মাহমুদ আহমদ
আল্লাহ পাকের নির্দেশে তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ বছরে দুটি ঈদ উদ্্যাপন করে থাকে। ঈদুল আজহা আত্মোপলব্ধি, তাকওয়া এবং মহান কোরবানির শিক্ষা নিয়ে উপস্থিত হয়। মুসলিম জাহান হজরত ইবরাহিম (আ.) এর অসাধারণ ত্যাগের প্রেরণাকে উপলব্ধি করে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে কোরবানির ত্যাগের মধ্য দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে বান্দা তার অতীতের সকল কর্মকাণ্ডের ভুলভ্রান্তির ক্ষমা চেয়ে পরবর্তী জীবনে এ প্রশিক্ষণলব্ধ আমলে সালেহকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলার অঙ্গীকারে প্রত্যয়ী হওয়ার এক সফল অনুষ্ঠান এ পবিত্র ঈদুল আজহা।
ইসলাম ধর্ম বিকশিত হওয়ার বহু পূর্ব হতেই মর্ত্যবাসীর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মের অনুসারীরা নানা ভাব ও ভঙ্গিতে ঈদ পালন করত। কিন্তু তাদের ঈদের নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষা বা রীতিনীতি ছিল না। একমাত্র ইসলাম ধর্মে ঈদকে সর্বজনীনরূপে রূপায়ণ করা হয়েছে। ইসলামে এই যে ঈদ পালন করা হয়ে থাকে, এর আসলে অর্থ কী? বা কোন শব্দ থেকে এর উৎপত্তি তাও আমাদের জানা উচিত। ‘ঈদ’ শব্দটি ‘আওদ’ শব্দ হতে সৃষ্টি হয়েছে। ঈদ অর্থ আনন্দ, আমোদ, আহ্লাদ, উৎসব ইত্যাদি।
‘আওদ’ অর্থ ফিরে আসা, বারবার আসা। অতএব, যে আনন্দ বা উৎসব বিশ্ববাসীর মাঝে বারবার ফিরে আসে, তাকেই ঈদ বলা হয়। ঈদ নামকরণটি আমরা হজরত রাসুল করিম (সা.) এর কাছ থেকেই পাই। ‘ঈদ’ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে। একটি হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুল করিম (সা.) মদিনায় উপস্থিত হয়ে দেখতে পান, সেখানকার অধিবাসীরা বছরে দুটি দিনে (পয়মুক ও মিহিরজান) খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব করে থাকে। হুজুর (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি কিসের দিন? সাহাবায়ে কেরাম (রা.) উত্তর দিলেন, জাহেলিয়াতের যুগে আমরাও এ দুটি দিনে খেলাধুলা ও উৎসব পালন করতাম। হুজুর (সা.) এ কথা শুনে বললেন, ‘আল্লাহ পাক তোমাদেরকে এ দুই দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি উত্তম দিন প্রদান করেছেন। তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)।
ঈদুল আজহা হলো বড় ঈদ। ‘ঈদুল আজহা’ নাম রাখার কারণ হলো এটি কোরবানির ঈদ। এই ঈদ জিলহজ মাসের ১০ তারিখ হজের ইবাদতের শেষে উপস্থিত হয় (হজ ৯ তারিখে হয়)। হজরত রাসুল করিম (সা.) এই ঈদকে ঈদুল আজহা বলেই উল্লেখ করেছেন। ‘আজহা’ শব্দ আরবি ভাষায় ‘আজহি’ শব্দের বহুবচন, যেমন ‘আজহি’ ‘আজহাতুল’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ হলো কোরবানির জন্তু। ইসলামি পরিভাষায় এর অপর নাম হলো ‘ইয়াউমুন-নাহর’। ‘নাহর’ অর্থও কোরবানির জন্তু। উভয় নামই স্বয়ং মহানবী (সা.) ব্যবহার করেছেন এবং হাদিসে বহুরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এই দুটি নাম ছাড়া এই দিনের জন্য হাদিসে অন্য কোনো নামই ব্যবহৃত হয়নি।
পবিত্র কোরআন শরিফে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে, হজ-সংক্রান্ত ইবাদত আরম্ভ হয় হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সময়ে (সুরা হজ)। হজরত ইবরাহিম (আ.) খোদা তায়ালার আদেশে তাঁর প্রথম পুত্র হজরত ইসমাইলকে জল ও বৃক্ষলতাশূন্য মক্কা উপত্যকায় এনে বাস করতে রেখে যান। সেখানে জীবনধারণের কিছুই ছিল না। প্রকৃতপক্ষে এটিই ইবরাহিম (আ.) এর ওই স্বপ্নের তাৎপর্য ছিল, যে স্বপ্নে তিনি দেখেছিলেন তিনি তাঁর পুত্রকে জবাই করছেন। তখন খোদা তায়ালা পুত্র কোরবানির স্থানে বাহ্যিকভাবে পশু কোরবানির আদেশ করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষ কোরবানিও কায়েম রইল। অন্য কথায় এটি ছিল ‘প্রথম মানুষ ওয়াক্ফ’, যা খোদার পথে উপস্থিত করা হয়েছিল, যাতে খোদা তায়ালা হজরত ইসমাইলকে তাঁর মৃত্যুর পর এক নব জীবন দিয়ে তাঁর বংশের বীজ বপন করেন। অবশেষে এই বীজ থেকে বিশ্ব ধর্ম বিধানের বাহক, শ্রেষ্ঠ আদমসন্তান নবী গৌরব হজরত মোহাম্মদ মুস্তফা (সা.) এর জন্ম হয়।
হজে কোরবানির প্রথা ইসমাইল (আ.) এর এই কোরবানির একটা বাহ্যিক আলামত, যা দ্বারা এই অতুলনীয় কোরবানির স্মৃতি চিরদিন জাগরূক থাকে। তার পবিত্র বংশ বাহ্যিক জলশূন্য, ঘাস তরুলতা-ফল-ফুল শূন্য মক্কা উপত্যকায় সেই অনুপম ফল উৎপাদন করল, যার ফুৎকারে পৃথিবীতে আধ্যাত্মিকতা সজীব হলো, সজীব আছে এবং চিরকাল থাকবে। এ জন্য মহানবী (সা.) বলতেন, ‘আমি দুই জবেহকৃত সত্ত্বার পুত্র।’ (তারিখুল খসিস)। এই দুই কোরবানির মধ্যে এক হলো ইসমাইলের দেহ, যাকে জলশূন্য, বৃক্ষ-লতাশূন্য মক্কা উপত্যকায় বাস করতে দেওয়া কার্যত জবেহ করারই শামিল। দ্বিতীয় ইসমাইলের রুহ, যা খোদার হুজুরে ধর্মোদ্দেশ্যে ওয়াকফ (উৎসর্গ) হয়ে কোরবান হয়েছিল।
ঈদুল আজহার কোরবানি পবিত্র কোরবানির স্মৃতিরক্ষক। কিন্তু এ যুগে আধ্যাত্মিক অবনতি এবং জড়োন্নতিতে মানুষ অশ্রু বর্ষণ করা তো দূরের কথা, আজ অধিকাংশ মুসলমান ঈদুল আজহা নামটি কেন হয়েছে, তাও স্মরণ করতে চায় না।
ঈদুল আজহার দিনে কোরবানি করার গুরুত্ব যে কত ব্যাপক, তার আলোচনা করা প্রয়োজন। সামর্থ্যহীন ও অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য কোরবানি ওয়াজিব না হলেও ক্ষমতাবান ও সামর্থ্যশালী ব্যক্তিদের জন্য ওয়াজিব। হজরত (সা.) ঈদুল আজহা উপলক্ষে নিজেও কোরবানি করতেন এবং তাঁর সাহাবিদেরও কোরবানি করার তাগিদ দিতেন। এ ব্যাপারে অগণিত দৃষ্টান্ত রয়েছে হাদিসে। যেমন হজরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) হিজরতের পর মদিনায় ১০ বছর যাপন করেন এবং তিনি প্রতিবছরই ঈদুল আজহা উপলক্ষে মদিনায় কোরবানি করতেন।’ (তিরমিজি)
শুধু তা-ই নয়, ঈদুল আজহার কোরবানির প্রতি তাঁর (সা.) এত দূর খেয়াল ছিল যে তিনি ওফাতের পূর্বে তাঁর জামাতা ও পিতৃব্য পুত্র হজরত আলি (রা.) কে অসিয়ত করেন, তার পরেও (ওফাতের পর) তার পক্ষে ঈদুল আজহা উপলক্ষে সর্বদা যেন কোরবানি করা হয়। হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হজরত হাবসা (রা.) বলেন, তিনি হজরত আলিকে দেখলেন ঈদুল আজহায় দুটি দুম্বা কোরবানি করছেন। তিনি হজরত আলিকে (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, দুই দুম্বার কারণ কী? হজরত আলি (রা.) বললেন, তাঁকে রাসুলুল্লাহ (সা.) অসিয়ত করেছেন, যেন তিনি তাঁর পক্ষে (তাঁর ওফাতের) পরেও কোরবানি করতে থাকেন। এ জন্য তিনি হজরত রাসুল (সা.) এর পক্ষে কোরবানি করেন।’ (আবু দাউদ)
ঈদুল আজহার দিন কোরবানি করা মহানবী (সা.) এর শুধু ব্যক্তিগত কর্মই ছিল না, বরং তিনি তার সাহাবিদেরকেও এর তাহরিক করতেন। হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হজরত বারা (রা.) রেওয়ায়েত করেন, মহানবী (সা.) ঈদুল আজহার দিন খুতবা দেন এবং বলেন যে এই দিন প্রথমে মানুষ ঈদের নামাজ পড়বে এবং তারপর কোরবানি করবে। সুতরাং যে এইরূপে কওে, সে তাঁর (সা.) সুন্নত লাভ করেছে।’ (বুখারি ও মুসলিম) আরেক স্থানে তিনি (সা.) বলেন, ‘যার আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানি করে না, সে কেন আমাদের ঈদগাহে এসে নামাজে শামিল হয়?’ (মুসনাদ আহমদ) হজরত রাসুল করিম (সা.) এর এই কথাকে সাহাবারা (রা.) খুব ভালোভাবেই স্মরণ রেখেছিলেন এবং সাধ্যমতো কোরবানি করতেন। রেওয়ায়েতে রয়েছে, জাবল ইবনে সহিম বলেন, একবার এক ব্যক্তি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঈদুল আজহার কোরবানি কি জরুরি? তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ নিজে কোরবানি করতেন এবং তার অনুবর্তিতারূপে সাহাবিগণও কোরবানি করতেন। ওই ব্যক্তি তার প্রশ্নটি পুনরুত্থাপনপূর্বক বললেন, কোরবানি কি ওয়াজিব? হজরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) বললেন, ‘তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারো না? আমি বলি যে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও কোরবানি করতেন এবং তাঁর (সা.) অনুবর্তিতায় অন্য মুসলমানরাও করতেন।’ (তিরমিজি)
হজরত রাসুল (সা.) এর এই কাজ শুধু ব্যক্তিগত শখ অথবা বন্ধুবান্ধব এবং দরিদ্রদের গোশত খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে নয় বরং তিনি একে একটি ধর্মীয় কাজ জ্ঞান করতেন এবং পুণ্যজনক মনে করতেন। যেমন হাদিসে বর্ণিত আছে, জায়েদ বিন আরকাম (রা.) বলেন, রাসুল করিম (সা.) এর সাহাবিরা (রা.) মহানবীকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! ঈদুল আজহার এই যে কোরবানি, এগুলো কেমন? হজরত রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমাদের প্রধান পূর্বপুরুষ ইবরাহিমের প্রবর্তিত রীতি (সুন্নত)।’
সাহাবিরা বললেন, তবে আমাদের জন্য এতে লাভ কী? তিনি বললেন, ‘কোরবানির জন্তুর প্রতিটি লোম কোরবানিকারীর জন্য একেকটি পুণ্য, যা তাকে খোদার কাছে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য করবে।’ (ইবনে মাজা) হজরত আয়েশা (রা.) রেওয়ায়েত করে বলেন, মহানবী (সা.) ঈদের কোরবানি সম্বন্ধে বলতেন, ‘খোদা তায়ালার দৃষ্টিতে ঈদুল আজহার দিন মানুষের কোনো কর্ম কোরবানির জন্তু জবেহ করা এবং তার রক্তপাত অপেক্ষা প্রিয়তর নেই।’ (তিরমিজি) উপরিউক্ত হাদিসগুলোর বরাতে আমরা প্রত্যেকেই বুঝতে পারছি, কোরবানির গুরুত্ব কত ব্যাপক। কোরবানির আদেশ রয়েছে বলে যেকোনো ধরনের পশু কোরবানি করলেই চলবে না। কোরবানির পশু নিখুঁত হওয়া চাই, এ ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।
এই যে কোরবানি, তা কি শুধু পশু কোরবানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি অন্য কিছুও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত? আসলে ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, মানুষ যেন কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে কোরবানি করে। হজরত ইবরাহিম (আ.) এর কোরবানি ছিল শুধু আল্লাহর জন্য। তাঁর উদ্দেশ্য একটাই ছিল আর তা হলো আল্লাহ পাকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যেন প্রেমময় হয় এবং আল্লাহ যেন তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নেন। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালাও তাঁর কোরবানি ও দোয়াকে গ্রহণ করে তাঁর বংশে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল প্রেরণ করে বিশ্বকে আবার প্রেমময় আল্লাহকে লাভ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তাই আমাদেরকেও হজরত ইবরাহিম (আ.) এর কোরবানির শিক্ষাকে নিজেদের অন্তরে ধারণ করে মহান আল্লাহ পাকের সঙ্গে গভীর এক ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করতে হবে। আর এই বন্ধন আমরা তখনই সৃষ্টি করতে পারব, যখন আমাদের আত্মা হবে পবিত্র। আমরা যদি আমাদের হৃদয়কে পবিত্র করি, তাহলে আমাদের সঙ্গে আল্লাহ পাকের প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কেননা আল্লাহ পাক নিজে পবিত্র, তাই তিনি পবিত্রময় আত্মার সন্ধানেই থাকেন। আমাদের হৃদয়ের পশুত্বকে যদি আমরা চিরতরের জন্য কোরবানি করতে পারি, তাহলেই আমরা আল্লাহ তায়ালার প্রিয়দের অন্তর্ভুক্ত হব।
খোদা তায়ালা আমাদের সকলকে প্রকৃত অর্থে ঈদুল আজহার গুরুত্ব বোঝার তৌফিক দান করুন এবং আমরা যেন সেই ইবরাহিমি কোরবানিকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের পরিষ্কার স্বচ্ছ হৃদয় দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট