কামরুল হোসেন লিটু
মো. নজরুল ইসলাম ছাত্র হিসেবে অনেক ভালো, ক্লাস ফাইভ ও এইটে বৃত্তি পেয়েছিল। এসএসসিতে স্টার মার্কস নিয়ে পাস করলেও এইচএসসিতে আশানুরূপ রেজাল্ট করতে পারেনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যে জন্য পড়ালেখায় ভাটা পড়ে। রসায়নে অনার্স পড়ছে এখন, রেজাল্ট ভালো করার ইচ্ছা থাকলেও রাজনৈতিক কারণে পড়ালেখায় প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারে না।
নজরুলের আব্বা মো. শহিদুল ইসলাম সাহেব এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তিনি রাজনীতি করেন না, তবে সব দলকে হাতে রাখার জন্য যা করার দরকার, সেটা করেন। মূলত তিনি ঝানু ব্যবসায়ী। সামাজিক-রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক দিক শহিদুল সাহেব অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে সামাল দিতে পারলেও নিজের ছেলে নজরুলকে তিনি তার নির্দেশিত পথে চালাতে পারেন না। তবে তার অন্য দুই সন্তান-নজরুলের বড় ফারিয়া ইসলাম আর সবার ছোট মো. এনামুল ইসলামÑপিতার একান্ত অনুগত।
এলাকার বেশির ভাগ রাজনৈতিক গ্যাঞ্জাম-ফ্যাসাদে নজরুল জড়িয়ে যায় বা জড়িয়ে থাকে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মাঝেমধ্যে বিপরীত দলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। অধিকাংশ সময়েই সেটা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে শেষ হয়, কিন্তু গতকালের ঘটনায় একজনের মর্মান্তিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়, যদিও হত্যাকাণ্ডটা টার্গেটেড ছিল না, ইট-পাটকেল নিক্ষেপের মাঝে পড়ে ওই ব্যক্তির মাথার পেছনে ইটের আঘাতের কারণে তার মৃত্যু হয়।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এই খুনের মামলায় নজরুলের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। যদিও ওইদিন এবং ওই সময়কালে নজরুল এলাকায় ছিল না। রাজনৈতিক একাধিক মামলায় নজরুলের নাম আছে, তারই একটা মামলায় জামিনের জন্য সে তখন ছিল ঢাকার হাইকোর্টে।
শিশুকাল থেকেই নজরুল অত্যন্ত দুরন্ত। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি, মানুষের গাছের ফল চুরিসহ নানা রকম দুষ্টুমি করে তার প্রাইমারি আর মাধ্যমিক স্কুলজীবন শেষ করেছে। কলেজে উঠে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ালেখায় যেমন অধঃপতন হয়েছে, তেমনি মামলা-মোকদ্দমায় হচ্ছে নাজেহাল।
শহিদুল সাহেব তার এই ছেলের জন্য সব সময় মানসিক অশান্তিতে থাকেন, তার জীবনে ছেলে নজরুলই একমাত্র এবং বড় সমস্যা। শহিদুল সাহেবের আত্মীয়রা সরকারি ও বেসরকারি বড় বড় অবস্থানে থাকলেও তিনি সহসা কারও দ্বারস্থ হন না। কিন্তু এবার নজরুলকে খুনের মামলা থেকে নিষ্কৃতি দিতে তিনি আত্মীয়ের সহযোগিতা নেন। বস্তুত এই গন্ডগোলের সময় নজরুল ঢাকার উচ্চ আদালতে থাকায় সহজেই তার প্রমাণপত্র জোগাড়ের মাধ্যমে সে মামলার চার্জশিট থেকে অব্যাহতি পায়।
নজরুলকে নিয়ে পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে এবং নজরুলের জীবননাশের আশঙ্কায় তার আব্বা-আম্মা সিদ্ধান্ত নেন, যে করেই হোক ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন। নজরুল মোটামুটি মেধাবী হওয়ায় এবং তার ব্যবসায়ী আব্বার ব্যাংক ব্যালেন্স ও ট্রানজেকশন খুব ভালো থাকায় কয়েক মাসের চেষ্টায় সে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির একটা প্রাইভেট কলেজে সহজেই ভর্তি হয়ে যায়।
বিত্তবৈভবের ভেতর বড় হওয়া নজরুল যথেষ্ট মিতব্যয়ী, অযথা টাকা-পয়সা খরচ সে করে না। তার তেমন কোনো নেশাও নাই, মাঝেমধ্যে চা পান ছাড়া। ভালো খাবার আর দামি পোশাকের জন্য খরচ করতে উদার কিন্তু কাউকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করা বা ধার দেওয়ার ব্যাপারে সে পুরোপুরি উদাস!
সিডনি সিবিডি (central business district) তথা ডাউন টাউনের কাছেই ‘রেডফান’ এ ২৭ মোর হেড স্ট্রিটের দুই বেডরুমের মেস বাসায় নজরুল উঠল অন্য ছাত্র রুমমেটদের সঙ্গে। কিন্তু রান্না করা নিয়ে ভীষণ মুশকিলে পড়ে গেল নজরুল। অন্য রুমমেটরা কাজ এবং ক্লাসের ব্যস্ততার জন্য যে যার মতো রান্না করে খাওয়ার কাজ সেরে ফেলে। পালা করে একেকজন রান্না করার নিয়ম থাকলেও কাজ ও ক্লাসের সময় ভিন্নতার কারণে রান্নার অনিয়মের জন্য যে যার মতো রান্না বা খাবার জোগাড় করে নেয়।
বাংলাদেশে নজরুল এক গ্লাস পানিও ঢেলে খায়নি, বলা যায়। অস্ট্রেলিয়ায় এসে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া অর্থাৎ ক্রয়-কাটাকুটি-ধোয়া ও রান্না করা তার কাছে বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম দিকে পিৎজা-ম্যাক খেয়ে আর কাছেধারের বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে গিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করলেও রান্নায় তাকে হাতেখড়ি নিতেই হয়। ভাত-ডাল, আলুভর্তা, ডিমভাজা/সেদ্ধ-এই তার রান্নাবান্নার শুরু।
ক্রমান্বয়ে প্রবাসের জীবনধারার সঙ্গে নজরুল সমন্বয় করে ফেলে। সপ্তাহ-মাস-বছর এভাবে সাড়ে চার বছর কেটে যায়। আইটিতে গ্র্যাজুয়েশন করায় সহজেই অস্ট্রেলিয়ার পিআর (permanent residency) পেয়ে যায় নজরুল। প্রথমে বছরখানেক দেশ থেকে টাকা আনলেও পরবর্তী সময়ে তার আর দরকার হয়নি। নজরুলের তেমন কোনো সেভিংস নেই, আয়-ব্যয় সমান সমান। ওর কোনো দায় নেই, দেনাও নেই। বাংলাদেশে ফোন করলে নজরুলের আম্মা ইদানীং বলেন দেশে চলে আয়, তোর জন্য মেয়ে দেখছি...
অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর কয়েকটা বছর কত দ্রুত চলে গেল, কাজ-পড়ালেখা ইত্যাদিতে। এখন দেশে যেতে গেলে ক্রেডিট কার্ড ইউজ করে টিকিট কিনতে হবে। নজরুল দেনা হতে রাজি নয়। সে ভাবল, পড়াশোনার চাপ যেহেতু নেই, তাহলে ফুলটাইম কাজ করে কিছু ডলার জমিয়ে ফেলার।
নজরুল তার জীবনে কখনো অর্থকষ্টে ভোগেনি। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর তাই ডলার জমানোর চিন্তা তার ছিল না। যা আয় করেছে সেটাই ভোগবিলাসে খরচ করেছে।
১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর থেকে গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন রকম কাজ করেছে নজরুল। টেকঅ্যাওয়ে শপ থেকে ফাইভ স্টার হোটেল পর্যন্ত। সবাই বলে ট্যাক্সি চালালে ভালো পয়সা, তাই এবার সে ট্যাক্সি চালানোর সিদ্ধান্ত নিল। অল্প সময়ের মধ্যেই ট্যাক্সি লাইসেন্স পেয়ে ট্যাক্সি চালানো শুরু করল নজরুল।
গত পাঁচ বছরে নানা রকম কাজ করেছে কিন্তু এত আয় আর কোনো পেশায় সে করতে পারেনি। ডলারের নেশায় পেয়ে বসল তাকে এবং সে প্রতিদিনই কাজ করতে লাগল। সপ্তাহ-মাস-বছর পেরিয়ে নজরুলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে প্রচুর ডলার জমা হয়ে গেল।
অর্থের নেশা অসীম, মানুষ সেই অসীমের পেছনেই ছোটে। নজরুলও তার ব্যতিক্রম হলো না। প্রকৃতির নিয়মেই সবকিছুর একসময় ছন্দপতন হয়। একদিন বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না নজরুল। রুমমেটরা ধরাধরি করে ওঠাল, অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হসপিটালে নিয়ে গেল এবং দুই দিন পরই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় ফিরে এল। দীর্ঘক্ষণ ড্রাইভিং করার কারণ ছাড়াও পায়ে হাঁটা একদমই না করায় তার কোমরে সমস্যা দেখা দিয়েছে, পেট মোটা হয়ে গেছে, ওজন বেড়ে গেছে। হসপিটালে অনেকগুলো টেস্ট করা হয়েছে, কিছুর রেজাল্ট পাওয়া গেছে, বাকিগুলো সপ্তাহখানেকের মধ্যে পাওয়া যাবে। ডাক্তার স্বাস্থ্যকর খাবারসহ নিয়মিত ব্যায়াম করা, বিশেষ করে প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা হাঁটার জন্য বলেছে।
নজরুল ব্যাপারটাকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে ডলারের নেশায় আবার পূর্ণ উদ্যমে ট্যাক্সি চালানো শুরু করল। দু-তিন দিন পর হসপিটাল থেকে একটা চিঠি এল, যার মর্মার্থ সংযুক্ত মেডিকেল রিপোর্টটা নিয়ে ইমিডিয়েটলি প্রাইমারি ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। হসপিটালের চিঠিটা নিয়ে পরদিনই নজরুল তার প্রাইমারি ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার রিপোর্টের সব কাগজপত্র দেখে গম্ভীর ও চিন্তিত হয়ে বলল, আপনার ব্রেন টিউমার হয়েছে এবং ওই টিউমারে ক্যানসারের লক্ষণ আছে। ফলে যত দ্রুত সম্ভব হসপিটালে অপারেশনের জন্য ভর্তি হতে হবে।
মন ভীষণ খারাপ করে বাসায় ফিরল নজরুল। সাত-আট মাস আগে অ্যাশফিল্ডের এই বাসায় উঠেছে সে, দুপুর ১২টার মতো বাজে, এ সময় বাসায় কেউ থাকে না, মূলত যে যার কাজে চলে যায়। নিরিবিলি বাসায় শুয়ে থেকে ঘুম আসে না, কোথাও যেতেও ইচ্ছে করছে না। বহুবিদ ভাবনা-চিন্তা শেষে নজরুল সিদ্ধান্ত নিল, যে কদিন বাঁচবে আনন্দের সঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করবে। আর সপ্তাহ দুয়ের জন্য বাংলাদেশে যাবে, আব্বা-আম্মা, ভাইবোনের সঙ্গে দেখা করে এসে তবেই হসপিটালে অপারেশনের জন্য ভর্তি হবে।
এ অবস্থায় কেউ কাজে যেতে পারে না, নজরুল কাজে গেল। মূলত কাজে ব্যস্ত থাকলে দুশ্চিন্তা দূরে থাকবে। সিডনি এয়ারপোর্ট থেকে দুটো বড় লাগেজ, হাতে ব্রিফকেস নিয়ে একজন ৫৯-৬০ বছর বয়সের ভদ্রলোক নজরুলের ট্যাক্সিতে উঠলেন, ‘মারুবরা’ যাবেন। তিনি এসেছেন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ‘পার্থ’ থেকে। যাত্রাপথে টুকটাক কথাবার্তায় জানা গেল, উনি ব্যবসায়ী, ওনার নাম ‘ডেভিড’।
মারুবরায় ওনার বাসা ৪৮ কুপার স্ট্রিটে গাড়ি থামলে উনি নিজেই নিজের লাগেজ নামানোর কাজে লেগে গেলেন। ডেভিডকে নামিয়ে সন্ধ্যারাতের নিরিবিলি রাস্তায় চলতে চলতে নজরুল একটা কফিশপে নেমে এক কাপ কফি নিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসতে গিয়ে দেখল, পেছনের সিটে যেখানে ডেভিড বসেছিলেন, সেখানে ছোট একটা ব্রিফকেস পড়ে আছে। সন্দেহাতীতভাবেই বোঝা গেল, ওটা ডেভিডের। কফিটা শেষ করে নজরুল পেছনের সিট থেকে ব্রিফকেসটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল, খুব বেশি ভারী নয়। কৌতূহল মানুষের সব সময় থাকেই। নজরুল বিভিন্নভাবে নাম্বারিং লক খোলার চেষ্টা করতে লাগল, ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় ৭৪২১ এই নম্বরে এসে লক খুলে গেল। সন্তর্পণে ব্রিফকেস খুলে দেখা গেল, ভেতরে ব্যবসায়িক কাগজপত্রসহ ৫০ ডলারের বান্ডিলে ভরা ব্রিফকেস। প্রতিটা বান্ডিলে ১০০ পিস করে ৫০ ডলারের ৫০টা বান্ডিল আছে, তার মানে আড়াই লাখ ডলার। এক অজি ডলারে বাংলা টাকা তখন ৪০, তাহলে আড়াই লাখ ডলারে... এসব চিন্তা-ভাবনায় ওই মুহূর্তে নজরুলের মৃত্যুচিন্তা হারিয়ে গিয়েছিল।
এই ব্রিফকেস ফেরত না দিলেও ডেভিড নজরুলকে ধরতে পারবেন না, কারণ তখন ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া দেওয়া যেত না। ফলে নজরুলকে চিহ্নিত করা কঠিন। এ ছাড়া দু-তিনটা অজুহাতে নজরুল ওটা আত্মসাৎ করতে পারে। নজরুলের আশা অস্ট্রেলিয়ার উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার কারণে সে ভালো হয়ে যাবে। তবু মৃত্যু তো একদিন হবেই মনে করে সে ব্রিফকেসটা ডেভিডকে ফিরিয়ে দিতে ৪৮ কুপার স্ট্রিট মারুবরার দিকে গাড়ি ঘোরাল।
ডেভিডের বাসার সামনে গাড়ি পার্ক করে হর্ন দিতেই হন্তদন্ত হয়ে ডেভিড বেরিয়ে এলেন। কোনো কথা বলার আগেই নজরুল ডেভিডকে ব্রিফকেসটা এগিয়ে দিল। ডেভিড ব্রিফকেসটা নেওয়ার আগেই নজরুলকে জড়িয়ে ধরলেন। সাধারণত অস্ট্রেলিয়ায় একজন পুরুষ মানুষ আরেকজন পুরুষ মানুষকে জড়িয়ে ধরে না, তাহলে অন্যরা তাদের পোপতা মনে করে, যার অর্থ তারা ‘গে’।
আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে ডেভিড বললেন, তুমি কি জানো এই ব্রিফকেসে কত ডলার আছে? নজরুল বলল, টু হানড্রেড ফিফটি থাউজেন্ড। নজরুলের উত্তর শুনে ডেভিড বিস্ময়ের চোখে তাকে দেখলেন। ডেভিড তার আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন, আমি সারা জীবন কালোদের ঘৃণার চোখে দেখেছি (অস্ট্রেলিয়ান সাদাদের কাছে বাংলার ফরসাও রীতিমতো কালো)। আজ আমার সেই ঘৃণার চোখ ভালোবাসায় পরিণত হলো, গড ব্লেস ইউ। নজরুল ডেভিডের উচ্ছ্বাস-আবেগ-বিস্ময় এবং ডলার ফিরে পাওয়ার আনন্দ দেখে এক অন্য রকম সুখানুভূতি অনুভব করল। এ ধরনের অনুভূতি ও ভালো লাগা সে জীবনে কখনো পায়নি। একটা ভিন্ন রকম শান্তি তার সারা শরীরে প্রবাহিত হলো। নজরুলের মনে হলো, এ জন্যই কবি লিখেছেন, পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও, তার মত সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও!
প্রায় ছয় বছর পর বাংলাদেশে ফিরে নজরুলের খুব ভালো লাগছে। বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা, কথাবার্তার মজাটা সবকিছু থেকে আলাদা। যদিও তার ব্রেন টিউমারের দুশ্চিন্তা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নজরুলের বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল ওর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরপরই। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ফারিহার সুখের সংসার। নজরুলের আম্মা এবার নজরুলের বিয়ের ব্যাপারে জোর তৎপরতা শুরু করেছেন, যদিও নজরুল তার আম্মা-আব্বাকে তার অসুস্থতার কথা জানায়নি। কারণ, সে ১০-১২ দিন পরিবারের সঙ্গে আনন্দে কাটাতে এসেছে। বিয়ের বিষয়ে আব্বা-আম্মার পীড়াপীড়ির জবাবে বলে, নেক্সট ইয়ার কনফার্ম সে বিয়ে করবে। কারণ, এবার সিডনি ফিরে সে ভালো একটা জবের জন্য চেষ্টা করবে এবং তার বিশ্বাস, সে যদি সিডনির বাইরে যায়, তবে সে তার মনের মতো জব পাবে।
মাত্র কয়েক দিনের জন্য বাংলাদেশে এসেছে নজরুল। এ জন্য সে আসার পথে বিমানেই তার প্রতিদিনের কাজের পরিকল্পনা করেছিল। সে মোতাবেক প্রতি সকালে বাসায় নাশতা সেরে মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে যায়। সে খুঁজে খুঁজে বের করে তার দরিদ্র বন্ধু, আত্মীয়দের এবং নানাবিধ গল্পগুজবের মাধ্যমে তাদের দীনতা, দুর্বলতা, প্রয়োজনীয়তা জেনে নিয়ে কঠোর গোপনীয়তার শর্তে আর্থিক সহযোগিতা করে। প্রতিটি ক্ষেত্রে গ্রহীতার যে অবর্ণনীয় খুশির অভিব্যক্তি, সেটা নজরুলের মনে দারুণ প্রশান্তি এনে দেয়। এই উপলব্ধি কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
মরণব্যাধি শরীরে নিয়ে কয়েকটা দিন-রাত দেশে বেড়িয়ে বিভিন্ন দুস্থকে সাধ্যমতো সাহায্য করার ফলে নজরুলের মানসিক জগতে একটা অপার্থিব শিহরণ বয়ে যায়। যে নজরুল আজীবন সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও কখনো কোনো দরিদ্র, দুস্থকে দশ পয়সাও দেয়নি, সে এখন তার সমস্তটা উজাড় করে দিতে চায়।
বাংলাদেশ থেকে সিডনি ফেরার পরদিন ব্রেন টিউমারের অপারেশন-সংক্রান্ত বিষয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে নজরুলের মনে হলো তার সমস্যাটা মাঝায় এবং ওজন বেশি হওয়া সংক্রান্ত, তাহলে ব্রেন টিউমার হলো কী কারণে? যাহোক হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট শাখায় গিয়ে তার যাবতীয় তথ্য দেওয়ার পর ওই বিভাগের দায়িত্বরত ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে নজরুলের সন্দেহের কথা জানাল। দায়িত্বরত ভদ্রমহিলা তার কথা শুনে সব কাগজপত্র পুনরায় পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখে একটা ছোট অথচ ব্যতিক্রমী ভুল আবিষ্কার করল।
ভুলটা হলো নজরুল অ্যাশফিল্ডের যে বাসায় থাকে, ওই বাসায় আরেকজন মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম নামের ব্যক্তি ছিলেন, যিনি এখন ওই বাসায় থাকেন না (উল্লেখ্য, বাংলাদেশি ছাত্র, বিশেষ করে ব্যাচেলররা বাসা ভাড়া নিয়ে ম্যাচ করে একত্রে থাকে, এদের মধ্যে কেউ কোনো কারণে বাসা ছাড়লে নতুন রুমমেট নেওয়া হয় যারা সব সময় বাংলাদেশি হয়)। আর অস্ট্রেলিয়ায় ফার্স্ট নেম ও লাস্ট নেম চিঠিপত্রে উল্লেখ থাকে, যেমন মো. নজরুল ইসলামকে চিঠি পাঠানো হবে মো. ইসলাম নামে। এমনিতে বাংলাদেশে হাজার হাজার মো. নজরুল ইসলাম আছে, ফলে এই নামের কারণে ভ্রান্তি ছাড়াও জন্মতারিখেও গোলমাল হয়েছিল। আগের মো. নজরুল ইসলামের জন্মতারিখ ০১-১১-১৯৭৭ আর বর্তমান মো, নজরুল ইসলামের জন্মতারিখ ১১-০১-১৯৭৭। তবে আগের নজরুল বাসা পাল্টানোর কয়েক মাস পর কেন তার মেডিকেল রিপোর্ট পূর্বের বাসায় পাঠানো হলো? মূলত মেডিকেল রিপোর্ট এবং চিঠি প্রিন্ট করার জন্য মাউসটা অসাবধানতাবশত ভুল স্থানে ক্লিক হওয়া...!
মুহূর্তেই নজরুলের চিন্তা তথা মনোজগতের কেন্দ্র থেকে হাজার টনের দুশ্চিন্তার বোঝা নেমে গেল। একটা অন্য রকম স্বস্তি ও প্রশান্তি অনুভব করল সে।
হাসপাতালের পার্কিং লটে পার্ক করা গাড়িতে বসে নজরুল বিভিন্ন ভাবনায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেল। মেডিকেল রিপোর্টের এই ভ্রান্তি তাকে এক নতুন মানুষে রূপান্তরিত করল। অর্থ অর্জন করে সেই অর্থে সম্পদ গড়ার নিরন্তর যে প্রতিযোগিতা মানুষের ভেতর এবং এই প্রক্রিয়ায় যে তৃপ্তি তার থেকে বহু বহু গুণ তৃপ্তি সৎ জীবনযাপন আর পরার্থে সহযোগী হওয়ায়। তৃপ্তি ও প্রশান্তির এই স্বর্গীয় অনুভূতি সরাসরি পরোপকারে সক্রিয় না হলে তা কারও বোধে আসা অসম্ভব।