৩ শতাংশের বেশি, যার অন্যতম কারণ ন্যাশনাল ব্যাংকে অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত মাসে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স ব্যাপক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার। আগের মাস জানুয়ারিতে যার পরিমাণ ছিল ২০ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। এর আগে চলতি অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ ২১ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল গত বছরের নভেম্বরে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ন্যাশনাল ব্যাংকের রেমিট্যান্সে এমন এক সময়ে অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যখন ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি উন্নতির জন্য চাপ রয়েছে। বিশেষ করে ন্যাশনাল ব্যাংকে বিভিন্ন সময়ে ঋণ অনিয়মের বিষয়ে ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা সিকদার পরিবারের কয়েকজন সদস্যের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে উঠে এসেছে।
একাধিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে নানা উপায়ে টাকা পাচার হচ্ছে। সবচেয়ে বেশী টাকা পাচার হয় হুন্ডির মাধ্যমে ‘চোখের পলকে’। অর্থাৎ মুহূর্তেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে টাকা। পরে তা রেমিট্যান্স হয়ে আবার বাংলাদেশে যাচ্ছে। বলতে গেলে- দেশে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত কালো টাকা বিদেশ ঘুরে দেশে ঢুকছে সাদা হয়ে, বৈধপথে।
অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে যাওয়া রেমিট্যান্সকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছেন বাংলাদেশের ব্যাংক নির্বাহীরা। দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে, সেটি দেখে তারা নিজেরাও বিস্মিত। হঠাৎ করে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটি বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ব্যাংকগুলো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে রেমিট্যান্স কিনে নেয়। মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান কী প্রক্রিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ডলার কিনছে, সেটি জানা সম্ভব নয়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি ঢাকায় একটি দৈনিককে বলেন, নির্বাচনের আগেসহ বিভিন্ন সময়ে দেশ থেকে অনেক টাকা পাচার হয়ে গেছে। এখন আগে পাচার করা টাকা কেউ রেমিট্যান্স আকারে দেশে আনছে কিনা, বিএফআইইউ থেকে খতিয়ে দেখা উচিত। হঠাৎ একটি ব্যাংকের এভাবে প্রবৃদ্ধি কেন হলো, এখানে মানি লন্ডারিং হয়েছে কিনা, এর পেছনে কে বা কারা আছে, কী উদ্দেশ্যে তারা দেশে এনেছে– এসব দেখতে হবে। তিনি বলেন, বড় বড় লেনদেনের মাধ্যমে এসব অর্থ দেশে এসেছে, নাকি ছোট ছোট রেমিট্যান্স আকারে এসেছে, তা দেখলে অনেক কিছু পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে এসব প্রশ্নের উত্তর বের করা সহজ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে দেশে রেকর্ড প্রায় ২১৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে দিন কম হওয়ার পরও এ রেমিট্যান্স ছিল গত অর্থবছরের একক কোনো মাসে সর্বোচ্চ। আর এযাবৎকালের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ।


ঠিকানা রিপোর্ট


