আন্তর্জাতিক নারী দিবস একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক ইভেন্ট, যা প্রতিবছর ৮ মার্চ পালিত হয়। দিবসটি নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন, নারীর প্রজনন অধিকার, লিঙ্গ সমতা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অর্জন ও নারী অগ্রগতির বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। মার্চ মাস বিশ্বজুড়ে নারী হিস্টরি মাস শুরু করে। এ কার্যক্রম ১ মার্চ থেকে শুরু হয় এবং ৩১ মার্চ শেষ হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৪-এর প্রচারের থিম হলো ‘নারীদের বিনিয়োগ : অগ্রগতি ত্বরান্বিত’। এ বছরের থিম লিঙ্গ সমতা ও নারী অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে মহিলাদের নেতৃত্বের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য অর্থায়নের গুরুত্ব তুলে ধরে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পুরুষেরা তাদের স্ত্রী, বান্ধবী, মা, দাদি, বোন ও পরিবারের অন্য মহিলা সদস্যসহ তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত মহিলাদের সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। যদিও এ মনোভাব পুরো বছরের জন্য বিরাজমান থাকা উচিত। তবে এই বিশেষ দিনটিতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রচারণা ও আলোচনায় অংশভুক্ত করার প্রচলন ব্যক্তিগত জীবনে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রয়াস হতে পারে।
সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা নিউইয়র্কে ১৯০৮ সালে বস্ত্র শ্রমিকেরা (1908 garment workerÕs strike in New York) কাজের সম্মান আদায়ের লক্ষ্যে যে ধর্মঘট শুরু করেছিল, সে আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই নারী দিবসের উৎপত্তি। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে আগত ১০০ জন নারী প্রতিনিধি অংশ নেন। এ সময় নারীদের অধিকার রক্ষায় প্রতিবছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
‘মনুষ্যত্বের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের পরিপূর্ণ সাম্যের কথা এবং সব রকমের ভেদাভেদ ও বৈষম্য প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা করা হলো।’ (সুরা নিসা ১) রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নারীগণ পুরুষদের সহোদরা।’
নারীবাদ বিষয়টি নারীর ব্যক্তি সচেতনতার একটি অংশ। নারীও একজন মানুষ এবং তার বেড়ে ওঠায় পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক, সামাজিক শিক্ষার ক্ষেত্রটি একজন মানুষ হিসেবে বিকাশিত হতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একজন নারীর শিক্ষা, মেধা আর বুদ্ধিমত্তা তার জীবনবোধ পরিচালনায় বিশেষভাবে সাহায্য করে। বর্তমানে পুরুষদের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের উল্লেখযোগ্য সফলতা বিদ্যমান সত্ত্বেও পরিবার, সংস্কৃতি, কুসংস্কার ও ধর্মবিশ্বাসের দরুন নারীরা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে কেবল পুরুষ ও সমাজ কর্তৃক নারীরা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন তা নয়, নারী কর্তৃক নারীরাও দেশে-বিদেশে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
‘ÔAlmost 85% of those who took part in the 50-question survey admitted having suffered serious, life-altering knocks at the hands of other women. They reported that many of their female friendships had an Òintense, sinister underbellyÓ, characterised by Òintrafemale incivilityÓ and insidious, Ògratuitous negativityÓ. More than 75% had been hurt by the jealousy and competition of a friend.Õ
Amelia Hill, The article, Women are their own worst enemies, study finds
The Guardian.
নারীর উত্তরণে পুরুষ যেমন হীনম্মন্যতায় ভোগেন, নারীরাও একইভাবে সফল অথবা প্রতিভাবান নারীর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন এবং এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পুরুষ ও নারী উভয়ই সফল নারীটি সম্পর্কে সমাজে নানা কুৎসা রটিয়ে তাকে হেয় করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে নানা গুজবের সৃষ্টি করেন। অবশ্য নেতিবাচক বোধ নিয়ে যেসব নারী-পুরুষ এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন; তাদের শিক্ষা, মেধা, বোধ ও মননের স্থানটি পরিশীলিত নয়; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রসঙ্গত, ছেলেবেলায় শিক্ষামূলক শিয়াল ও আঙুর ফলের গল্পটি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। প্রবাদ বাক্যটিও এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য, ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।’
মানুষের মনের অপূরণীয় চাহিদাগুলো মানুষকে প্রতিনিয়ত দংশন করতে থাকে। একই সঙ্গে জীবনযাপনের প্রয়োজনের সঙ্গে মানুষকে অনেক অযাচিত পরিস্থিতি ও অপ্রাপ্তির সঙ্গে আপস করে চলতে হয়। জীবনযাত্রার এই অপ্রাপ্তির অভাববোধ চিকিৎসাবিজ্ঞানে defense বলে আখ্যায়িত। প্রথমটি denial বা অবজ্ঞা করা। দ্বিতীয়টি যে ব্যবস্থা, সেটি যুক্তি তৈরি করে না পাওয়া বা অন্য কিছু পাওয়াকে মানিয়ে নেওয়া, এই ব্যবস্থাকে Rationalisation বলে। এর দুটি রূপ ÔSour grapeÕ Ges ÔSweet lemonÕ. অর্থ প্রাপ্তিগুলো মিষ্টি বা বস্তুগত; অপ্রাপ্তিগুলো টক বা অবস্তুগত। যারা সাফল্য অর্জন করেছেন কোনো কারণ ছাড়াই সফল মানুষটি অসফল মানুষদের আক্রোশ, পরশ্রীকাতরতা ও ঈর্ষার শিকার হয়ে সচরাচরই চক্ষুশূল হয়ে পড়েন এবং সামাজিকভাবে নানা ক্ষতির সম্মুখীন হন।
প্রথমত নারী একজন মানুষ। একজন মানুষ হিসেবে নারীরও অধিকার রয়েছে এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার। সর্বোপরি একজন নারীই পারে নিজের মতো করে তার জীবন গড়ে তুলতে। অথচ আমাদের সমাজ, ধর্ম জন্মের পর থেকেই নারীকে দুর্বল, পরনির্ভরতায় গড়ে তোলে। নারীর পেশিগত দুর্বলতার কারণে নারীর প্রতি পশুতুল্য মনোভাব দেখানো হয়েছে অন্ধকার সমাজে। সে যুগে জন্মের পরে নারীকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। ধর্মগ্রন্থে মানুষকে বলা হয় ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব। তদুপরি মানুষের আচরণ হওয়া উচিত অন্যান্য জীবের চেয়ে স্বতন্ত্র। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘আমি মানবজাতিকে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছি।’ অথচ সে মানুষই আজ দানবসম আচরণ করছে। দেশে হত্যা, ধর্ষণ, ইভটিজিং ও আত্মহননের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হারে বেড়ে চলেছে। হত্যার পাশাপাশি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে নারী ও শিশু ধর্ষণ। নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি সহিংস দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছয়-সাত বছরের মেয়েশিশু কিংবা কোলের শিশু। এ সহিংসতা রোধে নারীর প্রতি সমাজ ও পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।
একজন নারীর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, জীবনযাপন সবই সমাজের গঠন, কাঠামো ও প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। নারীরা শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে যোগদান করছেন যেমন সত্য, তেমনি এটাও ঠিক, ঘরে-বাইরে আজও নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন। নারী নির্যাতন ও তার প্রতিকারের চেষ্টা, নারীর সমানাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে সভা, বক্তৃতা বা অঙ্গীকারের কমতি না থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
নারীর সমানাধিকার ও সংগ্রামের বিশ্বজনীন প্রতীক ‘দ্য বোভোয়ার’ চেয়েছিলেন নারী ও পুরুষের সাম্য ও প্রীতিপূর্ণ বিকাশ। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়ের জন্ম মানেই পরিবারের বোঝা, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার কারণে একটি নারীকে পরনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে হয়। সমাজে ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন এনে মেয়েদের কিছু সুবিধা দিলেও মূল কাঠামোতে আজও তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বদলায়নি সমাজের মানুষের মানসিকতা। নারীর প্রতি সামাজিক ও পারিবারিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।
ইদানীং নারীবাদ নিয়ে যে বিতর্ক; সেই বিতর্কে অনেক নারীই সোচ্চার আওয়াজ তুলছেন এবং নিত্যনতুন খবরের জন্ম দিচ্ছেন। নারী জাগরণে প্রতিবন্ধকতার সমস্যা সৃষ্টিতে নারী নিজেই পরিস্থিতি বিশেষে দায়ী, বাকিটা সমাজসৃষ্ট। আইনের ধারায় বা সামাজিক দণ্ডবিধির আওতায় এনে এসব সমস্যার সুরাহা পাওয়া যেতে পারে। তবে কোনো নারীই কোনো সফল নারীর ব্যক্তিজীবন টেনে এনে নারীবাদকে হেয় করার অধিকার রাখে না। এমন হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত ও আত্মবিশ্বাসহীন নারী অন্য নারীর সঙ্গে কৃত্রিম ব্যবহার করে অন্তরের ঈর্ষা পুষে প্রগতিশীল নারীর সম্মানগত বা পেশাগত ক্ষতিসাধন করে এবং ভেতরে ভেতরে লিঙ্গভেদ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করে। এই মানসিকতা থেকে নারীকে মুক্তি পেতে হবে। নারীবাদ বিষয়কে কটাক্ষ না করে লোভ, ঘৃণা, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা ও স্পর্শকাতরতার ঊর্ধ্বে বিচরণ করে। প্রতিটি নারী যেন স্বকীয় ব্যক্তিত্বে প্রজ্জ্বলিত হতে পারে এবং সেই সঙ্গে নারীর শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং একে অপরের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে নারী অধিকার ও সাফল্য প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হতে পারে, সে বিষয়ে প্রত্যেক নারীকেই সচেতন হতে হবে।