বেঁচে থাকতে হলে প্রত্যেক জীবের জন্য নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অপরিহার্য এবং এ জন্য প্রশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি জীবনকে এমনভাবে গতিসম্পন্ন কোষযোগে সৃষ্টি করেছেন, যে গতি থেমে গেলে জীবন অসাড় হয়ে পড়বে। তাই জীবনধারণ ও গতিময়তা নিশ্চিতের জন্য মহাবিশ্বে এমন সব মহামূল্যবান উপাদান সৃষ্টি করেছেন, যা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান এবং যা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিটি দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে অতি সহজেই এসব উপাদান গ্রহণ করে তা শক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিটি কোষে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা রয়েছে। উপাদানসমূহ প্রয়োজনের গুরুত্ব অনুযায়ী মহামূল্যবান হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনের তারতম্য ভেদে তা মূল্যহীন ও সস্তায় পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অন্যথায় উপযুক্ত বিনিময় মূল্য দিয়ে সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যবহার করতে হলে পৃথিবীর কোনো জীবের পক্ষেই তা সম্ভব হতো না। এতৎসত্ত্বেও যুগে যুগে মানুষ যখন পথভ্রষ্ট হয়ে আল্লাহর দেওয়া অনুগ্রহকে অস্বীকার করে নিজের ক্ষমতার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ও নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ মনে করে, তখন তাদের ভুল পথ থেকে সঠিক পথে প্রত্যাবর্তনের জন্য সৃষ্টিকর্তা রোগব্যাধি ও মুসিবতের মধ্য দিয়ে সতর্ক করে থাকেন এবং তার দেওয়া অনুগ্রহ তার ইচ্ছার বাইরে মানুষের নিজ যোগ্যতায় যে অর্জন করা সম্ভব নয়, তা বুঝিয়ে দেন।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য শুধু আলো-বাতাসই যথেষ্ট নয়, দেহের বৃদ্ধি, পুষ্টিসাধন, রোগনিয়ন্ত্রণ ও অপরাপর প্রয়োজনে সুষম খাদ্যেরও প্রয়োজন। তাই সারা পৃথিবীতেই ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর প্রাধান্য বিবেচনায় সর্বত্রই প্রয়োজন অনুযায়ী ফলমূল ও নানা জাতের সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফসল বিন্যস্ত। প্রাগৈতিহাসিক যুগে যোগাযোগের জন্য যখন ভালো কোনো ব্যবস্থা ছিল না এবং দূরবর্তী এলাকার সুযোগ ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে মানুষের সম্যক ধারণাও ছিল না, তখন এক অঞ্চলে জন্মানো ব্যবহারোপযোগী ফসল সেই অঞ্চলের লোকেরাই ব্যবহার করত কিন্তু বিজ্ঞানের বদৌলতে পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হওয়ার ফলে এখন মুহূর্তের মধ্যেই এক অঞ্চলের মানুষ পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের মানুষের যেমন খবর জানতে পারছে, তেমনি পণ্যসামগ্রীও প্রয়োজন অনুযায়ী সর্বত্র সরবরাহ ও সুষম বণ্টনের সহজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাচ্ছে। ফলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদিত পণ্য কোথাও যেমন নষ্ট হচ্ছে না, তেমনি যাদের প্রয়োজন তারাও তা সহজেই পেয়ে যাচ্ছে এবং বৈচিত্র্যময় পণ্য ও তার ব্যবহার সকল মানুষের জন্য সহজলভ্য হচ্ছে। অনেক সৃষ্টিশীল মানুষ কর্মসংস্থান ও বিদেশ ভ্রমণের সুবাদে ভিন্ন দেশের অনেক সুস্বাদু ফল ও ফসলের বীজ সংগ্রহ করে নিজ দেশে নিয়ে তার চাষাবাদ করে নতুন নতুন ফসল উৎপাদন করছে। ফলে আমদানি-রফতানির ঝামেলা ছাড়াই বহু বিদেশি পণ্য স্বদেশে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ফলে পরিবহন ব্যয় ও আমদানি-রফতানি শুল্ক না লাগার ফলে খুব কম মূল্যে মানুষ তা ভোগের সুযোগ পাচ্ছে।
মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে অর্থনৈতিক বিধিবিধান ও বিনিময়-ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। আধুনিক অর্থনীতি ও বণ্টন-ব্যবস্থা তারই প্রতিফলন। সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাদী সমাজতান্ত্রিক ও জাকাতভিত্তিক মূলত এই তিন ধরনের অর্থব্যবস্থা বিদ্যমান। এখানে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করা হলো। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় অর্থের মালিকানা নির্ধারণী বিধিবিধান মনুষ্যমস্তিষ্কনির্ভর এবং সময়ের চাহিদা মোতাবেক তা যেহেতু পরিবর্তন ও পরিবর্ধনযোগ্য আর সে কারণে তার নিরপেক্ষতায় ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা অসম্ভব নয়। তা ছাড়া এ অর্থব্যবস্থায় যেভাবে মালিকানা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে অর্জিত অর্থের পরিপূর্ণ মালিকানা অর্জনকারীর এবং তা খরচ দান ও বণ্টন মালিকের মর্জি ব্যতীত অসহায় দরিদ্র লোকেরা তা থেকে উপকৃত হতে পারে না। ফলে অর্থের প্রবাহ এমনভাবে তৈরি হয়, যাতে ধনীরা আরও ধনী এবং গরিবরা আরও গরিবে পরিণত হতে বাধ্য হয়।
ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সুদ গ্রহণ অত্যন্ত গর্হিত কাজ। সুদ গরিব কর্তৃক প্রদেয় এবং ধনীরা তা গ্রহণ করে। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি হয়। তাই সুদ গ্রহণের ব্যাপারে আল্লাহর কঠোর ঘোষণা, যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তির মতো দণ্ডায়মান হবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে দিয়েছে। আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ ও সুদকে অবৈধ করেছেন। যারা পুনরায় সুদ নিতে আরম্ভ করবে, তারাই নরকবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সুরা বাকারাহ, আয়াত ১৭৫) পরবর্তী আয়াতের ঘোষণায় আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন এবং দানকে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। (সুরা বাকারাহ, আয়াত-১৭৬) সুদ গ্রহণকারীকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণাকারী হিসেবে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের বকেয়া ছেড়ে দাও, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। যদি না ছাড়ো, তবে আল্লাহ ও তার রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে প্রস্তুত হও। কিন্তু যদি তওবা করো, তবে মূলধন তোমাদেরই। অত্যাচার করো না এবং অত্যাচারিতও হয়ো না। (সুরা বাকারাহ, আয়াত-২৭৮ ও ২৭৯) জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রবর্তিত জাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধনীর অর্জিত অর্থে গরিবের হক বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, মানুষের ধনে তোমাদের ধন বৃদ্ধি পাবে। এ উদ্দেশ্যে তোমরা সুদে যা দিয়ে থাকো, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে না; কিন্তু যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য জাকাত দিয়ে থাকে, তাদেরই ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়; ওরাই সমৃদ্ধশালী। (সুরা রুম, আয়াত ৩৯) ইসলামি শরিয়া মোতাবেক নির্ধারিত বার্ষিক ভিত্তিতে জাকাতের পরিমাণ আড়াই শতাংশ, যা বছরের যেকোনো সময়ে আদায়যোগ্য। যার ফলে ধনীরা আরও ধনী এবং গরিবরা আরও গরিব না হয়ে অর্থের প্রবাহ এমনভাবে তৈরি হয়, যাতে সমাজে ধনী-গরিবের অর্থনৈতিক পার্থক্যের কারণে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হতে না পারে এবং কেউ খেয়ে কেউ না খেয়ে এমনভাবে যাতে কারও দিনাতিপাত করতে না হয়।
এ ছাড়া রমজানের শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে অবস্থাপন্ন পরিবারের ওপর অপর একটি দানের বিধান রয়েছে সদকাতুল ফিতর, যাকে সাধারণভাবে ফিতরা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব দানের অন্যতম কারণ দরিদ্ররা যাতে অর্থের অভাবে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়। পক্ষান্তরে এসব দানের কারণে দানকারীর আমলনামায় সওয়াব লেখা হয়, যা তার পরকালীন কল্যাণে কাজে আসবে। এ ছাড়া অপর যে কল্যাণের দিকটি রয়েছে, তা হলো হক আদায়ের কারণে অবশিষ্ট সম্পদ পরিচ্ছন্নতা লাভ করাসহ দানের কারণে দানকারীর পরকালীন কল্যাণ লাভ, যা অপর অর্থব্যবস্থায় নিশ্চিত নয়। বরং অপর অর্থব্যবস্থা সুদভিত্তিক হওয়ার ফলে গরিবের সম্পদ ধনীদের করায়ত্ত করতে সহায়তা করে, যা ধনী-গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধির সহায়ক, ইসলামে যাকে হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামি অর্থব্যবস্থার মতো অন্য কোনো অর্থব্যবস্থায় এমন শাশ^ত বিধিনিষেধের দৃষ্টান্ত বিরল। এ ক্ষেত্রে ইসলামি বিধান যেহেতু শাশ্বত, তাই ইসলামি শরিয়া প্রবর্তিত বিধান অধিকতর কল্যাণকর ও সর্বযুগের জন্যই প্রযোজ্য।
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে আসন্ন ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই আনন্দের একটি দিন। জাকাতভিত্তিক ইসলামি অর্থব্যবস্থার সুবাদে ধনী-গরিব সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে ও আনন্দচিত্তে দিনটি উদযাপন করতে পারার কারণে সকল মুসলিম উম্মাহর নিকট দিনটি অধিকতর ঐশ্বর্যমণ্ডিত। সকল মুসলিম উম্মাহর প্রতি রইল পবিত্র ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।