বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ করেছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম প্রেস টিভি। ‘বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করছে যুক্তরাষ্ট্র’ শিরোনামে গত শুক্রবার (৭ জুলাই) প্রেস টিভিতে একটি প্রতিবেদন প্রচার করা হয়।
২৭ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের ওই প্রতিবেদনের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করে উপস্থাপক বলেন, বিশ্বজুড়ে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে নিজের স্বার্থে সরকার পরিবর্তনের ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি সংসদে উল্লেখ করেছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) গণতন্ত্র হরণের চেষ্টা করছে। তারা এমন একটি সরকার আনতে চাইছে, যাদের গণতান্ত্রিক ভিত্তি নেই। এমনটি করা হলে তা অগণতান্ত্রিক হবে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ইরানেও। এ নিয়ে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছে প্রেস টিভি।
প্রতিবেদনে ২০২১ সালে র্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং চলতি বছর গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদানকারী যেকোনো বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ভিসানীতির প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, এতেই বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রোধের মাত্রাটি বোঝা যায়। কিউবা, হাওয়াইসহ বেশ কিছু ক্যারিবিয়ান দেশের সরকারকে হটানোর ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এ ক্ষেত্রে দেশটি তার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সহায়তা নেয়। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মানবাধিকার রক্ষার নামে এসব করে থাকে।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে দাবি করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াশিংটন নিজ স্বার্থে দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং এগুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে ওই দেশের মূল্যবান সম্পদ, বাণিজ্য রুট, কৌশলগত অবস্থানকে ব্যবহার করতে চায়। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বেইজিং ঢাকার শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ চীনের বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর চীন প্রকাশ্যে বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করেছে।
সংসদ নির্বাচনের দিকে নজর রেখে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কর্মকর্তারা ঘন ঘন বাংলাদেশে আসছেন। বৈশ্বিক আর্থিক ঝুঁকি বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক মূলত চীনকে কাউন্টার করতে দেশটির ইচ্ছারই প্রতিফলন।
প্রেস টিভির অনুষ্ঠানে পাকিস্তান থেকে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী স্কাইপেতে সংযুক্ত হয়ে বলেন, আমেরিকানরা পাঁচটি উপায়ে বিশ্বজুড়ে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। প্রথমটি অবশ্যই ভ্যালিউ সিস্টেম, এটিকে মূল্যবোধকেন্দ্রিক কিংবা আদর্শিক বলা যায়। দ্বিতীয়টি পলিটিক্যাল সিস্টেম। তৃতীয়টি তাদের ইকোনমিক সিস্টেম বা কারেন্সি ডমিনেন্স। চতুর্থটি ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড ল এবং পঞ্চমটি হলো সিকিউরিটি ডোমেইন।
বাংলাদেশের পলিটিক্যাল সিস্টেম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের দিকে যদি তাকাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের শুধু ভ্যালিউ সিস্টেমের কথা বললে চলবে না। কারণ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরানসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো চায় পশ্চিমা আধিপত্যবাদ কমুক, এটা তাদের কমন ইন্টারেস্ট (আগ্রহ)। চীনা বিনিয়োগ এবং সম্পৃক্ততাকে তারা আশার আলো হিসেবে দেখে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন চায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের বিষয়ে সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের সব জায়গাতেই রেজিম চেঞ্জের চেষ্টা একটা বাস্তবতা। কোনো উন্নয়নশীল দেশ যদি পশ্চিমাদের নীতি অনুসরণ না করে, সে ক্ষেত্রে রেজিম চেঞ্জ একটি ‘অপশন’। তারা সেটা পারুক বা না পারুক, সেটা ভিন্ন আলাপ। কিন্তু বাংলাদেশকে এখন নিজ দেশের রাজনীতি এবং আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করার চ্যালেঞ্জকে সামলাতে হচ্ছে।
ঠিকানা/এনআই