বছর ঘুরে আবার ফিরে এসেছে বছরের বিশেষ একটি সপ্তাহ। খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীদের জন্য এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত দিনগুলো ছিল ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়-প্রায়শ্চিত্তকাল (Season of Lent) বা উপবাস/রোজার সময়। ৪০ দিনের এই ত্যাগ-তিতিক্ষার সময়ের পরের সপ্তাহটিকে অর্থাৎ মার্চ ২৪ থেকে ৩০ পর্যন্ত দিনগুলোকে ইংরেজি ভাষাভাষীরা বলে Holy Week,বাঙালিরা বলে পুণ্য সপ্তাহ, স্প্যানিশভাষীরা বলে La Semana Santa. অন্যান্য জাতি ও ভাষার মানুষেরাও তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী এই সময়কে নামকরণ করেন বিভিন্নভাবে, তবে পবিত্র শব্দটি সংযুক্ত থাকে। এই বিশেষ ও পুণ্য সপ্তাহটি সবার মাঝে মিলন ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুক, প্রবাসী ও স্বদেশি সবার মাঝে সেতুবন্ধ রচনা করুক, সকল জাতি, ভাষা ও কৃষ্টির মধ্যে ভিন্নতার মাঝেও গড়ে তুলুক একতা এবং সকল ধর্মের অনুসারীদের হৃদয়ের ঠিকানা হোক পারস্পরিক ভালোবাসা।
দীর্ঘ ৪০ দিনের এই প্রায়শ্চিত্ত বা তপস্যাকাল শুরু হয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি বুধবার, যে দিনটাকে বলা হয় ভস্ম বুধবার (Ash Wednesday)। পাপ-অপরাধ থেকে মন ফিরিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার বাহ্যিক চিহ্নস্বরূপ ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা সেদিন কপালে অথবা মাথায় বিশপ, পুরোহিত, ডিকন ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত সেবক-সেবিকার হাত থেকে ভস্ম বা ছাই গ্রহণ করেন। ভস্ম বুধবার, পুণ্য শুক্রবার এবং প্রায়শ্চিত্ত কালের শুক্রবারগুলো উপবাস ও মাংসাহার ত্যাগের দিন (Days of fasting)। অর্থাৎ ওই দিনগুলোতে খ্রিষ্টানরা মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকেন। অন্য দিনগুলোতে পরিমিত আহার (Days of abstinence) এবং যথাসম্ভব প্রার্থনা (prayer), উপবাস (fasting) ও দয়ার কাজ (almsgiving, charity) করে ঈশ্বরভক্তি প্রকাশ করেন। এই ৪০ দিনের ত্যাগ স্বীকারের দিন গণনার মধ্যে রোববারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, সেদিন যিশুর পুনরুত্থানের দিবস বলে।
তালপত্র রোববার, ২৪ মার্চ (Palm Sunday) : এই দিনে প্রভু যিশুখ্রিষ্ট সগৌরবে পুণ্য নগরী জেরুজালেমে প্রবেশ করেছিলেন বহু জনগণের সঙ্গে। তারা ‘হোসান্না! দাউদ সন্তানের জয় হোক! হোসান্না!’ বলে খেজুর পাতা, তালপাতা, জলপাই ও অন্যান্য গাছের ডালা হাতে নিয়ে যিশুর সঙ্গ নেয়। সেই ঘটনাকেই স্মরণ করে খ্রিষ্টানরা তালপত্র রোববার পালন করেন। উপাসনার প্রারম্ভে সবাই গির্জার সামনে সমবেত হন, তারপর পবিত্র বাইবেল থেকে পুরোহিত এই দিনের যিশুর জেরুজালেমে প্রবেশের কাহিনি পাঠ করে খেজুর ও তালপাতা পবিত্র জল দিয়ে আশীর্বাদ করেন। তারপর সেই আশীর্বাদিত পাতাগুলো হাতে নিয়ে সবাই শোভাযাত্রা করে গির্জায় প্রবেশ করেন। এই গত শনিবার বিকেলে ও রোববার সকালে প্রতিটি ক্যাথলিক গির্জায় খেজুর পাতা হাতে নিয়ে শোভাযাত্রা হয়েছে। এই দিন থেকেই পুণ্য সপ্তাহ শুরু হয়। এই পবিত্র দিনগুলোর ঐশ্বতাত্ত্বিক অর্থ হলো প্রথম মানব-মানবী আদম ও হবা’র আদি পাপের ফলে মানবকুলে যে পাপের অন্ধকার নেমে এসেছিল, তা থেকে তাদের মুক্ত করতে যিশুখ্রিষ্ট প্রাক্তনকালে যেভাবে পাপমুক্তির জন্য মেষশাবক যজ্ঞে বলি দেওয়া হতো, তেমনিভাবে নতুন আদম হিসেবে যজ্ঞ বলির নতুন ও শেষ মেষ হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করলেন তাঁর যাতনাভোগ, ক্রুশে মৃত্যু ও তৃতীয় দিনে মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে।
পুণ্য বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ (Holy Thursday) : এই দিন সকালবেলা কোনো সুবিধাজনক সময়ে ধর্মপ্রদেশের (Diocese) প্রধান গির্জায় (Cathedral) বিশপ অর্থাৎ প্রধান যাজকের (Cardinal, Archbishop or Bishop) পরিচালনায় ওই ধর্মপ্রদেশের পুরোহিত, ডিকন, ব্রাদার, সিস্টার ও খ্রিষ্টভক্তরা, যাদের পক্ষে অংশগ্রহণ সম্ভব, যাজকীয় অঙ্গীকার নবায়নের ও তেল আশীর্বাদের খ্রিষ্টযাগে (Chrism Mass) অংশগ্রহণ করেন। এই আশীর্বাদিত তেল তিন প্রকারের : ১) বাপ্তিস্মের তেলÑএই তেল বাপ্তিস্ম বা দীক্ষাস্নানের সময় প্রার্থীর বুকে বিশপ, পুরোহিত বা ডিকন লেপন করেন। ২) রোগীদের লেপন তেলÑবিশপ বা পুরোহিত অসুস্থকে সুস্থতার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ এই তেল রোগীর কপালে ও হাতে লেপন করেন, যাতে সে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তি পায়, শারীরিকভাবে সুস্থ হয় এবং তার বিগত জীবনের পাপের জন্য ক্ষমা লাভ করে। ৩) অভিষেকের তেলÑসুগন্ধিপূর্ণ এই তেল নতুন বিশপের মস্তক, নতুন পুরোহিতদের দুই হাত ও নতুন বাপ্তিস্ম প্রাপ্তের মস্তকে লেপন করা হয় এবং নতুন গির্জার যজ্ঞীয় বেদি (Altar) ও চার দেয়ালে লেপন করে পবিত্রকরণ করা হয়। যেহেতু পুণ্য বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অত্যাবশ্যক উপাসনা আছে, তাই অনেক ধর্মপ্রদেশে তেল আশীর্বাদের এই উপাসনা পুণ্য সপ্তাহের সোমবার বা মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়।
পুণ্য বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যে উপাসনা হয়, সেটাকে বলা হয় যিশুর শেষ ভোজ (The Last Supper of Jesus)। এটা যিশু করেছিলেন নিস্তার পর্ব (Passover) পালন করতে গিয়ে, অর্থাৎ মিসর দেশে দাসত্বকালীন সময়ে ফারাও/ফেরাউনের (Pharaoh) করালগ্রাস থেকে নিস্তার পেতে ইসরায়েলিয়রা প্রার্থনা জানালে ঈশ্বর মোশিকে (Moses) প্রেরণ করেন তাদের সকলকে ফারাওর হাত থেকে মুক্ত করে তাদের পিতৃকুল-আব্রাহাম, যাকোব ও যোসেফের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ফারাও ইসরায়েলীয় দাসদের মুক্তি দিতে রাজি না হলে ঈশ্বর মিসর দেশের ওপর ১০টি মহামারি প্রেরণ করেন-জল রক্ত হওয়া, ব্যাঙের উপদ্রপ, মশার জ্বালা, উকুনের মতো পোকা, গবাদিপশুর মৃত্যু, গায়ে ফোড়া, শিলাবৃষ্টি, পঙ্গপাল দ্বারা শস্য বিনষ্ট, অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন এবং পরিশেষে মৃত্যুদূতের হাতে প্রথমজাত সন্তানের মৃত্যু। মোশির নির্দেশমতো একটা মেষশাবককে বলিদান বা কোরবান করে তার রক্ত ইসরায়েলীয়রা তাদের দরজার চৌকাঠে লেপন করে। যেসব গৃহের চৌকাঠে মেষশাবকের রক্ত ছিল, মৃত্যুদূত সেই গৃহের প্রথমজাত সন্তানদের কোনো অনিষ্ট না করে পার হয়ে যায়। এ জন্যই এই রাত ইহুদিদের কাছে নিস্তার পর্ব (Passover)। তবে ফারাও ও মিসরীয়দের প্রথম সন্তানেরা মৃত্যুদূতের মাধ্যমে মৃত্যুতে ঢলে পড়ার পর ফারাও দাসদের মুক্তি দিলেন। নিস্তার পর্ব পালন করতে গিয়ে শেষ ভোজে যিশু নম্রতা ও সেবার চিহ্নস্বরূপ তাঁর ১২ জন শিষ্যের পা ধুয়ে দেন। এরপর তিনি তাঁর শিষ্যদের নতুন সন্ধির যাজকত্ব দান করেন এবং পরিশেষে নিজের দেহ ও রক্ত রুটি ও দ্রাক্ষারসের আকারে দান করেন, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর অনুসারীদের কাছে প্রধান উপাসনা বা খ্রিষ্টযাগ (Holy Mass/Eucharist) হিসেবে পালিত হয়। এই উপাসনার রুটি ও দ্রাক্ষারস যিশুর দেহ ও রক্তে রূপান্তরিত হয়, যা খ্রিষ্টানরা পবিত্র সাক্রামেন্ত হিসেবে বিশ্বাস করেন। পুণ্য বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যার উপাসনায় গির্জায় উপস্থিত সবার মধ্য থেকে ১২ জনকে পুরোহিত পা ধুয়ে দেন। এরপর উৎসর্গের শোভাযাত্রার সময় বিশপ কর্তৃক আশীর্বাদিত তিন প্রকারের তেল সবার কাছে উপস্থাপন করা হয়। পুরোহিতরা তাঁদের যাজকত্বের অঙ্গীকার নবায়ন করেন। শেষ পর্য়ায়ে যিশুর দেহ-রক্ত অর্থাৎ পবিত্র সাক্রামেন্ত গির্জার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো চ্যাপেলে অথবা পরিপাটি করে ফুল, মোমবাতি ও ধূপধুনা দিয়ে সাজানো কোনো স্থানে সম্মানীয়ভাবে রাখা হয় ও সারা রাত সাক্রামেন্তের আরাধনা হয় বিভিন্ন দলে পালা করে।
পুণ্য শুক্রবার, ২৯ মার্চ (Good Friday) : এই দিন যিশুর ক্রুশীয় মৃত্যুর দিন। রোমীয় প্রদেশপাল পন্তীয় পিলাত ইহুদি সমাজনেতা ও উঁচু পর্যায়ের যাজকদের চাপে যিশুকে কশাঘাত করে ক্রুশে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। জেরুজালেমের রোমান আন্তোনীয় দুর্গ থেকে বাজারের আঁকাবাঁকা পথ (Via DolorosaÑWay of the Sorrow/Cross) দিয়ে যিশু অতি ভারী ক্রুশ বহন করে শহরের বাইরে গলগথা (Golgotha) বা খুলিতলা নামে পরিচিত পাহাড়ে যান ও সেখানে তাঁকে দুজন চোরের মাঝে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় দুপুর ১২টার সময় এবং ৩ ঘণ্টা ক্রুশে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে তিনি দুপুর ৩টার সময় প্রাণ ত্যাগ করেন। সেই কষ্টভোগের কথা স্মরণ করে বিশ্বাসী খ্রিষ্টানরা পুণ্য শুক্রবার মধ্য সকালে বা দুপুর ১২টায় রাস্তায়, পার্কে কিংবা গির্জায় জীবন্ত ক্রুশের পথের ব্যবস্থা করে অর্থাৎ কেউ যিশু সেজে ক্রুশ বহন করে, কেউ রোমান সৈন্য সেজে যিশুকে চাবুক মারে, কেউ জেরুজালেমের অধিবাসী সেজে বিলাপ করে, কেউ সিরেনবাসী শিমন সেজে যিশুকে ক্রুশ বহন করতে সাহায্য করে, কেউ ভরোনিকা সেজে তার মাথা ঢাকার কাপড় দিয়ে যিশুর ঘর্মাক্ত ও রক্তাক্ত মুখমণ্ডল মুছে দেয়, কেউ আবার যিশুর মা মারিয়া সেজে সন্তানের কষ্টে দিশেহারা হয় এবং ১৪টি স্থানে থেমে থেমে খ্রিষ্টমণ্ডলীর ‘ক্রুশের পথ’ প্রার্থনাগুলো (Devotion of Stations of the Cross) আবৃত্তি করে। খুবই অনুধ্যানমূলক এই প্রার্থনা। যিশুর কষ্টভোগের কাহিনি ধ্যান করে সবাই কিছু না কিছু মনঃকষ্ট পায়। দক্ষিণ আমেরিকার জনগণ (South American Latino/Hispanics) এবং ফিলিপিনোরা (Filipinos) যে দেশেই বাস করুক না কেন, পুণ্য শুক্রবারে জীবন্ত ক্রুশের পথে অংশগ্রহণ করতে তারা খুবই চেষ্টা করে। বাঙালি খ্রিষ্টানরাও এ ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী এবং তারা তাদের স্থানীয় ধর্মপল্লিতে (Parish) গিয়ে এই প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে এবং প্রায়শ্চিত্তকালীন শুক্রবারগুলোতে পূর্বনির্ধারিত বাড়িতে গিয়ে বাংলায় ক্রুশের পথ প্রার্থনা করে। এ ব্যাপারে মা মারিয়ার সেনা সংঘ, বিভিন্ন খ্রিষ্টান সংগঠন ও অনেকে ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক উদ্যোগে ক্রুশের পথ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় অত্যন্ত চমৎকার ও সাহায্যকারী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেকটিকাট, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, ইলিনয়, ক্যালিফোর্নিয়া প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে এবং কানাডার অন্টারিও, কুইবেক, উইনিপেগ প্রদেশে। পুণ্য শুক্রবার দুপুর ৩টার সময় অর্থাৎ যিশুর মৃত্যুর প্রহরে সারা বিশ্বে সব ক্যাথলিক গির্জায় ‘প্রভুর যাতনাভোগ’-এর (The Passion of the Lord) স্মরণ উপাসনা হয়। এই উপাসনার শুরুতে সবাই নীরবে গির্জায় প্রবেশ করেন, যাজকগণ যিশুর মৃত্যুতে বিলাপের চিহ্নস্বরূপ গির্জার মেঝেতে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করেন, গির্জায় উপস্থিত সবাই জানুপাত করে নীরবে বিলাপ বা দুঃখভাগী হন। এরপর উদ্বোধন প্রার্থনার পর ঐশ্ববাণী পাঠ করা হয় এবং মঙ্গল সমাচার থেকে যিশুর যাতনাভোগ, ক্রুশ বহন এবং মৃত্যুর ঘটনা তিনজন পাঠক পাঠ করেন। এতে যিশুর সংলাপ পাঠ করেন যাজক। কিছুক্ষণ নীরবতা ও পুরোহিতের সংক্ষিপ্ত অনুধ্যানের পর বিভিন্ন উদ্দেশ্য জানিয়ে সকল খ্রিষ্টান, অন্য ধর্মাবলম্বী, যে ইহুদিরা যিশুকে মারার ষড়যন্ত্র করেছিল ও ধর্মবিহীন মানুষের জন্য সর্বজনীন প্রার্থনা করা হয়। এরপর সবাই একে একে ক্রুশ চুম্বন করে ক্রুশের অর্চনা (Veneration of the Cross) করেন। তারপর পবিত্র খ্রিষ্টপ্রসাদ অর্থাৎ রুটির আকারে যিশুর দেহ বিতরণ করা হয়। শেষ পর্যায়ে সমাপনী প্রার্থনার পর যাজক নীরবে বেদি ত্যাগ করেন, অন্যরাও নীরবতার মাধ্যমে যিশুর আত্মত্যাগের ওপর অনুধ্যান করেন ও তাঁর প্রতি সম্মান জানান।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, পুণ্য বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবারকে একত্রে বলা হয় নিস্তার দিবসত্রয় (Sacred Triduum)। এই তিন দিনের উপাসনাগুলো সংযুক্তভাবে একটা উপাসনা অনুষ্ঠান এবং তা শুরু হয় পুণ্য বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ও শেষ হয় পুণ্য শনিবার রাতে।
পুণ্য শনিবার, ৩০ মার্চ (Holy Saturday) : এই দিনটি হলো অপেক্ষার দিন (Keeping Vigil), প্রভু যিশু জেগে উঠবেন, সেই প্রতীক্ষায় (Easter Vigil) জেগে থাকার দিন। সকালে গির্জায় সমবেতভাবে প্রাতঃকালীন প্রার্থনা হয়, যে কেউ এই প্রার্থনায় যোগ দিতে পারে। দিনের বেলায় যিশুর মৃত্যুর ভাবগাম্ভীর্যতা বজায় রেখে যিশুর পুনরুত্থান পর্বের জন্য বাড়িতে ও গির্জায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সাজসজ্জায় বহুজন ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সন্ধ্যা নেমে এলে চারদিক যখন আঁধারে আচ্ছন্ন হয়, তখন শুরু হয় পুণ্য শনিবারের নিশি জাগরণীর উপাসনা। আবারও উপাসকগণ নীরবে গির্জা প্রাঙ্গণে সমবেত হন আঁধারের মাঝে, তবে হাতে মোমবাতি নিয়ে। গির্জার ভেতরে ও বাইরে কোনো আলো/বাতি জ্বালানো হয় না। যিশু বলেছিলেন, ‘আমি জগতের আলো।’ (যোহন ৮ : ১২) প্রিয়জনের মৃত্যুতে যেমন জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়, প্রভু যিশুর মৃত্যুতে খ্রিষ্ট বিশ্বাসীদের জীবনে নেমে এসেছে আঁধার। সেই আঁধার ভেঙে আবারও আলো আনতে তিনি জেগে উঠবেন, পুনরুত্থিত হবেন। তাই পুণ্য শনিবারের উপাসনার শুরু হয় অগ্নি প্রজ্বলন (লাকড়ি বা গাছের ছোট ছোট ডালা) ও তা আশীর্বাদের মধ্য দিয়ে। যাজক তারপরই পুনরুত্থানের বৃহৎ মোমবাতি (Paschal Candle), যা খ্রিষ্টীয় জীবনের আদি ও অন্ত, পুনরুত্থিত যিশুর প্রতীক, আশীর্বাদ করে সদ্য আশীর্বাদিত আগুন থেকে প্রজ্বলন করেন। সেই মোমবাতি থেকে অন্য সবাই তাদের হাতের ছোট মোমবাতিগুলো প্রজ্বলন করেন ও বড় মোমবাতি বহনকারীর পেছনে পেছনে শোভাযাত্রা করে গির্জায় প্রবেশ এবং তিন জায়গায় থেমে ‘খ্রিষ্টজগতের জ্যোতি’ ঘোষণা করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান। এরপর ডিকন বা পুরোহিত ‘নিস্তার বন্দনা’ (Exultet) গানের মাধ্যমে ঘোষণা করেন, আদি পিতা-মাতা আদম-হবার পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য করুণাময় ঈশ্বরের পরিকল্পনা। এরপর সবাই নিস্তার পর্বের কাহিনি শোনেন বাইবেলের বিভিন্ন অংশ থেকে বাণী পাঠের মাধ্যমে। এই কাহিনি শুরু হয় প্রথম মানব-মানবী আদম ও হবার সৃষ্টিকাহিনি থেকে তাঁদের প্রথম পাপে পতন, তাদের দুই পুত্র কেইন ও আবেলের কাহিনি, আব্রাহামের ছেলে ইসমায়েল ও ইসহাকের কাহিনি, মিসর দেশে ইসরায়েলীয়দের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের ওপর ফারাওর অত্যাচারের কথা, মোশির আবির্ভাব ও জ্বলন্ত ঝোপে ঈশ্বরের সঙ্গে সংলাপ, মোশির নেতৃত্বে মিসর ত্যাগ ও ৪০ বছর মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাত্রা, ঈশ্বরের কাছ থেকে দশ আজ্ঞা লাভ এবং মুক্তিদাতার আগমন বার্তা ইত্যাদি। প্রাক্তন সন্ধির কাহিনি পাঠ সমাপ্ত হলে ‘জয় পরমেশ্বরের ঊর্ধ্বলোকে জয়’ সমবেত ঐশ্ব প্রশংসা স্তুতির সঙ্গে গির্জায় সব আলো জ্বালানো হয় ও ঘণ্টা বাজানো হয়। এরপর নবসন্ধির বাণী ও মঙ্গল সমাচারের যিশুর পুনরুত্থানের গুরুত্ব ও ঘটনা পাঠ করা হয়। যাজকের সংক্ষিপ্ত অনুধ্যানের পরই সমুদয় সাধু-সাধ্বীর নাম কীর্তন করে পুনরুত্থানের মোমবাতি ছুঁয়ে যাজক দীক্ষাজল আশীর্বাদ করেন। যেসব প্রাপ্তবয়স্ক (Catechumens) দীক্ষাস্নান বা বাপ্তিস্ম পূর্বে গ্রহণ করেননি, তারা যাজক কর্তৃক দীক্ষা ও হস্তার্পণ লাভ করেন এবং অন্য মণ্ডলীতে দীক্ষাপ্রাপ্তগণ ক্যাথলিক মণ্ডলীতে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হন। এরা কিছুক্ষণ পরে প্রথমবারের মতো পবিত্র খ্রিষ্টপ্রসাদও গ্রহণ করেন। উপাসনার শেষ পর্যায়ে আবারও যিশুখ্রিষ্টের পুনরুত্থানের আনন্দ সংবাদ ‘আলেলুইয়া’ বলে ঘোষণা করা হয়। পুণ্য শনিবারের উপাসনার সমাপনীর মাধ্যমে শুরু হয় পাস্কা পর্ব বা ইস্টার (Paschal Feast or Easter)। যাজক ও গির্জায় উপস্থিত সবাই পরস্পরকে শুভ পাস্কা পর্ব বা ইংরেজিতে Happy Easter বা স্প্যানিশ ভাষায় Feliz Pascua বলে সম্ভাষণ করেন, করমর্দন করেন কিংবা আলিঙ্গন করেন। পুণ্য শনিবারের এই উপাসনার মাধ্যমে শেষ হয় Holy Week পুণ্য সপ্তাহ La Semana Santa, তবে শুরু হয় পাস্কাকাল (Easter Season)।
বিভিন্ন দেশের মানুষ তাদের রীতি, কৃষ্টি, ইতিহাস অনুযায়ী পাস্কা (Easter) পালন করেন। ইউরোপীয়দের মধ্যে ইতালির হরেক রকমের মিষ্টিজাতীয় খাবার (Italian pastries), পোল্যান্ডের বিভিন্ন প্রকারের রুটি (Polish babka), ফরাসিদের প্রচুর পনির (French cheese), বেলজীয়দের অনেক প্রকার চকলেট (Belgian chocolates) ইত্যাদি। বাঙালি খ্রিষ্টানদের পাস্কা উৎসব পালনে কোনো কমতি নেই অন্যান্য দেশের খ্রিষ্টানদের চাইতে। পুণ্য শনিবারের উপাসনার পরপরই পরিচিত সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। অনেক রাত হয়ে গেলেও পুনরুত্থানের আনন্দ একে অন্যের সঙ্গে সহভাগিতা করতে তারা দই, রসগোল্লা, চিড়া, মুড়ি, কালোজাম, বালোসা, নিমকি, জিলাপি, শিঙাড়াসহ ঘরে তৈরি বহু মিষ্টি, ঝাল খাবার ও হরেক রকম পানীয় দিয়ে পরস্পরকে আপ্যায়ন করেন পুরোটা সপ্তাহ। ৪০ দিনের উপবাস ও ত্যাগ স্বীকারের এই উৎসবের কারণ, ‘কবরে নাইরে যিশু, কবরে নাই।’ মৃত্যু আসবে ঠিকই, তবে তার পরে আছে অনন্ত জীবন, খ্রিষ্টের জয় করা অমর জীবন। আলেলুইয়া ॥
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নটরডেমিয়ান, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।