ড. নাফসানিয়াত ফাতেমা
ঝুমবৃষ্টি, দেয়ালে ঘেরা ছোট্ট একটা বাউন্ডারিতে টিনের চালার ছোটখাটো দুইটা ছিমছাম বাসা। সামনে ছোট সাদা একটা গেট। টিনের চালার কোনা দিয়ে ঝমঝম পানি পড়ছে। জায়গাটা একটু গর্তমতো হয়ে গেছে, পাশে ছোট ছোট পাথর। সামনে ছোটখাটো একটা উঠান। ঘন সবুজ ঘাসে ভরা। এক পাশে একটা নিমগাছ। গাছের একটু উপরেই বাঁকা হয়ে যাওয়া ডালে ঝকঝকে সবুজ নিম পাতা। অসম্ভব মায়াময় একটা পরিবেশ। কী যে অদ্ভুত এক অনুভূতি।
আমার ছোটবেলার কথা-ই বলছি। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা সত্ত্বেও যেকোনো ঝুমবৃষ্টির দিনে বৃষ্টি দেখতে দেখতে আমি একমুহূর্তেই চলে যেতে পারি সেই মায়াময় পরিবেশে, মুহূর্তেই ছোটবেলার হাজারো মধুমাখা স্মৃতি এসে আমাকে আবার নিয়ে যায় সেই ছোটবেলায়।
অনেক ছোটবেলায় যখন দিনভর আকাশভাঙা বৃষ্টি হতো, তখন কত শত বিচিত্র ইচ্ছা যে হতো। ইচ্ছা হতো, ইশÑএই বৃষ্টিতে টিনের চালের কোনা দিয়ে যে বৃষ্টির পানি পড়ছে, ওই পানিতে দাঁড়িয়ে যদি ভিজতে পারতাম, তাহলে কতই-না মজা হতো! আবার খুব ইচ্ছে হতো বৃষ্টির পানিকে আমি যদি নিজ হাতে ধরে আকাশ থেকে নামিয়ে নিয়ে আসতে পারতাম বা বৃষ্টির পানি ঘাসে পড়ার পর যদি আবার ওই পানিকে আকাশে তুলে দিতে পারতাম। কী যে আজগুবি সব চিন্তা! মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হতো, এই বৃষ্টির মধ্যে যদি ওই নিমগাছের বাঁকা ডালটাতে উঠে ওখান থেকে লাফ দেওয়া যেত! (বৃষ্টি না হওয়া দিনগুলোতে ওইটা আমার একটা খুব মজার খেলা ছিল!) বৃষ্টির পানি জমে থাকা জায়গায় মাঝেমধ্যে ছোট ব্যাঙ দেখা যেত। অসম্ভব মন খারাপ হতো, আহা রে ঠান্ডায় কত-ই না কষ্ট হচ্ছে ওদের! শিশুমনের কী যে সুন্দর, নিষ্পাপ আর এলোমেলো সব চিন্তাÑকী যে সুন্দর সেই ছোটবেলা।
আরেকটু বড় হওয়ার পর বৃষ্টির দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে/বসে কাটিয়ে দিতাম। এই বাসার জানালাগুলো বিশাল বড় ছিল, আমার একদম ছোটবেলার অনেক স্মৃতি এই জানালাগুলো ঘিরে! তখনকার ছোট্ট ছিমছাম শহরে আমাদের গণ্ডি এতই ছোট ছিল যে এই জানালায় বসে সামান্য বৃষ্টি দেখাও আমার অসম্ভব প্রিয়, অসম্ভব ভালো লাগার একটা বিষয় ছিল।
আমরা ভাইবোনেরা স্কুল থেকে আসার পর আরও তিন ঘণ্টা পরে আম্মা অফিস থেকে আসতেন। ওই তিন ঘণ্টার প্রায় পুরোটাই আমি আমার বিছানার পাশের জানালায় দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিতাম। বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে থেকে জানালা দিয়ে বাইরের পুরো পৃথিবী দেখা যেত! ঝুমবৃষ্টিতে কেউ হয়তো ভাঙা ছাতা হাতে হাঁটছে, শরীরের অর্ধেকই হয়তো ভেজা, ভিজে চুপসে যাওয়া কোনো ভিখারি হয়তো এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, চানাচুরওয়ালা তার চানাচুরের গাড়ি নীল পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছে, কেউ চানাচুর কিনছে, কাগজের ঠোঙাতে সেই চানাচুরকে বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য আবার হাত দিয়ে ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
রাস্তার কোনায় কোনো একটা রিকশা এসে হয়তো থেমেছে। রিকশার মধ্যে নীল পলিথিনের ভেতরের মানুষগুলো প্রাণপণ চেষ্টা করছে পলিথিন দিয়ে বৃষ্টি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে! হঠাৎ করেই হয়তো আবার কোনো এক সুন্দর ঝকঝকে গাড়ি জোর গতিতে চলে যেত, এক মুহূর্তেই রাস্তার কোনায় জমে থাকা সব পানি ছিটকে পড়ে রাস্তার পাশে থাকা মানুষ, চানাচুরওয়ালা, ভিখারি, থেমে থাকা রিকশা সবকিছুকেই কেমন যেন নাড়িয়ে দিয়ে যেত!
বৃষ্টি দেখতে দেখতেই আমি আমাদের বাসার আশপাশে প্রতিটা থেমে যাওয়া রিকশা খুব ভালো করে খেয়াল করতামÑরিকশার নীল পলিথিনের কোনা দিয়ে কোনোভাবে আম্মার শাড়ি দেখা যায় কি না। হঠাৎ করেই দেখা যেত একটা রিকশা এসে আমাদের গেটে থেমেছে, ওমা, পলিথিনের কোনা দিয়ে আম্মার শাড়িও দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষার পালা শেষ হতো।
জীবন অনেক দূর গড়িয়েছে, মাঝে পার হয়ে গেছে অনেক অনেক বছর। এখন আমি দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকি। এখানেও মাঝে মাঝে দিনভর বৃষ্টি হয়, আমার জানালা দিয়ে বিশাল বড় সবুজ খেলার মাঠে বৃষ্টি দেখলেই আমি আর নিজেকে এই উন্নত দেশে বেঁধে রাখতে পারি না। সেই দরিদ্র দেশের ছোট্ট সুন্দর সিলেট শহর আর সেই শহরের প্রিয় বৃষ্টি আমাকে ভীষণভাবে টানতে থাকে। অবচেতন মনে আমি অপেক্ষা করতে থাকি ওই ছোট্ট ছিমছাম বাসা, ওই বৃষ্টিমাখা মায়াময় সিলেটের পরিবেশ আর ওই ছোট্ট বয়স ফিরে পাওয়ারÑএই অপেক্ষা অন্তহীন অপেক্ষা। আসলে কোনো কিছুই তো আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো কেন যে বুঝে ওঠার আগেই শেষ হয়ে যায়!
লেখক : গবেষক, শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন, ম্যাডিসন