একজন অ্যারোন বুশলেন তার নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করার মতো দুঃসাহস দেখালেও তার মরণোত্তর শাস্তির বিধান প্রচলিত রাখবে মার্কিন প্রশাসন। তিনি যে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তার পরও চাকরিতে থাকাকালীন কী করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে এত বড় কাজ করার সাহস দেখাতে পারলেন ২৫ বছর বয়সী এক যুবক?
নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের নীতি অনুযায়ী সক্রিয় দায়িত্বে থাকা সেবাকর্মীদের পক্ষপাতমূলক রাজনৈতিক কার্যকলাপে নিজেকে যুক্ত করা এক অমার্জনীয় অপরাধ। অতএব, অ্যারোন বুশলেন নামক সেই আত্মঘাতী যুবক নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে গিয়ে নিজেই এক অমার্জনীয় অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। আহা, আইনের দেশ হিসেবে চিহ্নিত এই যুক্তরাষ্ট্রে কেউ কি আর অপরাধ করে পার পায়? অ্যারোন বুশলেন মরে গেলেও তার রেখে যাওয়া শরীরের ছাইভস্মকে হয়তো সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এমন কথাই এখন খুব জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। ঘটেছিল ওয়াশিংটনস্থ ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে। টেক্সাসের বাসিন্দা ২৫ বছর বয়সী ওই যুবক ছিলেন মার্কিন বিমানবাহিনীর একজন কর্মরত ও সক্রিয় সদস্য। তিনি ২০২০ সাল থেকে মার্কিন বিমানবাহিনীর ৭০তম গোয়েন্দা, নজরদারি ও অনুসন্ধান শাখার সাইবার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। গত পাঁচ মাস ধরে গাজার ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং নিরপরাধ মানুষের ওপর হত্যালীলার নারকীয় তাণ্ডবে প্রায় ৩০ হাজারের মতো মানুষের মৃত্যুর ঘটনাটি অন্যান্য মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষের মতো তাকেও প্রচণ্ড ধরনের আহত করেছিল। তিনি দেখেছেন, ওই অসম যুদ্ধ বন্ধের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমানে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজনে ইহুদি সম্প্রদায়ও সমান কাতারে এসে দাঁড়াচ্ছে। সেই গণহত্যায় সহযোগী দেশের ভূমিকায় দাঁড়িয়েছে বিশ্ব মোড়ল হিসেবে চিহ্নিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
যে দেশে বুশলেনের জন্ম, সেই দেশটি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ইসরায়েলের মতো একটি আগ্রাসী শক্তিকে আরও শক্তিশালী করে মুসলিম বিশ্বের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিতে যতটা সহযোগিতা করা যায়, তা-ই করে চলেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের বড় মাপের সামরিক ও আর্থিক শক্তির মূল জোগানদারের ভূমিকায় এতটাই উচ্চকণ্ঠ ছিল, যার প্রমাণ হলো ২০২০ সালে দেশটি ইসরায়েলকে ৩৮০ কোটি ডলার দিয়েছিল। তার মধ্যে ৫০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে শুধু ক্ষেপণাস্ত্র নিরাপত্তাব্যবস্থায়। বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইহুদি-অধ্যুষিত ওই দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে একক সাহায্যদাতা দেশ হিসেবে আদায় করে নিয়েছে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা।
আমেরিকার কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ অর্থবছরে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সামরিক প্রকল্পে ৫২ কোটি মার্কিন ডলারের অনুমোদন দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। যার মধ্যে ৫০ কোটি শুধু মিসাইল তৈরির খাতে। এই বিপুল অর্থে কেনা সামরিক অস্ত্র, গোলাবারুদ আর বোমা ইসরায়েল গত পাঁচ মাস ধরে হামাসকে নির্মূল করার নামে ফিলিস্তিনের নিরপরাধ মানুষ হত্যায় ব্যয় করেই চলেছে। সহযোগিতায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল যদিও বলছে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিন্তু সত্যি হচ্ছে যুদ্ধের সংজ্ঞা এটা নয়। এ পর্যন্ত গাজাসহ পরবর্তী সময়ে রাফায় যে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে ইসরায়েল, তাকে সহজ ভাষায় বলে গণহত্যা।
সম্প্রতি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভাও বলেছেন কথাটি। তার ভাষায় যা উচ্চারিত হচ্ছে, তার নমুনা হলো : ‘ইসরায়েল গত পাঁচ মাস ধরে গাজার ওপর যা করছে, তাকে যুদ্ধ বলে না, এটা গণহত্যা। নির্বিচারে গাজার সাধারণ মানুষকে খুন করছে তারা।’ তার মতে, ‘এটা যদি গণহত্যা না হয়, তাহলে গণহত্যার সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে।’ তিনি এই গণহত্যাকে হিটলারের হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন, অবিলম্বে এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।
এই মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে নেতানিয়াহু সরকার ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টকে ইসরায়েলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা ছাড়াও তেল আবিবে অবস্থিত ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া ভাষায় তার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, অবিলম্বে এই মন্তব্যের জন্য প্রেসিডেন্টকে ক্ষমা চাইতে হবে।
যে নরপিশাচের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ অশুভ শক্তিদাতার ভূমিকায় রয়েছে, তার আস্ফালন তো এমনটাই হওয়ার কথা।
গাজার ওপর এই নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন যদিও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বার্টিন স্যান্ডারসসহ বেশ কয়েকজন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য দ্বারা। সম্প্রতি ইসরায়েলকে ৭৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার মূল্যের অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রির যে প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন, তা স্থগিত করারও দাবি জানিয়েছেন তারা।
মার্কিন সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস গত জানুয়ারি মাসে এক জরিপের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্যের খবর জানিয়েছিল, সেখানে তারা দেখিয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিনিদের শতকরা হিসেবে প্রায় অর্ধেকের মতো গাজায় যা হচ্ছে, তা ইসরায়েলের মাত্রাছাড়া ঘটনা। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। এই সংখ্যা ৪০ শতাংশের মতো ছিল। এই জরিপের দুই মাস আগে, অর্থাৎ নভেম্বর মাসের হিসাবে, ক্রমেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়ছে না। তাই বিষয়টি আরও করুণ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। গাজা ধ্বংসের পর তার বিধ্বস্ত জনপদের বাসিন্দারা পার্শ্ববর্তী অঞ্চল রাফায় আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। সেই সব বাস্তুচ্যুত অসহায় মানুষদের ওপরও সমানে সাঁড়াশি আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি সেনারা। লাইনে দাঁড়িয়ে খাদ্য সংগ্রহ করছে এমন অসহায় মানুষদের প্রতি তারা ব্যবহার করছে ত্বক পুড়িয়ে দেয় এমন দাহ্য রাসায়নিক হোয়াইট ফসফরাস। এ ছাড়া রাফায় খাদ্যশস্যবাহী ত্রাণসামগ্রী যাতে ঢুকতে না পারে, তার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে ইসরায়েল। এসব কারণকে সামনে রেখে জাতিসংঘ সম্প্রতি এক ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করেছে, ‘ফিলিস্তিনের ওইসব দুর্ভাগা মানুষেরা মনুষ্যসৃষ্ট ওইসব কর্মকাণ্ডের কারণে আসন্ন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে আছে।’ জাতিসংঘ এমন ‘ঠুঁটো জগন্নাথের’ দশায় উপনীত, কে-বা আর মান্য করে ওই সংস্থাটিকে, যার কোনো নিজস্ব সার্বভৌম ক্ষমতাই নেই।
তাই দেখা যায়, গত পাঁচ মাসের মধ্যে জাতিসংঘে উত্থাপিত তিনবারের মতো মানবিক বিপর্যয় প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনা হয়েছিল, সেসব প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র! আর ইসরায়েলের ভাষ্য অনুযায়ী, হামাসকে নিষ্ক্রিয় না করা পর্যন্ত তারা কোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সায় দেবে না। অতএব, একজন বুশনেলের হৃদয়ের রক্তক্ষরণে যতই মর্ম যাতনার হাহাকার উচ্চকিত হোক না কেন, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বা তার তাঁবেদার ইহুদি আগ্রাসী শক্তির মধ্যে কোনো মানবিক চেতনার স্ফূরণ ঘটবে নাÑএটা জানতেন বলেই নিজেকে আত্মাহুতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের একটা ইতিহাস তৈরি করে গেলেন মার্কিন বিমানবাহিনীর একজন সক্রিয় সদস্য অ্যারোন বুশলেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গড়িয়ে যাওয়া মধ্যদুপুরে তিনি ওয়াশিংটস্থ ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে নিজের শরীরে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন। সেই সময়ে বুশলেন চিৎকার করে বলছিলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর এই নারকীয় হত্যালীলা তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। তাই কোনোভাবেই এই গণহত্যার সঙ্গে নিজেকে জড়াবেন না তিনি। যখন দাউদাউ করে আগুন তার সারা শরীর গ্রাস করে দিচ্ছিল, তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে শেষ উচ্চারণ করলেন, ‘মুক্ত ফিলিস্তিন’! ইহুদি লবির কবজায় থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস বিষয়টিকে এতটাই হালকা করে দেখল যে, ওই নিউজের শিরোনাম করল তারা, ‘পুলিশ বলছে ইসরায়েলি দূতাবাসের বাইরে গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা গেছে এক ব্যক্তি’। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এক দিন। ২০০৯ সালের এই দিনে ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহে তৎক্ষণিকভাবে মারা গিয়েছিলেন বিডিআরের মহাপরিচালক শাকিল আহমদ ছাড়াও মোট ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা। এ ছাড়া নিহতের সংখ্যা ছিল ৭৪-এর মতো। এত বড় বিপর্যয় জাতির ইতিহাসে আর কোনো দিন ঘটেনি। তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে। নানা ধরনের বিতর্ক বিষয়টিকে আরও বেশি নাজুক করে তুলেছে। পরবর্তী সময়ে যদিও ওই বিদ্রোহের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকজনেরÑতাদের সংখ্যা ছিল ১৩৯ জনের মতো। বাদবাকি অনেকের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কয়েদির সংখ্যাও ছিল উল্লেখ করার মতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো ওই বিদ্রোহের নেপথ্যের মদদদাতা শক্তির পরিচয়টা উদ্ঘাটিত হলো না গত কয়েক বছরেও। জনগণ জানল না এমন একটি প্রশিক্ষিত শক্তিকে নির্মূল করে দেওয়া কিংবা সামরিক শক্তিকে কোনো ধরনের মেসেজ দেওয়ার পদ্ধতি হিসেবে এ ধরনের হত্যালীলায় ইন্ধন জুগিয়েছিল কি না কোনো অপশক্তি! জাতিকে এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আরও কতকাল অপেক্ষা করতে হবে, আসলে সেই হিসাবটা জানে না কেউ। সেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের এক ধাক্কায় নাই হয়ে যাওয়া ৭০ জন মানুষের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত চাওয়া ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো করণীয় নেই। আমরা এই মুহূর্তে সেই কাজটাই করছি...!
পুনশ্চ : ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। শ্রমজীবী নারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে দীপ্ত এই দিনটি সারা বিশ্বের নারীদের কাছে উল্লেখযোগ্য এক ইতিহাস তৈরির প্রেক্ষাপট। ২০২৪ সালের নারী দিবসের থিম হলো ‘নারীতে বিনিয়োগ করুন, অগ্রগতি ত্বরান্বিত করুন’। বিশ্বে মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। যদিও বিশ্বের রাজনীতিসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে বেশ কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, কিন্তু সামগ্রিক ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন বড় কোনো উন্নয়নের অংশীদার হতে পারছে না। বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধবাজ শক্তিগুলোর কারণে ইউক্রেন ও ফিলিস্তিনের মানুষেরা যে মানবিক বিপর্যয়ের কবলে পতিত হয়েছে, তার অর্ধেকেরও বেশি রয়েছে নারী ও শিশুর সংখ্যা। মৃত্যুহারও তাদের বেশি। আমরা জানি না, সামনের দিনগুলোতে আরও কত বিপর্যয় অপেক্ষা করছে মানুষের ভাগ্যাকাশে। সেই সময়ে কি নারীরা মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে আদায় করে নিতে পারবে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার? সেই দিনের অপেক্ষায় থেকে স্যালুট জানাই যারা সেই ১৮৫৭ সালে অনুষ্ঠিত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের সবাইকে।