বাহারুল আলম
মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বয়স নিয়ে বিভিন্ন মহলে বহুদিন ধরে চর্চা চলছে। আগামী প্রেসিডেন্টে নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণাকে সামনে রেখে এবং গত ১ জুন কলোরাডোর এয়ারফোর্স একাডেমির ২০২৩ সালের অফিসার ক্যাডেটদের পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠানের মঞ্চে তার হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার ঘটনার পর এই সংক্রান্ত চর্চা নতুন মাত্রা লাভ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। তার পরে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। নিকট অতীতে তিনি একাধিকবার অনুরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। ২০২১ সালে তিনি তার সরকারি বিমানের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে তিনবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যান।
ডেলাওয়ারে বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল চালাতে গিয়ে তিনি সাইকেল থেকে পড়ে যান। সম্প্রতি জাপানের হিরোশিমাতে অনুষ্ঠিত জি সেভেন বৈঠকে যোগ দিতে গিয়ে বাইডেন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে পড়তে পড়তে কোনোক্রমে রক্ষা পান।
সৌভাগ্যবশতঃ এসব ঘটনার কোনোটাতেই তিনি আহত হননি। তাছাড়া তার কথাবার্তায় জড়তা ও খেই হারিয়ে ফেলার ঘটনাও বিরল নয়। বাইডেন বাল্যবয়স থেকে তোতলামোর সমস্যায় ভুগছেন। এ কারণে অনেক সময় কথা শেষ করতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়। কোনো কোনো সময় তাকে এমন কি নিকট পরিচিতদের নাম উল্লেখ করতেও ভুল-ভ্রান্তি করতে দেখা যায়। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে একবার তিনি ভুল করে প্রেসিডেন্ট হিসাবে এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে রাশি সুনুক বলে সম্বোধন করেন। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের নতুন বিচারপতি কাতানজি ব্রাউন জ্যাকসনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি তাকে একজন পাবলিক ডিফেন্ডারের পরিবর্তে পাবলিক অফেন্ডার (Public Offender) হিসাবে উল্লেখ করেন। তাছাড়া একাধিক বিদেশি নেতার সঙ্গে বৈঠকের সময় তাকে দু-একবার ঘুমিয়ে পড়তেও দেখা যায়।
বর্তমানে বাইডেনের বয়স ৮০ বছর। ২০২৪ সালে প্রথম মেয়াদ শেষে তার বয়স হবে ৮২ বছর এবং দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হলে মেয়াদ শেষে তার বয়স হবে ৮৬ বছর। বেশি বয়সের কারণে তিনি তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করতে পারবেন কীনা- সে বিষয়েও কোনো কোনো মহলে সন্দেহ রয়েছে। 
সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস গত ৪ জুন সংখ্যায় শিরোনাম করে- The complicated reality of Joe Biden: America’s oldest President।
যে কোনো বয়সের মানুষ হোঁচট খেয়ে বা অন্য কোনো কারণে পড়ে যেতে পারেন। এটা কোনো অস্বাভাবিক বা দোষের বিষয় নয়। কিন্তু কথা হলো বাইডেন কোনো সাধারণ মানুষ নন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সবচাইতে শক্তিধর ও সমৃদ্ধ একটি দেশের প্রেসিডেন্ট তথা সর্বাধিনায়ক। তার মতো একজন মানুষের জন্য এসব ঘটনা নিঃসন্দেহে অনাকাক্সিক্ষত ও বিব্রতকর।
বাইডেনের বার্ধক্যজনিত এসব সমস্যা এবং জনমত জরিপে তার নিম্নমুখি অ্যাপ্রুভাল রেটিং (৩৭ ভাগ) দেখে অনেক ডেমোক্র্যাটিক নেতাকর্মী তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেন। তাকে ছাড়া দলের অন্য কারো পক্ষে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজ পুণর্দখলের চেষ্টা ঠেকানো সম্ভব হবে না বিবেচনা করে তিনি ভোটের লড়াইয়ে অংশ নিতে বাধ্য হন। এ পর্যন্ত মাত্র দু’জন ডেমোক্র্যাট বাইডেনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা হলেনÑ লেখক মেরিঅ্যান উইলিয়ামসন এবং প্রয়াত মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট এফ কেনেডির পুত্র আরএফকে জুনিয়র। আরএফকে জুনিয়র পেশায় একজন আইনবিদ এবং বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলনের সোচ্চার মুখপাত্র। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিযতা ৬০ ভাগ, আরএফকে জুনিয়রের ২৩ ভাগ এবং উইলিয়ামসনের ২ ভাগ। স্পষ্টত বাইডেন ছাড়া এ দু’জনের কারোরই মনোনয়ন প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সম্প্রতি কর্নেল ওয়েস্ট নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যাপক তৃতীয় একটি দলের (পিপলস পার্টি) হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছেন। মার্কিন জনগণের কাছে তার পরিচিতি না থাকায় বাইডেনের কৃষ্ণাঙ্গ ভোটিং ব্লকের কিছু ভোট কাটা ছাড়া তিনি আর কিছু করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
মার্কিন জনগণ তাদের প্রেসিডেন্টের মধ্যে অন্যসব গুণের মধ্যে বিশেষ করে দুটি গুণ থাকাকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে করেন।
এ দুটি গুণ হলো- Agility বা ক্ষিপ্রতা এবং Ability বা সক্ষমতা। বার্ধক্যের কারণে বাইডেনের মধ্যে প্রথমটির ঘাটতি দেখা গেলেও দ্বিতীয় গুণটি তার যথেষ্ট মাত্রায় বিদ্যমান বলে দেখা যায়। বিশেষ করে তার লেজিসলেটিভ সক্ষমতা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। উভয় পক্ষীয় (Bipartisan) সম্মতির ভিত্তিতে তিনি যেভাবে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে দক্ষতা দেখিয়েছেন, তা বহু মহলের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। Legislative skill প্রয়োগ করে তিনি American rescue plan, Inflation reduction act এবং সর্বশেষ ডেট সিলিং (Debt ceiling) বিল বিভক্ত কংগ্রেসে পাস করাতে সক্ষম হয়েছেন। শেষোক্ত বিলটি পাসের মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে মারাত্মক এক অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন।
একজন অভিজ্ঞ (Seasoned) রাজনীতিক হিসাবে তিনি জানেন, রাজনীতির খেলায় Compromise is the name of the game. 
দেবে আর নেবে, মিলাবে মিলিবে- এই মন্ত্রে বিশ্বাসী বাইডেন যেভাবে নিজের ও রিপাবলিকান দলের অতি বাম ও অতি ডান নেতাদের বিরোধিতাকে ম্যানেজ করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, তা দেখে এমনকি হাউজ স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি বলতে বাধ্য হয়েছেন, তার সঙ্গে ডেট সিলিং আলোচনায় বাইডেন was very professional, very smart and very tough। ডেট সিলিং বিল পাস নিয়ে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান দলের নেতারা যখন জয়-পরাজয় নিয়ে উচ্চকিত, তখন বাইডেন জানান, এই বলি পাসে কেউ যদি জয়ী হয়ে থাকে, তবে তারা হলো মার্কিন জনগণ।
একজন নেতার মধ্যে রসবোধ (sense of humor) থাকটা খুবই জরুরি। বাইডেনর মধ্যে এই গুণটি যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। 
সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে তিনি কৌতুক করে বলেন, you say I am ancient, but I say I am wise।
প্রায় দু’মাস আগে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিলেও বাইডেন এখানো পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্পের মতো সক্রিয় হননি। এ সংক্রান্ত সমালোচনার জবাবে বাইডেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিনেটর ক্রিস কুন বলেন, নির্বাচনী প্রচারণা নয়, for reelection, a President just needs to look like a President. Democracy depends on heavy dodoes of Civility. এই Civility বাইডেনের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও অন্য অনেকের মধ্যে এর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। 
ক্রিস কুনের বাইডেন সংক্রান্ত বক্তব্য কতোটা যৌক্তিক, তা দেখার জন্য আমাদেরকে ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ঐদিন হবে মার্কিন সাধারণ নির্বাচন।
লেখক : কলামিস্ট।
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
