মুহম্মদ শামসুল হক
স্মরণকালের মনুষ্যসৃষ্ট সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ বৈরিতা এবং অসহনীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছেন সিংহভাগ শান্তিপ্রিয় ও সংখ্যালঘু আমেরিকান। শতাব্দীর ভয়াবহ প্রাণঘাতী করোনা মহামারিতে প্রায় ১২ লাখ আমেরিকানের প্রাণহানি, কয়েক কোটি আমেরিকানের করোনা ভোগান্তি, বেকারত্ব, নিজ প্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশস্পর্শী মূল্য, বাড়ি ভাড়ার দৌরাত্ম্য, আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় নিয়ন্ত্রণহীন প্রাণহানি, সংসার ভাঙার ঘৃণ্য প্রবণতা, সিঙ্গেল পিতা/মাতার আশঙ্কাজনক হারে সংখ্যাবৃদ্ধি, উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গদের অনাপসকামী মনোবৃত্তি, বায়ুদূষণের বিষক্রিয়ার সঙ্গে কাঠফাটা রোদের দাবদাহে অতীষ্ঠ কোটি কোটি আমেরিকান আত্মহত্যার জন্য বিষ কিংবা পালানোর জন্য দিশ খুঁজে পাচ্ছে না। বিশ্ববাসীর অজান্তেই আধুনিক বিশ্বের স্বর্গরাজ্য বা অমরাবতী হিসেবে পরিগণিত যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক বেহাল দশা বর্তমানে তুঙ্গে উঠেছে। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার বর্ণনা অনুসারে, স্মরণকালের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ তাপমাত্রায় দগ্ধ, টেক্সাসে তাপমাত্রা-সংশ্লিষ্ট রোগব্যাধিতে ভুগে ১৩ থেকে ১৫ জন ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন।
পরিবেশিত সংবাদ অনুসারে, দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে টেক্সাসের ওয়েব কাউন্টি ও গালভেস্টন কাউন্টি এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় স্টেটগুলোর তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট অতিক্রম করায় অগণিত জনগণ শরাহত পাখির মতো ছটফট করছে এবং ১৩ থেকে ১৫ জন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুবরণ করেছেন। আর সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) বর্ণনা অনুসারে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের ২২ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে টেক্সাসের হাসপাতালগুলোর জরুরি কক্ষে রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সংস্থাটির বর্ণনা অনুসারে, গত বছরের উপরোল্লিখিত সময়ে টেক্সাসের হাসপাতালগুলোর জরুরি কক্ষে প্রতি লাখে ৬৩৯ জন তাপমাত্রা-সংশ্লিষ্ট রোগে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আর চলতি বছর হাসপাতালে জরুরি কক্ষগুলোতে ভর্তি হওয়া তাপমাত্রা-সংশ্লিষ্ট রোগীর সংখ্যা প্রতি লাখে ৯০০ অতিক্রম করেছে।
আবহাওয়া দপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরু থেকেই টেক্সাসসহ দক্ষিণাঞ্চলীয় স্টেটগুলোর তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট অতিক্রম করেছে এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে হিট ওয়েভে স্থানীয় জনগণ মরণাপন্ন দশায় উপনীত হয়েছে।
টেক্সাসের হিউস্টন সানিসাইড মাল্টিসার্ভিস সেন্টারের বর্ণনা অনুসারে, জুনের শেষ কয়েক দিন প্রতিদিন গড় তাপমাত্রা ১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট অতিক্রম করেছে। ৩০ জুন হিউস্টনের অস্টিনের তাপমাত্রা ১১০ ডিগ্রি, কর্পাস ক্রিস্টির তাপমাত্রা ১০৯ ডিগ্রি এবং টেক্সাসের তাপমাত্রা ১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট স্পর্শ করেছে। এ ছাড়া লারেডোর তাপমাত্রা ১১৫ ডিগ্রি এবং সান অ্যাঙ্গেলোর তাপমাত্রা ১১১ ডিগ্রি অতিক্রম করেছে। মেক্সিকো এবং ওকলাহোমার তাপমাত্রাও ১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পৌঁছেছে বলে আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে। তাপমাত্রার এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে উপদ্রুত এলাকার হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এবং ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিস বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও অকস্মাৎ ওয়াইল্ড ফায়ারের আশঙ্কায় লাখ লাখ মানুষের দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চরমে উঠেছে।
সিডিসি জানিয়েছে, বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং বায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে প্রতিবছর সারা বিশ্বে ছয় শতাধিক মানুষ বায়ুর উষ্ণতাজনিত রোগব্যাধিতে প্রাণ হারাচ্ছে। আর ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি এবং দ্য থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের বর্ণনা অনুসারে, আবহাওয়াজনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি গ্রীষ্মকালে যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যয় বাবদ অনতিবিলম্বে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। আবহাওয়া বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন না কমালে প্রতিবছর আমেরিকাকে সর্বোচ্চ ৫৩ দিন সর্বনিম্ন ৯৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে সর্বোচ্চ ১১০/১১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার ধকল পোহাতে হবে।
গোদের ওপর বিষফোড়া : আমেরিকার সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র কানাডার দুই কোটি একর ভূখণ্ডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও ধোঁয়া যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে ২০টি স্টেটের কোটি কোটি আমেরিকানের জীবন ও স্বাস্থ্যকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। কানাডার ইন্টারএজেন্সি ফরেস্ট ফায়ার সেন্টারের বর্ণনা অনুসারে, চলতি বছর পাঁচ শতাধিক সক্রিয় অগ্নিকাণ্ডে কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলে-পুড়ে খাক হয়েছে এবং কানাডার অগ্নিকাণ্ডের তাপ ও ধোঁয়া বিগত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকার আবহাওয়াকে বিষাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর করে তুলছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বর্ণনা অনুসারে, কানাডার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং ঘন ধোঁয়ায় মিডওয়েস্ট, নর্থইস্ট এবং সাউথইস্টের অংশবিশেষের অনেক স্টেটের আবহাওয়া পুরোপুরি অস্বাস্থ্যকর ও জীবনঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পিটসবার্গের মেয়র দাবি করেন, সান ডিয়াগো এবং পাইরেটসের মধ্যবর্তী পিটসবার্গের আবহাওয়া অদ্যাবধি স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে। করোনা মহামারির সাবেক এপিক সেন্টার হিসেবে পরিচিত নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোকুল জানান, রচেস্টার ও বাফেলোর আবহাওয়া অদ্যাবধি জনস্বাস্থ্যের জন্য পুরোপুরি ঝুঁকিপূর্ণ। গভর্নর হোকুল আরও জানান, বাতাসে ধোঁয়া এবং তাপের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অসংখ্য নিউইয়র্কবাসী শ্বাসকষ্টসহ নানা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। নিউইয়র্ক হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড ইমার্জেন্সি সার্ভিসের কমিশনার জ্যাকি ব্রেই বলেন, এখনো আমাদের পুলগুলো উন্মুক্ত রাখতে হচ্ছে। কলাম্বাস, ওহাইওর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ২৪৪ বলে জানা গেছে।
স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের বর্ণনা অনুসারে, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ১০০ এর বেশি হলে তা অস্বাস্থ্যকর বিবেচনা করা হয়। ইস্টার্ন গ্রেট লেকস থেকে ইন্টারস্টেট ৯৫ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার আবহাওয়াও অস্বাস্থ্যকর বলে সিডিসি জানিয়েছে। মোদ্দাকথা, মানুষের অবয়বধারী সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা এবং প্রাকৃতিক নিষ্ঠুরতায় শান্তিপ্রিয় আমেরিকানরা অশান্তির অনলে দিবারাত্রি পুড়ে খাক হচ্ছেন।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ৪ জুলাই ২০২৩




