নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপি আসবে না জেনেও তাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের শরিক হয়ে শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে দেশে-বিদেশে মারাত্মক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি সে সুযোগ গ্রহণ করার কথা ভাবছে না বলেই জানা যায়।
মেয়াদ শেষ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন তার অন্যতম। তফসিল ঘোষণার এক কি দুই দিন পরই বর্তমান সরকারের পরিবর্তন আনা হবে। মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের সদস্যসংখ্যা হবে ২০ থেকে ২৫। সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এর অংশীদার হবে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এই সরকারে স্থান না-ও পেতে পারেন। তার স্থলে আসবেন সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ। জি এম কাদেরকে সরকারে স্থান না দেওয়ার কারণ, তিনি সরকারে থেকে সরকারকে দেশে-বিদেশে রাজনৈতিকভাবে বিব্রতকর, ক্ষতিকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য নানাভাবে নানা কৌশলে ভূমিকা রাখতে পারেন। এমনকি বিভিন্ন অভিযোগ এনে তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করলেও বিস্ময়ের হবে না। জাতীয় পার্টি থেকে দুজন সদস্য নেওয়া হতে পারে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্রে জানা যায়, ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে জাসদ (ইনু) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, গণতন্ত্রী পার্টির একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি থেকেও একজন প্রতিনিধি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে। সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও রাষ্ট্রপতির কোটায় নেওয়া হবে। একইভাবে বিএনপিকে দুজন প্রতিনিধি দেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে আহ্বান জানানো হবে। বিএনপি সরকারে আসবে না জেনেও দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্যই তাদের প্রস্তাব দেওয়া হবে। সংসদে এদের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় এবং তারা সরকারকে অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে আশঙ্কায় বিএনপির প্রতিনিধিত্ব না নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে সরকারি কোনো কোনো মহল থেকে। অবশ্য অতি নাটকীয়ভাবে সরকার ও বিএনপিসহ বিরোধীদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংলাপ এবং একটা সম্মানজনক সমঝোতা হতেও পারে। বিদেশি কূটনীতিকেরা সে প্রক্রিয়া করতেই উদ্যোগী হয়েছেন।
বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনকালীন সরকারে না আসে এবং নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় অটল থাকে, তাহলে সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়সংকল্প হয়েই অগ্রসর হবে। বিএনপির দিক থেকে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করার পরই অন্তর্বর্তী সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। বিএনপিকে নেওয়া হলেও তা করা হবে নিতান্ত কৌশলগত কারণে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ব্যাপারে ১৪ দলেও তীব্র আপত্তি রয়েছে। তার গভীর সন্দেহপূর্ণ যোগাযোগ, কথাবার্তা বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে বলে ১৪ দলের নেতারা সরকারকে সতর্ক করেছেন। নির্বাচনকালীন সরকারে যারা থাকবেন, তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তবে কোনো প্রটোকল, সরকারি ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। তারা নির্বাচনকালীন এলাকায় যাবেন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে। স্থানীয় প্রশাসনের ন্যূনতম সহযোগিতা পাবেন না, সরকারি রেস্ট হাউস ব্যবহার করতে পারবেন ভাড়ায়। সরকারি যানবাহন, ড্রাইভার, কোনো স্টাফ ব্যবহার করতে পারবেন না।
অন্যদিকে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, গত দু-তিন সপ্তাহে দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের নিয়ে কূটনৈতিক মহলের একাধিক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে কূটনীতিকেরা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য নেতাদের দিয়ে সংঘাত ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে বিষয়ে একটি আপস প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে দুই দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন, এমন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নাম উপস্থাপন করা হয়েছে; যাকে প্রধান করে দুই বছরের জন্য একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে, যিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে কিছু সময় দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও নানা সংকটের সংস্কার করবেন। কূটনৈতিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে একটি শক্তিশালী মহল থেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। আর সেটি আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেই হতে পারে। বিশেষ মহলের প্রস্তাবিত নামের বিষয়ে এখন পর্দার আড়ালে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। রাজনৈতিক ঐকমত্য হলেই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসবে।
সূত্র জানিয়েছে, যিনি জাতীয় সরকারের প্রধান হবেন, তিনি আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তিনি ২০-৩০ জন সদস্য নিয়ে একটি সরকার পরিচালনার খসড়া দাঁড় করাবেন। তাদেরকে নিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত দেশ পরিচালনার ফর্মুলা তৈরি করবেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংঘাত ও সহিংসতা এড়িয়ে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করবেন। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করবেন।