Thikana News
০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ভূমিকম্প, সুনামি, সাউথ এশিয়া ওয়াচ ও আমি

ভূমিকম্প, সুনামি, সাউথ এশিয়া ওয়াচ ও আমি

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা- সাউথ এশিয়া ওয়াচের মহাসচিব হিসেবে আমি বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্প, সুনামি ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ে মানবতার সেবায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে মানুষ বিভিন্ন সময়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে শরণার্থী হিসেবে মাইগ্রেট হতে বাধ্য হয়েছে। সেই সমস্ত স্থানে গিয়েছি। আমি আজকের এ লেখায় ২০০৪ সালের শেষের দিকে সংগঠিত সুনামি পরবর্তী অভিজ্ঞতার কথা বলবো। এ সময় শ্রীলঙ্কা, ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড ও মালদ্বীপে প্রায় দুই লাখ ৮৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ও গৃহচ্যুত হয় কয়েক মিলিয়ন মানুষ। আমি ও কলকাতা থেকে আমাদের সংগঠন- সাউথ এশিয়া ‘ওয়াচ ইন্ডিয়া’ চ্যাপ্টার (ইস্টার্ন জোন)-এর একজন নেতা শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে মিলিত হই। আমি যথারীতি জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে ভার্জিন আটলান্টিক এয়ারলাইন্স যোগে কলম্বো পৌঁছি। এয়ারপোর্টে মণীষ জয়বর্ধনে ও নাজিমউদ্দিন যখন আমাকে রিসিভ করে, রাত তখন ৩টা। প্লেনে ডিনার ছাড়াও ল্যান্ডিংয়ের এক ঘন্টা আগে স্ন্যাকস সার্ভ করা হয়েছিলো, তাই কোন খিদে ছিলো না। ওরা আমাকে ‘হোটেল গালাধারী’ নামের একটি ফাইভ স্টার হোটেলে নিয়ে যায়। কলকাতা থেকে আগত সাউথ এশিয়া ওয়াচের ইন্ডিয়া চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সত্যব্রত চৌধুরী আগের দিন এসে একই হোটেলে উঠেছেন। পরের দিন সকাল ৯টার দিকে হোটেলে আমরা একসাথে নাস্তা করলাম। পরে আমার রুমে বসে ঐদিনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করলাম। ইতিমধ্যে আমাদের সাউথ এশিয়া ওয়াচ শ্রীলঙ্কা চ্যাপ্টারের ১০-১২ জন নেতাকর্মী আসলো। তাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা সুনামি বিধ্বস্ত, বিশেষ করে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ও মুসলিম, এরিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করলে আমাদেরকে বাধা দেয়া হলো। আমি কথা বললাম তাদের সাথে। তারা বললো, ওদিকে যাওয়া যাবে না। রেডক্রসের কোন টিমকেও আমরা যেতে দেইনি।

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, রহস্যটা কি? তোমরা মাইনরিটি এরিয়াতে কাউকে যেতে দিচ্ছো না ইচ্ছে করেই! বিবিসির খবরে বলা হচ্ছে, তোমরা মাইনরিটিকে খতম করে দিতে চাও।

উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কা একটা গোঁড়া বৌদ্ধ রাষ্ট্র। যা হোক, আমরা সংখ্যালঘু ও শ্রীলঙ্কার স্থানীয় হতদরিদ্র কয়েকটি ক্যাম্পে গিয়ে কিছু শুকনো খাবার, পানীয় জল, পানি বিশুদ্ধকারী ট্যাবলেট, ফল ও নগদ কিছু টাকা দিলাম। আমি সুনামির ১১ থেকে ১২ দিন পর সুনামি বিধ্বস্ত ওই এলাকায় যাই।

ঐদিন সন্ধ্যায় একটি বড় লোকাল রেস্টুরেন্টে আমাদের, বিশেষ করে আমি ও সত্যব্রত চৌধুরীকে, নিয়ে একটি মতবিনিময় সভায় আয়োজন করা হয়। সেখানে সুনামি-পরবর্তী অবস্থা, শ্রীলঙ্কার আর্থিক ক্ষতিসহ অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর আগের রাতে আমি রাতে কী খেতে পছন্দ করবো, তা জানতে চাইলে বললামÑ সত্যব্রত বাবু যেখানে খাবেন, আমিও ওখানে খাবো। তবে আমি মাছ খেতে পছন্দ করি, তাই আমার ক্ষেত্রে মাছ অবশ্যই থাকতে হবে। কোন মাংস থাকলে চলবে না। মাছের সঙ্গে সব্জি থাকলে ভালো হবে।
উদ্যোক্তারা বলেন, এখানে তো আমরা মাছ খাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ নদী-সমুদ্রে যত মাছ আছে, তারা মানুষের গলিত লাশ খেয়েছে এবং এখনও খাচ্ছে।

আমি বললাম, এখন তো নদীতে কোন লাশ দেখা যাচ্ছে না। তাই মাছ খেতে কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া আমার মাছ ছাড়া চলবে না।

মাছতো মাত্র দু’একটা রেস্টুরেন্টে রান্না করা হয়। আমরা চেষ্টা করবো ম্যানেজ করতে।
আমি বললাম, একটু বেশি করে রাঁধবেন। যাতে আমরা কিছুটা হোটেলে নিয়ে গিয়ে আরো ২/৩ দিন খেতে পারি। তাহলে বারবার রান্না করতে হবে না।
যাক, যথাসময়ে ডিনারের সময় হলো। আমাদের সামনে বড় দুই গামলা। আমি এটা ইচ্ছে করেই বলেছিলাম। আমি তখন বললাম, মাছ আমি শুধু একা খাবো না, আপনাদেরও খেতে হবে। এই কথা বলে আমি জয়বর্ধনকে সবার প্লেটে এক টুকরা করে মাছ দিতে বললাম। সে তাই করলো এবং সবাই একসাথে বসে মাছ খেলাম।
ব্যাপারটা এমন হলো, আমি তাদের মাছ খাওয়ার ব্যাপারে না বললে হয়তো তারা এত সহজে ও তাড়াতাড়ি মাছ খেতেন না। তাদের অনেকে বললো যে, এটা তাদের সেন্টিমেন্ট অফ ইমোশন। এর কারণ, তাদের অনেক নিকটাত্মীয়ের লাশ ভাসছিলো নদীতে।

এর পরেরদিন আমরা গেলাম শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ নেতা এটি আরিয়ারত্নের সাথে মতবিনিময় করতে। তিনি শ্রীলঙ্কার বড় মাপের মানবাধিকার নেতা। তাকে অনুরোধ করলাম, আমাদের সংগঠন সাউথ এশিয়ানের আন্তর্জাতিক কমিটির একজন উপদেষ্টা হতে। এবং তাকে সংগঠনের নিউজলেটার দিলাম। তিনি নিউজলেটারে আমাদের আন্তর্জাতিক কার্যক্রম দেখে খুবই বিস্মিত হলেন এবং বললেন, আপনারাতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করে যাচ্ছেন! আমি আপনাদের সাথে একজন সামান্য কর্মী হিসেবে কাজ করতেও রাজি আছি। এই বলে তিনি দাঁড়িয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন।

শ্রীলঙ্কার আরো কিছু স্মৃতি আছে, যা পরবর্তীতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রয়েছে।
পরের দিন রাত্রে কলম্বো থেকে দেড় ঘন্টার যাত্রায় শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন যোগে মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে পৌঁছলাম। এই ফ্লাইটে দেখলাম মালদ্বীপের অনেক মানুষ, তারা কেউ এসেছিলো চিকিৎসা করাতে, কেউ এসেছিলো শপিং করতে। কিছু ছাত্র, যারা তাদের বাড়িতে যাচ্ছে ছুটি কাটাতে। তার মানে হলোÑ প্রায় সবক্ষেত্রেই মালদ্বীপকে তাদের কাছের দেশ শ্রীলঙ্কার ওপর নির্ভর করতে হয়।

আমাকে মালে এয়ারপোর্টে মেজর ওসমান রিসিভ করলেন। মেজর ওসমান বাংলাদেশের মেজর নাজমুলের বন্ধু। নাজমুল সম্পর্কে আমার নাতি হয়। প্রেসিডেন্ট গাউয়ুম আব্দুল মামুনের গার্ড রেজিমেন্টের একজন সদস্য ছিলেন ওসমান। তিনি আমাকে একটা সরকারি রেস্ট হাউসে নিয়ে গেলেন। পরের দিন আমি মেজর ওসমানের সাথে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব, হিউম্যান রাইটস কমিশন চেয়ারম্যান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রীÑ এদের সাথে মতবিনিময় করলাম। জানতে পারলাম তাদের ক্ষয়ক্ষতির কথা।
প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাউয়ুম তখন সার্কের একটা মিটিংয়ে অ্যাটেন্ড করতে নেপালে ছিলেন। তাই তার সাথে দেখা করা সম্ভব হয়নি।

আমি ডিফেন্স মিনিস্টারকে বললাম, আমি ক্ষতিগ্রস্থ দু-একটি দ্বীপে যেতে চাই এবং কিছু সাহায্যসামগ্রী দিতে চাই সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য।
তিনি বললেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শিরিন ফাতেমা আপনার সাথে যাবেন কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের সাথে।
দ্বীপটির নাম হুলু মেল। দ্বীপটি সুনামির সময় পুরো উল্টে গিয়েছিলো। এতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
আমরা ওইদিন বিকেলে হুলু মেল দ্বীপে গিয়ে প্রায় ২শ’ গৃহহারা লোককে স্যান্ডউইচ, ফল, সোডা, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিলাম।
পরেরদিন শ্রীলঙ্কা এয়ারযোগে মালে থেকে কলম্বো ও কলম্বো হয়ে দিল্লি পৌঁছলাম। দু’দিন পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরালের সাথে মতবিনিময় করি।

লেখক : নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সাউথ এশিয়া ওয়াচের মহাসচিব, এশিয়ান-আমেরিকান ডেমোক্র্যাটিক সোসাইটির কো-চেয়ারম্যান ও ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির (DNC) সদস্য।


কমেন্ট বক্স