বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জালিয়াত চক্রের সহায়তায় বাংলাদেশি নাগরিক বনে যাচ্ছেন। ভুয়া জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে নিয়ে এ কাজ করছেন রোহিঙ্গারা। ইতোমধ্যে তাদের অনেকে পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলে গেছেন।
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই জালিয়াতির কাজে জড়িত নির্বাচন কমিশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারি-কর্মকর্তারা। এমন জালিয়াতির ঘটনা নতুন না হলেও সর্বশেষ আরেকটি চক্রকে আটক করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার অ্যাণ্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের (দক্ষিণ) সদস্যরা। তারা যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছেন তাদের মধ্যে দুইজন হলেন দিনাজপুরের বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ এবং বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র। তাদের যোগসাজসে এই জালিয়াতির কাজে জড়িত আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম মুন্না, মো. রাসেল খান ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের (দক্ষিণ) অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, তারা শুধু জন্ম নিবন্ধনের জন্য কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা করে নিতো। এরপর ন্যাশনাল আইডি কার্ড, পাসপোর্ট এসবের জন্য আলাদা আলাদা পরিমাণ টাকা নিতো। আমরা জন্ম নিবন্ধন দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করে দেখেছি। তারা রোহিঙ্গাদের যেগুলো দিয়েছে তা সার্ভারে আছে। শুধু নাম, ঠিকানা পরিবর্তন করে দেয়া। আর এনআইডি আমরা পরীক্ষা করে দেখছি।
গোয়েন্দা বিভাগের এই দলটি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্টসহ আরো ২৬ জনকে পল্টন এলাকা থেকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করে। তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত দুই-এক দিনের মধ্যে জানানো হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। আটক পাঁচজন জানিয়েছেন, তারা রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দেন। জন্ম নিবন্ধনের পর জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট বানিয়ে দিতেও তারা প্রতারণার আশ্রয় নেন। জন্ম নিবন্ধন হয়ে গেলে এনআইডি ও পাসপোর্টের কাজ সহজ হয়ে যায়।
আটকদের মধ্যে দুইজন জানিয়েছেন, তার কক্সবাজার এলাকায় এক হাজার ১৫০ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দিয়েছেন।
এই প্রতারকেরা ফেসবুক ও টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারপর দেশের বিভিন্ন এলাকার পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে এনআইডির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারিদের অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগিয়ে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দেয়।
গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তারা পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটরদের মাধ্যমে পৌর মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে৷ তারা বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ এবং বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্রকে আটক করলেও কুষ্টিয়ার ভেড়ামাড়া এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি পৌরসভার মেয়র ও চেয়ারম্যানের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেও রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন দেওয়ার তথ্য পেয়েছেন।
চলতি মাসের ১৬ তারিখ কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে ইয়াসির নামে এক রোহিঙ্গা যুবক আটক হয়েছেন। তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পশ্চিম ঘোড়াশাল ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের জাকির হোসেন ও হাসিনা বেগমের ছেলে পরিচয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেন। ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তুলতে গিয়ে সন্দেহজনক আচরণের কারণে তিনি ধরা পড়েন। ওই যুবক মিয়ানমারের বালি বাজার এলাকার বাসিন্দা। তিনি কক্সবাজারের বালুখালি ক্যাম্পে থাকেন। ওই ঘটনায় রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে দেয়া চক্রের তিন জনকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে ১৪টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়।
সম্প্রতিক সময়ে কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ কুড়িগ্রাম ও গাজীপুরেও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট করতে গিয়ে আটক হয়েছেন। জানা গেছে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট এই পুরো কাজ করতে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকায় চুক্তি করে প্রতারক চক্র। আবার এটা তারা ধাপে ধাপেও চুক্তি করেন।
এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, গোয়েন্দা পুলিশের হাতে পাঁচজন আটক হওয়ার পর আমরা সারাদেশে সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছি। আজকের (মঙ্গলবার) মধ্যে জেলা উপজেলার সব পাসওয়ার্ড পরিবর্তন হয়ে যাবে। আগে খুব সাধারণ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হতো, যা হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। এখন আমরা শক্ত পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে বলেছি। আলফা নিউমেরিক পাসওয়ার্ড দিতে বলেছি। আগে ১, ২, ৩ এভাবে সিরিয়ালি পাসওয়ার্ড দিতো।
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেয়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। কয়েকজন চাকরি খুইয়েছেন। কয়েকজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।'
ঠিকানা/ছালিক