জেহিন বেগম
জানালাটার পাশে এসে বসা যেন একটা বিনোদন সাহারা খাতুনের। একটা দম ফেলার জায়গা। অবসর পেলেই এখানে এসে বসেন। কালো রাস্তাটা দ্বিপ্রহরের রোদে চকচক করছে। এতটুকু ধুলাবালু নেই। দিনের এ সময়টায় কোনো বাড়িতেই লোক থাকে না। সবাই কাজে। বাচ্চারা হয় স্কুলে, না হয় ডে কেয়ারে। কোনো গাড়িঘোড়ার চলাচল নেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা। সুখের দেশ মার্কিন মুলুকের সুখী বাসিন্দা তিনি। কোনো অভাব নেই। সবকিছু সুন্দর, ত্রুটিহীন। ঝকঝকে বাড়িঘর আসবাবপত্র গাড়িঘোড়া। চমৎকার প্রকৃতি। এত সুন্দর প্রকৃতি আগে কখনো দেখেননি। খাবারের কোনো লেখাজোখা নেই। ফ্রিজভরা খাবার। যত খুশি খাও। পোকামাকড় নেই, গরিব মানুষ নেই। একটা ফকির পর্যন্ত চোখে পড়েনি আজতক। তবু কেন যেন মনটা হু হু করে। কারণে অকারণে। প্রথম প্রথম ফোন করলেই নাতনিরা বলত, দাদি, তুমি কুনদিন আইবায়? উত্তর জোগাত না মুখে। আজও জানেন না সত্যি কোনো দিন ফিরে যেতে পারবেন কি না দেশে। এ যেন অভিমন্যুর ব্যুহ। ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না। এখন যোগাযোগ অনেকটা শিথিল। প্রয়োজনে ছেলের সঙ্গে কথা হয়।
রাস্তাটা ধীরে ধীরে কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। কুয়াশাঘেরা কুশিয়ারা নদীর পাড় ধরে আস্তে আস্তে নিজেকে এগিয়ে আসতে দেখেন তিনি। বাম বাহুতে ঝোলানো শাড়ি ব্লাউজ গামছা। মুঠোয় ধরা সাবান কেস। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। নদীতে নাইতে চলেছেন। চৌধুরীবাড়ির বউ-ঝিরা কখনো নদীতে গোসল করে না। বাদলের সাজানো নাটকের আজ তিনি কুশীলব।
দু-তিন দিন ধরে একদমই খেতে পারেন না। গলা দিয়ে ভাত নামে না। পুত্রবধূ বলে, মা, এ রকম করলে তো শরীর টিকবে না। দুশ্চিন্তায় আতঙ্কে ঘর-বার করেন। চোখে ঘুম নেই। কেমন করে পার হবেন। দু’পাশে দুই নাতনিকে নিয়ে ঘুমান। বড়টা পিঠের সঙ্গে সেঁটে থাকে। ছোটটা বুকের ভেতর ঢুকে জিজ্ঞেস করে, দাদি, তুমার কিতা অইছে?
কুনতা নায় রে বইন। বুকুত বিষ।
নাতনি বলে, ডাকতরো যাও।
যাইমু রে জাদু।
দু’হাতে দুটোকে জড়িয়ে ধরেন। বুক ফেটে কান্না আসে। ইচ্ছে করে বউটাকে, নাতনি দুটোকে বুকে চেপে বিলাপ করে কাঁদেন। ছেলে বলেছে, সাবধান মা, বিএসএফ যদি ঘুণাক্ষরে টের পায় তুমি ইন্ডিয়ার মানুষ হয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্টে আমেরিকা যাচ্ছ, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ফোঁস করে ওঠেন সাহারা। কে চায় তোদের আমেরিকা? হিনো গিয়া কার গু ফালাইতাম? ছেলেমেয়েরা বোঝায়, মা তুমি গিয়ে সিটিজেন হলে আমরা সবাই যেতে পারব। আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কত ভালো হবে বলো দেখি।
লাগা গ্রামের জমশির আলিকে খবর পাঠান। ছুটে আসে সে। বলেন, আমার বিনা পাসপোর্টে বাংলাদেশ যেতে হবে। তোমার ছেলেকে আসতে বলিয়ো। কেউ যেন না জানে। জমশির আলি লক্ষ্মীর বাজারে তরিতরকারি বিক্রি করে। কোনো কোনো বাজার বারে তার ফিরতে রাত হয়ে যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে চৌধুরীবাড়ির টঙ্গিতে আশ্রয় নেয় সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বদনা হারিকেন এসে যায়। আটটা-নটার মধ্যে দুতিন পদের ব্যঞ্জনসহ গরম ভাত।
বাদলকে সাবধান করে দেয় জমশির, বিবির কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নিবি না, খবরদার। বর্ডারে কাঁটাতারের বেড়ার পাশে চেকপোস্টে বিএসএফ জওয়ানদের ফুটফরমাশ খাটে বাদল। রাতের অন্ধকারে দেখা করতে আসে চৌধুরীবাড়িতে। দিনক্ষণ ঠিক করে। কীভাবে কী করতে হবে সব শিখিয়ে দিয়ে যায়। শেফালি আর আর্জিনা নামের দুজন মহিলা তাকে পার হতে সাহায্য করবে। জোর করে ওর হাতে হাজার তিনেক রুপি গুঁজে দেন সাহারা খাতুন। বলেন কাজ শেষে বাকি টাকা। ফ্রি কাজে বিশ্বাস নেই তার। বাড়িভরা কাজের মানুষ। কেউ রান্নাঘরে, কেউ হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়ে, কেউ গোয়ালঘরে কাজ করে। সবজির বিছরায় খোঁড়াখুঁড়ি করে কেউ। এদের মাঝে গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে ঘুরে বেড়ান তিনি।
সকালবেলা কাজে যাবার আগে তার ঘরে আসে ছেলে। টুক করে সালাম করেই বেরিয়ে যায় চোখমুখ স্বাভাবিক থাকতে থাকতে। নাতনিরা ইস্কুলে চলে গেলে আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বের হন সাহারা। হাতে ঝোলানো শাড়ি গামছা। বউটার বুকের এক পাশ হঠাৎ যেন ফাঁকা হয়ে যায়। মেঘের মতো একটা ছায়া যেন সরে যাচ্ছে মাথার ওপর থেকে। তবু কাঁদা যাবে না। জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সুপারি বাগানের ফাঁক দিয়ে যতক্ষণ দেখা যায়। একসময় সাদা একটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যান সাহারা খাতুন। একবস্ত্রে। হয়তো চিরকালের জন্য।
মাস দুয়েক আগে ঢাকার আমেরিকান এমবাসিতে গিয়েছিলেন ইন্টারভিউ দিতে। তার আগে ছোট ভাইটা বাংলাদেশি পাসপোর্ট করিয়ে দিয়েছে। সেই সময় এক স্যুটকেস কাপড় রেখে এসেছেন পিত্রালয়ে। সংগ্রামের কয়েক বছর আগে বাপ-চাচারা হিন্দুদের সঙ্গে বাড়িবদল করে ওপারে চলে গেছেন সবাই। শ্বশুরবাড়িতে একা সাহারা খাতুন। স্বামী মারা গেছেন সেই কবে। সাত মেয়ে তার। এখানে মুসলমান দামান্দ পাওয়া মুশকিল। দুটিকে কোনোমতে বিয়ে দিতে পেরেছিলেন। বাকিগুলোকে ভাইয়েরা ওপারে নিয়ে বিয়ে দিয়েছে। তিনটি সিলেটে আর দুটি আমেরিকায়। এখানে ছেলে, বউ, দুই নাতনি নিয়ে বিরাট বাড়ি আগলে পড়ে আছেন তিনি। এলাকায় হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্বের মাঝে গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচন এগিয়ে এলে সাহারা খাতুনকে নির্বাচনে দাঁড়াবার জন্য ধরে পড়ে গ্রামের মুসলমান কেষ্টবিষ্টুরা। চৌধুরীরা তাদের ঐক্যের প্রতীক। ছয়-সাত ক্লাস পড়া চিরকালের মিতবাক সাহারা খাতুন রাজনীতির কিছুই বোঝেন না। ইলেকশনে দাঁড়াবার তো প্রশ্নই ওঠে না। এককথায় না করে দেন। কিন্তু নানা রকম যোগ-বিয়োগ যুক্তিতর্ক মিনতির কাছে হার মানেন শেষে। ছেলে বলে ভয় কী মা, আমি তো আছি। বিপুল উদ্যমে প্রচারাভিযান চলে। তার ছবিওয়ালা পোস্টারে ছেয়ে যায় আশপাশের অঞ্চল। মাত্র ৪ ভোটের ব্যবধানে সুবল দাসের কাছে হেরে যান সাহারা খাতুন। বিশ্বাসঘাতক মুসলমান ভোটার চারজন শনাক্ত হয় দ্রুতই। কিন্তু সাহারার মনে হয় বাঁচা গেল যাক। আত্মীয় পুরুষদের সঙ্গেই কথা বলতে স্বস্তিবোধ করেন না তিনি, আর এ তো গ্রাম পঞ্চায়েত। বাবাকে দেখেছেন গ্রাম পঞ্চায়েতের সভাপতি ছিলেন যখন, দিন নেই রাত নেই বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা। চা বানাতে বানাতে, পান তামাক দিতে দিতে বিরক্তি চরমে উঠত।
কুশিয়ারার পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় চেকপোস্টটা চোখে পড়ে। এ সময় তাদের টি ব্রেক। কিছু সময়ের জন্য তখন গেটে থাকে বাদল। শেফালি আর আর্জিনা সস্তা ভারতীয় প্রিন্টের শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ, সিটিগোল্ডের গয়না এইসব ওপারে নিয়ে বিক্রি করে। বেচাবিক্রি শেষে সন্ধ্যায় ফিরে আসে। ওদের পাসপোর্ট নেই। গরিব মানুষ। নানা রকম রং-তামাশা করে বিএসএফ জওয়ানদের ভাই দাদা ডেকে বহু কষ্টে একবেলার জন্য একটা টোকা সংগ্রহ করে। তাও মাসে দুমাসে একবার। সন্ধ্যায় সেটা জমা দিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। সারা দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে জিনিস বিক্রি করে ওরা। কপাল ভালো থাকলে কোনো দিন চারটে ভাত জুটে যায়। নইলে দোকানের বনরুটিই ভরসা। এরই মাঝে ওরা শোনে গরিব মহিলাদের জন্য একটা ব্যাংক খুলেছে কে একজন। বিনা জামানতে টাকা ধার নিয়ে হাঁস মুরগি ছাগল পালন করে দিব্যি পেট চালাচ্ছে গ্রামের মহিলারা। আবার ঋণের টাকাও শোধ করে দিচ্ছে প্রতি সপ্তাহে।
শুনে আফসোস করে শেফালি। হায় রে হায়, কাটার বেড়খান যুদি না থাকত, তে মুই ইনুস ঠাকুরর বেংক তনে টেকা করয লইয়া ঘরো বইয়াউ আস মুরুগ বখরি পালিলাম অনে। কুকুরর লাখান ই জিন্দেগি আর ভালা লাগে না।
দূর থেকে মাইজিকে দেখেই তৎপর হয়ে ওঠে ওরা। বড় ভালা মানুষ বিচারি। বহুকালের পুরোনো টঙ্গিঘর নতুন করে ঠিকঠাক করিয়েছেন কিছুদিন আগে। একটা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গ্রামের শিশু ও সন্তানসম্ভবা মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। এ ছাড়া পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের জন্য এসব মায়েদের প্রতি মাসে পাঁচশ রুপি করে দিয়ে থাকে। তারা সাহারা খাতুনের কাছে গিয়েছিল টঙ্গির একটা কামরা ভাড়া দেবার অনুরোধ নিয়ে। মাইজি বিনা ভাড়ায় একটা কামরার চাবি দিয়ে দিলেন ওদের হাতে। বললেন, গাউর মানষর দওয়াই করতায় তুমরা, আর আমি লইতাম নি ভাড়া? হুরইন দি মারো (ঝাঁটা মারো)। শেফালি আর্জিনারা কখনো কাছে ঘেঁষার সুযোগ পায়নি। আজ যদি কোনো কাজে আসা যায়। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বাদল দুই হাত শূন্যে তুলে আঙুলগুলো বাংলাদেশের দিকে ওঠাতে নামাতে থাকে। শেফালি আর্জিনা পরিচিত বুঙ্গা শিকারি কিছু মহিলাকে চেকিং টেবিলের সামনে এগিয়ে দিয়ে পেছনে জোর হইহল্লা করতে থাকে। দ্রুত চেকপোস্ট পেরিয়ে যান সাহারা খাতুন। ইঙ্গিতে বাদল বলে, একটু দূরের বাড়িটায় গিয়ে অপেক্ষা করতে।
অচিন বাড়ির টঙ্গির বারিন্দায় কাঠের বেরেঞ্চিতে বসে ধুঁকতে থাকেন তিনি। ছোটখাটো একটা ভিড় জমে যায় চারপাশে। কই তনে আইছইন গো? উদ্দেশ্যহীনভাবে তিনি বলেন, হউ হবায় তনে। তার গম্ভীর বাক্যালাপে অনীহ মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বাড়ায় না কেউ। ভটভট করে একটা ফোরস্ট্রোক এসে থামে। ড্রাইভারের পাশ থেকে লাফ দিয়ে নামে বাদল। পেছন থেকে শেফালি। উটি যাউক্কা মাইজি। ডাইবাররে আড়াইশটা টেকা দিলাইবা। আর দুয়া করবা আমরার লাগি। সোপকেস থেকে দু’হাজার রুপি বাদলকে আর পাঁচশ করে দুই মহিলাকে দিয়ে তাদের মাঝখানে উঠে বসেন তিনি। ফোরস্ট্রোক ছুটে চলে। উজ্জ্বল রোদে ভরা দুপুরে বাপের বাড়ির উঠানে এসে থামে সাহারা খাতুনের বাহন। ভাইয়ের বউ বেরিয়ে আসে। এ, বুবু আইচ্চইন নি। ভাড়া চুকিয়ে নামতে নামতে বিলাপ করে কেঁদে ওঠেন সাহারা। অয় গো। হকলতা কুইয়ারার পানিত ডুবাই দি আইল্লাম। ভরদুপুরে নিঃসীম নীরবতা নেমে আসে উঠানে সারা বাড়িতে। ফোঁপাচ্ছেন সাহারা। কুশিয়ারার বুকের কুয়াশা কেটে কালো রাস্তাটা জেগে উঠছে আস্তে আস্তে। সিলেট সুতারকান্দি লাইনের মুড়ির টিন বাসের আদলের হলুদ ঢাউস একটা স্কুলবাস এসে থামে বাড়ির সামনে। নাতির ছুটি হয়ে গেছে। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ান তিনি, নইলে জেরায় জেরায় জেরবার হতে হবে।
-নিউইয়র্ক, ৩০ নভেম্বর ২০২২