দেশের আর্থিক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা কেলেঙ্কারিতে টালমাটাল। হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের অনিয়ম, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ অনিয়মের সুরাহা হয়নি। দেশের অর্থনীতির পরিধির তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে শতাধিক ব্যাংক-বিমা কোম্পানি। এসব ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক বিবেচনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় ব্যাংকগুলো পেশাদারত্বের শৃঙ্খলায় চলছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নজরদারি এবং বিভিন্ন সময় ভুল সিদ্ধান্ত ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যর্থতায় এসব ব্যাংকের অনেকগুলোরই টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ইসলামি ব্যাংককে টিকিয়ে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ অর্থ সরবরাহ করেছে। তার পরও কয়েকটি ব্যাংকের নাজুক অবস্থা।
অসচ্ছল ব্যাংকগুলোর চিত্র তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর ওপর ‘লাল, হলুদ ও সবুজ’ রেটিং করা হয়েছে। ইতিমধ্যে একটি ব্যাংককে টিকিয়ে রাখতে অন্য একটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে। ডলার সংকট এবং ব্যাংকগুলোর নাজুক অবস্থায় গ্রাহকদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক শুরু হয়েছে। গত কয়েক মাসে দুই দফায় গ্রাহকেরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজেদের কাছে রাখছেন, এমন তথ্য প্রচার করা হয়। গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাংকে টাকা নিরাপদে থাকবে কি না, এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।
মূলত নানা অনিয়ম, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বহীনতা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদাসীনতায় দিন দিন অবনতি হচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলোর। দেশে এখন সবলের চেয়ে দুর্বল ব্যাংক বেশি। এর মধ্যে ১২টির অবস্থা খুবই খারাপ। এ ছাড়া ৯টি ব্যাংক ইতিমধ্যে রেড জোনে চলে গেছে। অপর ৩টির অবস্থান ইয়েলো জোনে অর্থাৎ রেড জোনের খুব কাছাকাছি রয়েছে। সব মিলিয়ে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ভালো আছে ১৬টি ব্যাংক।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রিসার্চের জন্য দুর্বল ও সবল ব্যাংকের তালিকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্টেবিলিটি ডিপার্টমেন্ট ব্যাংকগুলোর ছয়টি কম্পোনেন্ট নিয়ে এ তালিকা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। সম্প্রতি ২০২৩ সালের জুন থেকে অর্ধবার্ষিক আর্থিক কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য ব্যাংকের স্বাস্থ্যসূচক তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগ। এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ছয়টি কম্পোনেন্ট নিয়ে দুর্বল-সবল ব্যাংকের তালিকা করেছে। এটা আমাদের নিজস্ব রিসার্চের জন্য করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার জন্য এ রেটিং করা হয়নি। এ ছাড়া কোন ব্যাংক দুর্বল, এটা তো জানা। পুঁজিবাজার থেকেও চিত্র আপনারা দেখতে পান।
রেড জোনে আছে যেসব ব্যাংক : বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংক।
ইয়েলো জোনে আছে যেসব ব্যাংক : ইয়েলো জোনে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকসহ ১৯টি বেসরকারি ব্যাংক এবং আটটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক আছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো হলো আইএফআইসি, মেঘনা, ওয়ান, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, এনআরবি, এনআরবি কমার্শিয়াল, মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ডাচ-বাংলা, প্রিমিয়ার, ব্র্যাক, সাউথইস্ট, সিটি, ট্রাস্ট, এসবিএসি, মধুমতি, ঢাকা, উত্তরা ও পূবালী ব্যাংক। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, আল আরাফাহ, স্ট্যান্ডার্ড, ইউনিয়ন, এক্সিম ও গ্লোবাল ইসলামী।
গ্রিন জোনে আছে যেসব ব্যাংক : গ্রিন জোনে আছে ১৬টি ব্যাংক। গ্রিন জোন মূলত ভালো আর্থিক অবস্থাকে বোঝায়। গ্রিন জোনে থাকা ব্যাংকগুলো হলো প্রাইম, ইস্টার্ন, হাবিব, এনসিসি, মিডল্যান্ড, ব্যাংক আলফালাহ, ব্যাংক এশিয়া, সীমান্ত, যমুনা, শাহজালাল ইসলামী, উরি, এইচএসবিসি, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, সিটি ব্যাংক এনএ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককে এ বিশ্লেষণ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, কারণ তাদের ডেটা সেট অন্যদের থেকে আলাদা। অন্যদিকে তথ্য-উপাত্তের অভাবে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
এদিকে ১৮ মার্চ সোমবার এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ফলে ব্যাংক দুটি এখন এক ব্যাংকে পরিণত হলো। এর ফলে পদ্মার গ্রাহকেরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন। ব্যাংকটিকে একীভূত করার কারণে নতুন কোনো নাম নয়- কার্যক্রম চলবে এক্সিম ব্যাংক নামে। এতে করে পদ্মা ব্যাংকের কোনো এমপ্লয়ি চাকরি হারাবেন না। তবে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালকেরা এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন না। পদ্মা ব্যাংকের একীভূতকরণ চুক্তি শেষে এসব কথা বলেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
তিনি বলেন, বিশ্বে দুই পদ্ধতিতে একীভূত করা হয়। আমরা একুইজিশন করিনি, মার্জ করেছি। একটা সবল ব্যাংক এবং তুলনামূলক একটু দুর্বল ব্যাংকের মধ্যে মার্জ হয়েছে। পদ্মা ব্যাংকের মানবসম্পদ যেটা রয়েছে, প্রায় ১২০০ কর্মী, তাদের কারও চাকরি যাবে না। সবাই কর্মরত থাকবেন এক্সিম ব্যাংকের হয়ে। আমাদের আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ক্ষতি হবে না। আগের মতোই চলবে।
একীভূত কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর আতঙ্ক বেড়েছে আমানতকারীদের। যার প্রভাবে পদ্মা ব্যাংকে টাকা তোলার হিড়িক শুরু হয়েছে। চুক্তি সই হওয়ার দিন ও পরদিন ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় ভিড় করছেন আমানতকারীরা। তবে স্বল্প আমানতকারীদের টাকা দিয়ে দিলেও বড় গ্রাহকদের অর্থ দিতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় নিচ্ছে পদ্মা ব্যাংক।
অন্যদিকে বেশ কয়েক মাস ধরে ইসলামি ধারার পাঁচটি ব্যাংক বড় ঘাটতিতে ছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সহায়তায় হঠাৎ করে এ ব্যাংকগুলো উদ্বৃত্ত অবস্থায় ফিরে আসে। শরিয়াহভিত্তিক এসব ব্যাংক আমানত বাড়াতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংকে যে হারে আমানত বেড়েছে, ইসলামি ব্যাংকগুলোতে সে হারে বাড়েনি। মূলত শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকে সংঘটিত নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর আমানতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের কয়েকটি ব্যাংকের আর চলার মতো অবস্থাই নেই। এসব ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এটা করা হলে ব্যাংকে আমানত রেখে ফেরত না পাওয়ার অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। প্রতিটি ব্যাংকের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ তৈরি হবে।