শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড
ড. রফিকুল ইসলাম
কেন শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড-সেই বিষয় নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করব।
জীবনের উন্নয়নের প্রধান সোপানই হলো শিক্ষা। যুগে যুগে মনীষীরা শিক্ষা-বিষয়ক নানান কথা আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন। সেই শিক্ষামূলক কথাগুলো বা লেখাগুলো আমাদের জীবনের বিভিন্ন পদক্ষেপ রচনা করতে সাহায্য করে আসছে। আর সে কারণেই পূর্বের মানুষদের চেয়ে পরবর্তী প্রজন্ম পর্যায়ক্রমে বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠছে, আর তা ওঠাই স্বাভাবিক।
তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে। আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই, যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়। অসম্পূর্ণ শিক্ষা আমাদের দৃষ্টি নষ্ট করে দেয়-পরের দেশের ভালোটা তো শিখতে পারিই না, নিজের দেশের ভালোটা দেখার শক্তি চলে যায়। শিক্ষা কোনো দেশেই সম্পূর্ণত স্কুল হতে হয় না এবং আমাদের দেশেও হচ্ছে না। পরিপাকশক্তি ময়রার দোকানে তৈরি হয় না, খাদ্যেই তৈরি হয়।
শিশুবয়সে নির্জীব শিক্ষার মতো ভয়ংকর ভার আর কিছুই নেই; তা মনকে যতটা দেয় তার চেয়ে পিষে বের করে অনেক বেশি। শেখার কালে, বেড়ে ওঠার সময়ে প্রকৃতির সহায়তা নিতান্তই চাই। গাছপালা, স্বচ্ছ আকাশ, মুক্ত বায়ু, নির্মল জলাশয়, উদার দৃশ্যÑএগুলো বেঞ্চি ও বোর্ড, পুঁথি এবং পরীক্ষার চেয়ে কম আবশ্যক নয়। মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন। মানুষের অন্তর্নিহিত পরিপূর্ণ বিকাশই হলো শিক্ষা। আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জনই অশিক্ষিত, অথচ অন্যরা তাদের বিষয় চিন্তা করে। এই সকল তথাকথিত দেশহিতৈষীর দল বৈ নয় কি?
ওঠো, জাগো, নিজে জেগে অপরকে জাগাও। জীবন আর সময় হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবন শেখায় সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে আর সময় শেখায় জীবনের মূল্য দিতে। ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে বৈশিষ্ট্যটা থাকা দরকার, তা হলো প্রশ্ন করার ক্ষমতা, তাদের প্রশ্ন করতে দিন। যিনি শেখেন তিনি শিক্ষিত আর যিনি শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করেন, তিনি শিক্ষানুরাগী। আর যিনি নিজ শিক্ষানুযায়ী নিজেকে পরিচালনা করেন, তিনি প্রকৃত শিক্ষিত।
যে অন্যদের জানে সে শিক্ষিত, কিন্তু জ্ঞানী হলো সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে জানে। জ্ঞান ছাড়া শিক্ষা কোনো কাজেই আসে না। সত্যিকারের শিক্ষক তারাই, যারা আমাদের ভাবতে সাহায্য করেন। পাপে নিমগ্ন যেজন, তারও একটা ভবিষ্যৎ আছে। মহানতম ব্যক্তিরও একটা অতীত আছে। কেউই ভালো-খারাপের অতীত নয়। ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেকের ভেতর দিয়েই অনুভব করেন, দুঃখ ভোগ করেন। তাঁর গুণ, জ্ঞান, সৌন্দর্য ও ভালোবাসা আমাদের প্রত্যেকের ভেতর দিয়েই প্রকাশিত হয়। বই হলো এমন এক মাধ্যম, যার সাহায্যে আমরা বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সেতু নির্মাণ করতে পারি। আমরা যে মানবজীবন পেয়েছি, তা হলো আদর্শ মানবজীবন গড়ে তোলার উপকরণ। এমনভাবে বাঁচো, যেন কাল তুমি মরে যাবে। এমনভাবেই শেখো, যেন তুমি সর্বদা বাঁচবে।
ব্যক্তির দেহ, মন ও আত্মার সুষম বিকাশের প্রয়াস হলো শিক্ষা। আপনি নিজে সেই পরিবর্তন হোন, যা আপনি সারা বিশ্বে সবার মধ্যে দেখতে চান। যে কখনো ভুল করে না, সে নতুন কিছু করার চেষ্টা করে না। বিশ্বের সবচেয়ে অজ্ঞেয় বিষয় তা বোধগম্য হয় না। যেকোনো বুদ্ধিমান বোকা জিনিসকে বড় করতে পারে, আরও জটিল এবং আরও তীব্র। এটি একটি প্রতিভাকে স্পর্শ করে এবং সাহস অনেকটা বিপরীত দিকে অগ্রসর হয়। বিদ্বান সকল গুণের আধার, অজ্ঞ সকল দোষের আকর। তাই হাজার মূর্খের চেয়ে একজন বিদ্বান অনেক কাম্য।
বিদ্যার চেয়ে বন্ধু নেই, ব্যাধির চেয়ে শত্রু নেই। সন্তানের চেয়ে স্নেহপাত্র নেই, দৈবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বল নেই। সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা। শিক্ষার শেকড়ের স্বাদ তেতো হলেও এর ফল মিষ্টি। বৈষম্য কমাতে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা, সেটা মানুষকে চাকরির দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে, যে শিক্ষা গ্রহণ করে যে শিক্ষার গুণে গুণান্বিত হয়ে ছেলে মেয়ে সাজে, মেয়ে ছেলে সাজতে পছন্দ করে, ওই শিক্ষাকে জ্ঞানীরা শিক্ষা নয়, জাতির জন্য বিষ বলে গণ্য করেছেন।
আমরা যতই অধ্যয়ন করি, ততই আমাদের অজ্ঞানতাকে আবিষ্কার করি। দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব জাদুতুল্য। যত দিন লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণ থাকে, তত দিন মানুষ জ্ঞানী থাকে, আর যখনই তার ধারণা জন্মে যে সে জ্ঞানী হয়ে গেছে, তখনই মূর্খতা তাকে ঘিরে ধরে। তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব। শিক্ষার চূড়ান্ত ফল হচ্ছে সহনশীলতা। শিক্ষাই শক্তি, জ্ঞানই আলো, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়। মানুষ যে বিকাশমান আত্মসত্তার অধিকারী, তাকে সম্পূর্ণভাবে বিকাশ করার যে প্রচেষ্টা তা-ই হলো শিক্ষা। একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি আরেকজন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত করতে পারে না।
একজন মহান ব্যক্তির মহত্ত্ব বোঝা যায় ছোট ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ব্যবহার দেখে। আমরা জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না বলে আমাদের শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না। অতি দ্রুত বুঝতে চেষ্টা করো না, কারণ তাতে অনেক ভুল থেকে যায়। জ্ঞানী লোক কখনো সুখের সন্ধান করে না। যে যত বেশি ভ্রমণ করবে, তার জ্ঞান তত বেশি বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষার প্রথম কাজ হলো কৌতূহলের শিকে ছেঁড়া। শিক্ষা হলো সভ্যতার রূপায়ণ। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত মানুষের শিক্ষা সমাপ্ত হয় না। মানুষের সুখী হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার বুদ্ধির এবং শিক্ষার মাধ্যমে এর বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব। মাঝারি মানের শিক্ষক বলেন, ভালো শিক্ষক বুঝিয়ে দেন, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক করে দেখান। মহান শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন।
একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলেন, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়। একজন শিক্ষিত লোক নিঃসন্দেহে সম্পদশালী লোক। যে পরিবারে সবাই শিক্ষিত, সে পরিবারে এমন একটা দীপ্তি আছে, যা অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দেয়। জীবনের ব্যাপক সময় ধরেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। শিক্ষার শেষ নেই। আমার বিশ্বাস, শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক স্বশিক্ষিত। শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার সমন্বয়েই জীবনে পরিপূর্ণতা আসে। শিক্ষা অলংকারের মতো নয়, এর হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা নেই। শিক্ষা প্রকৃত মানুষের জন্ম দেয়। প্রতিটি জাতির ভিত্তি মজবুত হবে, যদি সে জাতি শিক্ষিত হয়। শিক্ষা সুন্দর আলো, কারুকার্যময় ভবিষ্যৎ এবং আত্মবিশ্বাস দেয়।
শিক্ষা মনের একটি চোখ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তোমাকে জীবিকার নিশ্চয়তা দেবে আর স্বশিক্ষা সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেবে। নিজে শিখে নাও আর অন্যকে শিক্ষা দাও। নিজে জানো আর অন্যকে জানাও। তবেই একটা শিক্ষিত জাতি গড়ে উঠবে। দেশ ও জাতির শিক্ষাব্যবস্থা সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ দ্বারা পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। নয়তো পরবর্তী প্রজন্ম অশিক্ষা কিংবা কুশিক্ষায় পর্যবসিত হয়ে পড়বে। আর গোলামির জিঞ্জির থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। সেই দায়ভার সকল সময়ের তখনকার শাসনব্যবস্থা কিংবা শিক্ষাব্যবস্থা অস্বীকার করতে পারে না।
লেখক: কলামিস্ট
কমেন্ট বক্স